মৃত্যুতেই কি সব কিছুর শেষ? আত্মা বা Soul বলে আদৌ কি কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে এই বিশ্বে, নাকি সেটা নেহাৎই কল্পনা? পুনর্জন্ম অথবা জাতিস্মর কি আত্মার অস্তিত্ব কেই ইঙ্গিত করে? বিজ্ঞান কি আত্মার অস্তিত্ব কে স্বীকার করেছে?
বহু মানুষের ধারনা মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন থাকে , একেই আত্মা বলা হয়। এর মধ্যে শিক্ষার সূযোগ পাওয়া না পাওয়া ব্যাক্তিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পৃথিবীজুড়ে যে ৪২০০ প্রকারের ধর্ম বর্তমান, সেখানে আত্মা নিয়ে রয়েছে নানান মতামত, রয়েছে অনেক বিভ্রান্তিও। সেখান থেকেই উঠে আসে অসংখ্য প্রশ্ন।
শ্রীমদ্ভাগবদ গীতায় আত্মা সংক্রান্ত অনেকগুলো শ্লোক আছে। দুটি শ্লোক, উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি। ২ য় অধ্যায়ের ২২ তম শ্লোকে আছে -
“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়। নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।। তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা। ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহি।।
ঐ অধ্যায়ের ২৩ তম শ্লোকে আছে -
নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানি নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।
এই দুটি শ্লোকের অর্থ করলে দাঁড়ায় , “মানুষেরা যেমন ছিন্ন বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মা তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীরে প্রবেশ করে। এই আত্মাকে কোনো অস্ত্র দ্বারা ছেদন করা যায় না, আগুন একে দগ্ধ করতে পারে না, জল দ্বারা একে সিক্ত করা যায় না, বাতাস একে শুষ্ক করতে পারেনা। ইনি কোথা থেকে আসেনি এবং কোথাও যাবে না। তিনি অজেয়, নিত্য, শাশ্বত, সর্বজ্ঞ, স্থির, অচল ও সনাতন। শরীর হত হলেও আত্মা হত হয়না "।
আত্মার এই সংজ্ঞা কে মেনে নিলে একটা সমস্যা এসে প্রকট হয়। গীতার মতে আত্মা কে কাটা, ভেজানো, জ্বালানো ইত্যাদি নাকি যায়না। অথচ দেখুন ব্রহ্মপুরাণ, গরুরপুরাণ, ইত্যাদিতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ রয়েছে স্বর্গ- নরকের বর্ণনা। যদি আপনি হিন্দু হন এবং এই জীবনে ভালো কাজ করে যান তাহলে হিন্দু বিধান মতে আপনার আত্মা মৃত্যুর পরে যাবে স্বর্গে। সেখানে, রোগ- ব্যাধি নেই।শুধু আনন্দ হি কেবলম। কিন্তু আপনি যদি এই জীবনে সর্বদা পাপ কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন যেমন খুন,ধর্ষণ, চুরি, ঘুষ দেওয়া- নেওয়া ইত্যাদি , তাহলে মৃত্যুর পরে আপনার আত্মার জন্য রয়েছে বিভৎস শাস্তি বা অত্যাচারের উল্লেখ গরুরপুরাণে। যেমন গরম তেলে ভাঁজা, কাঁটার ওপর দিয়ে টেনে -হিচড়ে নিয়ে যাওয়া, মুগুর দিয়ে আড়ংধোলাই,তপ্ত লৌহ শলাকা দ্বারা আঘাত, ইত্যাদি অনেক কিছুই যা আপনি কল্পনাতেও আনতে পারবেন না (একশ্রেণীর লোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত,বেইমান, ধান্দাবাজ নেতা মন্ত্রীদের কি পরিণাম হবে ভেবেই শিউরে উঠছি)।
একদিকে গীতায় বলছে আত্মাকে কাটা যায় না, জ্বালানো যায়না এবং অন্যদিকে পুরাণে আত্মাকে জ্বলানো, কাটার নির্দেশ রয়েছে। এতো চরম স্ববিরোধীতা। জানিনা কতজন মানুষ এসব নিয়ে মুক্তমনে ভাবতে পছন্দ করেন।
ইসলাম ধর্মেও রয়েছে বেহেশত এবং দোজখ এর বর্ণনা। খ্রিষ্টান ধর্মেও আছে হেভেন এবং হেল এর স্পষ্ট বর্ণনা। হিন্দুধর্মে আত্মাকে যেভাবে অত্যাচার করার উল্লেখ আছে, প্রায় একই কায়দায় ইসলাম এবং খ্রিষ্টান ধর্মেও রয়েছে শাস্তির উল্লেখ। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আজই খোলামনে পড়ুন - গীতা, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ, মনুসংহিতা, বেদ,বাইবেল, কোরান,হাদিস ইত্যাদি সমস্ত গ্রন্থ গুলো কে যাকে আমজনতা ' ধর্মগ্রন্থ ' বলেই আখ্যা দেন। দেখবেন যা লিখছি সেসবই লেখা আছে। সঙ্গে রয়েছে প্রচুর স্ববিরোধী,বিজ্ঞানবিরোধী, ভুলেভরা, হাস্যকর কথাবার্তাও।
আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে কথা উঠলেই একদল ব্যাক্তি প্রথমেই যে বই টির উল্লেখ করেন সেটি হল স্বামী অভেদানন্দজী মহারাজ রচিত “মরনের পারে "। যার ইংরাজি অনুবাদ “Life Beyond Death ", প্রকাশক - শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ। বইটি বেস্টসেলার তালিকায় দীর্ঘবছর ধরে স্থান করে রয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, অভেদানন্দজি কি তবে সব ভুল লিখেছেন, তিনি কি মিথ্যেবাদী? আপনি পারবেন এই বইটিকে ভুল প্রামাণ করতে? ইত্যাদি।
উক্ত বইটির প্রথমেই লেখা আছে “মরণের পারে (বৈজ্ঞানিক আলোচনা)। কি রকমের বৈজ্ঞানিক আলোচনা, নাকি বিজ্ঞানবিরোধী আলোচনা আসুন দেখেনেওয়া যাক।
' মরণের পারে ' বইটি বেশ ভালো ভাবে পড়লে বোঝা যায়,স্বামী অভেদানন্দ মনে করতেন যে-
১- চিন্তা,চেতনা, চৈতন্য কিংবা মনই হচ্ছে আত্মা।
২- চিন্তা,চেতনা,চৈতন্য কিংবা মন আত্মারই কর্মফল।
অভেদানন্দজীর এই তত্ত্ব কে মেনে নিলে খুব মুশকিলে পড়তে হয়। কারণ আজ ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের বিজ্ঞানের পাঠ্যবই থেকে শিখছে (যদিও পরে সেসব বেমালুম ভুলে থেকে অন্ধবিশ্বাস কেই আঁকড়ে ধরছে) যে, একজন মানুষ চিন্তা করে নিজেদের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ থেকেই। অর্থাৎ চিন্তা,চেতনা, চৈতন্য কিংবা মন যাই বলা যাক সেসবের উৎপত্তি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ থেকেই। একজন মানুষের মৃত্যু হলে হয় তাঁর দেহ হয় চিতায় জ্বালিয়ে দেওয়া হবে নয়তো মাটিতে পুঁতে দিলে পঁচে গলে সেই মাটিতেই মিশে যাবে, নয়তো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পড়ে থাকলে চিল- শকুনে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয় যে, একজন মানুষের মৃত্যুর সাথে-সাথেই মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের ও মৃত্যু। মন কে আত্মা মানলে এটাও মানতে হচ্ছে আত্মা মরণশীল। আর আত্মা মরণশীল এটা প্রমাণিত হলে মিথ্যে হয়ে যায় ঈশ্বর, স্বর্গ- নরক,পুর্বজন্ম,আত্মা, জাতিস্মর ইত্যাদি অনেক কিছুই।
'মরণের পারে' নামক বেস্টসেলার বই এর কিছু বৈজ্ঞানিক আলোচনা (পড়ুন বিজ্ঞানবিরোধী) র কিঞ্চিত নমুনা এখানে তুলে ধরছি, ত্রয়োদশ পুনমূর্দণ,বৈশাখ ১৩৯২ বঙ্গাব্দ থেকে।
ত্মার স্বরুপ কেমন? এই বিষয়ে স্বামীজির (লেখার সুবিধের জন্য স্বামীজি বলতে এখানে বিবেকানন্দ কে নয়, বরং অভেদানন্দজি কে বোঝানো হলো) মত “মেঘের মত, কুয়াশার মত (ঐ বইএর ২৮ পৃষ্ঠা)। তিনি এটাও জানিয়েছেন -
বিজ্ঞানীরা এই কুয়াশার মত আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন, ঐ ‘বস্তুটির নাম দিয়েছেন 'এক্টোপ্লাজম' বা সূক্ষ্ম- বহিঃসত্তা, এটি বাষ্পময় বস্তু এর কোন একটি নির্দিষ্ট আকার নেই। একে দেখতে একখণ্ড ছোট মেঘের মতো, কিন্তু যে-কোন একটি মূর্তি বা আকার নিতে পারে’। (ঐ বইএর ২৮ - ২৯ পৃষ্ঠা)
স্বামীজির এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিজ্ঞান কুয়াশার মত আত্মার অস্তিত্বকে মোটেই স্বীকার করেনি। বিজ্ঞান এক্টোপ্লাজম বলতে মেঘের মত,কুয়াশার মত কোনও বস্তুকেই নির্দেশ করেনা। এক্টোপ্লাজম
(Ectoplasm) বলতে বিজ্ঞানীরা মানব দেহের শরীরের কোষ (Cell) এর অভ্যন্তরস্থিত সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm) নামের একপ্রকার জেলির মতন বস্তুর বাইরের দিকের অংশকেই স্পষ্ট নির্দেশ দেয় (এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ে দেখুন ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেনীর বিজ্ঞানের বই)।
আত্মাকে দেখতে মেঘের মত,কুয়াশার মত ইত্যাদি বলেই ক্ষান্ত হননি স্বামীজি, এর সপক্ষে প্রামাণ হিসেবে একটা দারুণ উদাহরণ তুলে ধরেছেন। যারা নিজের আত্মাকে স্বচক্ষে দেখতে চান তাঁরা সামান্য খরচ করে দাঁড়িয়ে পড়ুন একটা এক্সরে মেশিনের সামনে, এবং তুলে নিন নিজ শরীরের কোনো একটা অঙ্গের ছবি। এক্সরে ফটো হাতে পাওয়ার পরে দেখতে পাবেন নিজের আত্মাকে। জানেন কিভাবে? এইখানে স্বামী অভেদানন্দজি জানাচ্ছেন - "আমার দেহের কোনো অংশ যদি এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখি, দেখব- হাতের বা দেহের অংশটি কুয়াশাময় পদার্থকণায় পরিপূর্ণ, চারিদিকে যেন তারা ঝুলছে। সুতরাং যে দেহকে আমরা জড় পদার্থ বলি আসলে সেটা জড় নয়,তা মেঘের বা কুয়াশার মতো এক পদার্থ বিশেষ"। (ঐ বই এরই ৩২ পৃষ্ঠা)।
ভাবা যায় কি মারাত্মক রকমের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা পড়া মাত্রই অজ্ঞান হওয়ার যোগাড়। একটা অপ্রিয় সত্যি বলতে বাধ্য হচ্ছি, স্বামীজির যদি শরীর বিদ্যার স্কুলের সামান্যতম জ্ঞানটুকুও থাকতো তাহলে নিশ্চই তিনি এটা জানতেন যে, শরীরের হাড়, মাংস, পেশি ইত্যাদির ঘনত্বের ভিন্নতার জন্যই এক্সরে ছবিতে সাদা-কালো রঙের গভীরতারও বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। আর এই রঙের গভীরতার বিভিন্নতাকেই আত্মার কুয়াশারুপের প্রামাণ হিসেবে খাড়া করতে এবং আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসীদের মগজে ঢোকাতে চেয়েছেন স্বামী অভেদানন্দজি মহারাজ।
স্বামীজি আবার আত্মার ওজন মাপার এক প্রকার যন্ত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন 'মরণের পারে' বইএর ২৮ পৃষ্ঠায়। তিনি জানাচ্ছেন -
"বিশেষ এক ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে, যে বস্তুটির সাহায্যে মৃত্যুর পর দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাষ্পতুল্য আত্মা বা মনকে ওজন করা সম্ভব। দেখা গেছে আত্মার ' ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ"।
বাহ, চমৎকার তথ্য। শুনেই শিহরণ জাগছে শরীরের সর্বাঙ্গে। মজাটা হচ্ছে স্বামীজি এমন জব্বর তথ্য জানিয়েই খালাস। তিনি কিন্তু মোটেই জানাননি এমন দারুণ যন্ত্রটির নাম কি, কে, কতসালে, কোথায়, এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছেন। এই বিষয়ে অভেদানন্দজির অন্ধভক্তরা কিংবা উক্ত বইটির প্রকাশক ' শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ ' যদি পথ দেখান তবে বিশেষ বাধিত হব। আত্মা কিংবা মরণের পারে গ্রন্থের পক্ষ নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলবেন তাদেরকে অনুরোধ, দয়াকরে ভাববাদী শিবিরের ওপরে চাপ সৃষ্টি করুন যাতে তারা সর্বসমক্ষে এমন যন্ত্রটির ব্যপারে বিস্তারিত জানায়। চাপ পড়লেই দেখা যাবে যে তাদের বক্তব্য কতটা মিথ্যাচারে ভরা, কতটা বিজ্ঞানবিরোধী।
আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে যারাই সন্দিহান তাঁদের উদ্দ্যেশ্যে ভাববাদী শিবির থেকে একটা পরীক্ষার কথা প্রায়শই উল্লেখ করা হয়। কয়েকজন বিজ্ঞানীরা নাকি একবার একজন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যাক্তিকে কাঁচের একটা বাক্সে রেখে পুরো সিল করে দিয়েছিল অক্সিজেন প্রবেশের সমস্ত পথ কে বন্ধ রেখেই। একসময় ঐ বাক্সবন্দি ব্যাক্তিটির মৃত্যু ঘটলে আচমকা নাকি কাঁচের বাক্সটি ফেটে যায়। এই কাঁচ আপনা থেকে ফেটে যাওয়াই নাকি আত্মার অস্তিত্বকে প্রামাণ করার জন্য যথেষ্ট।
এই (কু) যুক্তিটি বহু মানুষ আজও বিশ্বাস করেন। অথচ এটা পড়ার পরে অসংখ্য প্রশ্ন উঠে আসাই স্বাভাবিক যে, এই ঘটনাটা ঠিক কবে, কত সালে,কোন দেশের বিজ্ঞানীরা ঘটিয়েছে এমন অনেক কিছুই। না, স্বামীজিও কিন্ত এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরবতা পালন করেছেন। ভাববাদী শিবিরও কেন জানিনা নিশ্চুপ। প্রশ্নের উত্তর গুলো তোলা রইলো গুরু ভাই- বোনেদের উদ্দ্যেশ্যে যাঁদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত হয়েও এমন বিজ্ঞানবিরোধী কথাবার্তায় গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন। ভাবখানা এমন যে, ' গুরু বাক্য অভ্রান্ত,তাই প্রশ্ন তোলার অর্থই হচ্ছে গুরুর প্রতি অবিশ্বাস। ছিঃ ছিঃ এতো মহাপাপ কাজ ' । যারা এই কাঁচ ফেটে আত্মা বের হওয়া তত্ত্বে প্রবল ভাবে বিশ্বাসী তাঁদের প্রতি অনুরোধ, একটা পোকা কিংবা পিঁপড়ে নিন,এবার সেটাকে জ্যান্ত অবস্থাতেই ভরে ফেলুন একটা ট্রান্সপারেন্ট কোনো কৌটো অথবা শিঁশি তে। একসময় অক্সিজেনের অভাবে পোকা কিংবা পিঁপড়ে টি মারা যাবেই। আর আত্মার অস্তিত্ব যদি বাস্তবিকই থেকে থাকে তাহলে পিপড়ে কিংবা পোকাটির ও থাকা স্বাভাবিক। আচমকা কৌটো ফেটে গেলে বুঝবেন আত্মার অস্তিত্ব সত্যিই আছে এবং অভেদানন্দজির আত্মা সংক্রান্ত সব লেখাই অভ্রান্ত।
আত্মা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বামী বিবেকানন্দর নাম অবধারিত উঠে আসবেই। কারণ উনিও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। বিবেকানন্দর পূর্নাঙ্গ জীবনী দশ খন্ডের ' বানী ও রচনা ' পড়লেই সেটা বোঝা যায়, জানা যায়। যাইহোক আত্মা নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দর ধারণা অবাক করার মতোই। স্বামী বিবেকানন্দও কিন্তু অভেদানন্দজির মতো মনে করতেন - ' চিন্তা,চেতনা, চৈতন্য বা মনই হল আত্মা এবং চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মন আত্মারই কাজ- কর্মের ফল '। মন নিয়ে বিবেকানন্দর একটা বক্তব্য তুলে ধরছি, যা কৌতুহলোদ্দিপক এবং কৌতুক-উদ্দিপক।
বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, প্রকাশক নবপত্র,পৃষ্ঠা ২৬৪ এবং “বেদান্ত কি এবং কেন?”দশম পুনর্মুদ্রণ - মাঘ ১৪০৮, পৃষ্ঠা- ৩৭ এ লেখা আছে- “মন জড়ে রুপান্তরিত হয় এবং জড়ও মনে রুপান্তরিত হয়,এটা শুধু কম্পনের তারতম্য। একটি ইস্পাতের পাত গড়ে তাকে কম্পিত করতে পারে এ রকম একটা শক্তি এতে প্রয়োগ কর। তারপর কি ঘটবে? যদি একটা অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, প্রথমে তুমি শুনতে পাবে একটি শব্দ- একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত করো, দেখবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হয়ে উঠছে। শক্তি আরও বাড়িয়ে দাও, ইস্পাতটি এক্কেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ইস্পাতটি মনে রুপান্তরিত হয়ে গেছে"।
না, এরপরে মন্তব্য নিঃস্প্রয়োজন। কারন বলার ভাষা টাই যে হারিয়ে ফেলেছি ইস্পাতের দ্বারা মন তৈরির থিওরি শুনে। একটা বাস্তব সত্য হচ্ছে, কোনো কিছু জানতে, শিখতে হলে সবজান্তার ভণ্ডামি ছেড়ে আন্তরিক হতে হয়। হতে হয় মুক্তমনা এবং জিজ্ঞাসু মনের। কে কি বলে গেছেন অথবা লিখে গেছেন সেটকেই অভ্রান্ত বলে ধরে না নিয়ে নিজেই মুক্তমনে সত্যকে খুঁজে দেখা খুবই প্রয়োজন। কারণ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব তো ভন্ডরাই কষে থাকে।
বিজ্ঞানবিরোধী কথাবার্তায় ভর্তি বেস্টসেলার বই “মরণের পারে “থেকে অসংখ্য উদাহরণ টেনে এনে বোঝানে যায় যে আত্মা নিয়ে স্বামী অভেদানন্দজি মহারাজ যা যা লিখেগেছেন নিজের বইতে সেগুলো সম্পূর্ণ উনার নিজের মনেরই কথা। যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। পুরোটাই গপ্পো এবং আজগুবি তথ্যের জঞ্জাল। আরেকটি চমকপ্রদ উদাহরণ দিচ্ছি "মরণের পারে”বই থেকে। কিন্তু তার আগে জানিয়ে রাখা আবশ্যক যে, আত্মার কুয়াশামার্কা রুপের সরাসরি কিন্তু বিরোধীতা করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। এই প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি - বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড,নবপত্র প্রকাশন,পৃষ্ঠা ২৫৪ থেকে। বিবেকানন্দ জানাচ্ছেন “আত্মার কোনও রুপই নেই। কোন অণু- পরমাণুর দ্বারা গঠিত নয় বলে আত্মা অবিনশ্বর... আত্মা কোনোরুপ উপাদানের সমবায়ে গঠিত নয় ।
নিন এবার কাকে ছেড়ে কার তত্ত্বে বিশ্বাস করবেন আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসীরা। একজনের কথা মানলে অপরজন কে অবিশ্বাস করতেই হবে। কাকে বিশ্বাস এবং কাকে অবিশ্বাস করবেন এটা আত্মায় বিশ্বাসী জনগণের হাতেই ছেড়ে দিলাম।
অভেদানন্দজি নিজের বই এ কয়েকটি সাদা-কালো ছবি বা ফটো তুলে ধরেছেন যা কিনা প্রামাণ করে সেগুলো আত্মার ছবি। ‘মরণের পারে’, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৮ এ লেখা আছে "আত্মা যখন মরণের পর দেহ ছেড়ে যায় তখন তার ফটোগ্রাফ বা আলোকচিত্র নেওয়া যায়"। আচ্ছা কি ভাবে নেওয়া যায়? একটা সাধারন ক্যামেরাতে নিশ্চই নেওয়া যাবে। আমার কাছে কোডাক কোম্পানির রিল ভরা ক্যামেরা যেমন আছে তেমনই আমার এক আত্মীয়ের কাছে ' ডিএসএলআর ' নামক ক্যামেরাও আছে। এখন তো স্মার্টফোন বা এন্ড্রয়েড ফোনের যুগ। এই ফোনেই দিব্বি আত্মার ছবি নেওয়া যায়। গুগল ইমেজে সার্চ করলে এমন আত্মার অসংখ্য ছবি পাওয়া যাবে। সুপার ইমপোজ করা কিংবা কাঁচের রিফ্লেক্সন দ্বারাও এমন অনেক ছবি পাওয়া সম্ভব যেগুলো দেখে সয়ং অভেদানন্দজিও বিষ্ময়ে হতবাক হতেনই। কেউ চাইলে নিজেরাই চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ' মরণের পারে ' বই তে ছাপা সেসব ছবিগুলোর চেয়ে আরও চমকপ্রদ সব ছবি তোলা যাবে যেগুলো দেখে একজন আত্মায় বিশ্বাসী (পড়ুন অন্ধবিশ্বাসী) মানুষ হতবাক হবেই হবে। আমি স্বচক্ষে দেখে নিয়ে একটা আত্মার ছবি তুলতে চাই, কেউ যদি আন্তরিক ভাবে আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করেন তাহলে বিশেষ বাধিত হবো।
কিছু মানুষ আছেন যারা লজিকের চেয়ে ম্যাজিকে বেশি বিশ্বাস করেন। অথচ তাঁরা এটাই ভুলে যান যে, মন্ত্র-তন্ত্র দ্বারা ম্যাজিক সম্ভব নয়। প্রতিটি ম্যাজিকের পেছনে থাকে একটা কৌশল, যা ছাড়া ম্যাজিক দেখানোই অসম্ভব। অভেদানন্দজির পরেই যার বই এর বিক্রি বেশ ভালো তিনি হলেন সাধনার শেষ স্তরে পৌছানো,আধ্যাত্মিক জগতের সাধু, অলৌকিক ও অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী (এসব অবশ্য ভক্তদেরই কথা) স্বামী নিগূঢ়ানন্দজি। তিনি আত্মা, পরলোক, জাতিস্মর, প্ল্যানচেট ইত্যাদির ওপরে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সেসব বই মুক্তমনে পড়লে বোঝা যায় নিগূঢ়ানন্দজি হলেন অভেদানন্দজির ও গুরুর গুরু। হাস্যকর, বিজ্ঞানবিরোধী লেখা ছেপে তিনি বিজ্ঞানের নামাবলী গায়ে চড়িয়ে কিভাবে উদোর পিণ্ড বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে, বিজ্ঞানের পিণ্ডি চটকে ছেড়েছেন। সেসব উদাহরণ উনার বইতেই ছাড়িয়ে রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে “জাতিস্মর “বই এর দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৯৯৯, প্রকাশক -নবপত্র থেকে কিঞ্চিৎ নমুনা তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না। এই বইএর ১২ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, টেপরেকর্ডারে পরলোকগত আত্মার কণ্ঠস্বর ধরার কথা। আছে। এটা শোনা মাত্রই আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার এবং গাইড ' শ্রীমান পটলা 'র আন্তরিক ইচ্ছে নিগূঢ়ানন্দজি কিংবা উনার কোনো শিষ্যের সাথে একটিবার দেখা করে কোনো বিদেহী আত্মার কণ্ঠস্বর দ্বারা জেনে নেওয়া কে সেই কালপ্রিট যে তার দোকানের টালি সড়িয়ে অনেক টাকার মাল পত্র চুরি করে সটকে পড়েছে। জানিনা নিগূঢ়ানন্দজি এটা শুনলে ঠিক কি করতেন। এই অতীন্দ্রিয় শক্তিধর লেখক মহাশয় তাঁর “আত্মার রহস্য সন্ধান “বইএর ৭৭-৭৮ পৃষ্ঠায় যা লিখেছেন সেটার সংক্ষিপ্ত অর্থ হল- মানুষের দেহের লিঙ্গমূল ও গুহ্যদ্বারে নাকি এক চুম্বক ক্ষেত্র আছে। যোগ সাধনার বিশেষ শ্বাস -প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সেটাকে নিজের আয়ত্ত্বে আনতে পারলেই কেল্লাফতে। মাথা নাকি ব্লাডারের মত ফুলে গিয়ে যেকেউ মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব কে তুড়িমেরে শূন্যে ভেসে থাকতে পারে।
আমার একান্ত ইচ্ছে এমন একজন সাচ্চা, নিখুঁত সাধুমহারাজ কিংবা যোগগুরু এগিয়ে আসুন, এবং থিওরি ছেড়ে প্র্যাক্টিক্যালি কোনো কৌশল ছাড়াই শূন্যে ভেসে দেখান দয়াকরে (বাবা রামদেব চাইলে এগিয়ে আসতেই পারেন। উনাকে মন খুলে স্বাগতম জানাচ্ছি)। "আত্মার রহস্য সন্ধান”বই এর ১১১ পৃষ্ঠায় নিগূঢ়ানন্দজি জানিয়েছেন উনার কাছে যোগ শিখছেন এমন অনেকেই নাকি ' সূক্ষ্ম দেহে ভিন্ন ব্যাক্তি বা স্থান দর্শনের বর্ণনাও তাঁরা দিতে পারেন। লেখকের ব্যাক্তিগত এমন অভিজ্ঞতা আছে "। এই গ্রন্থের ১২৩ পৃষ্ঠায় স্বামী নিগূঢ়ানন্দজি জানিয়েছেন, "আত্মার পক্ষে পার্থিব সূক্ষ্ম- স্তরগুলোর অভিকর্ষ এড়িয়ে ভিন্ন গ্রহে উপস্থিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়"। স্বামীজি ঐ পৃষ্ঠাতে আরও জানিয়েছেন "লেখক ভিন্নগ্রহে বিভিন্ন মাত্রায় জীব দর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন"। মহাকাশ গবেষণার জন্য প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার,ইউরো,পাউন্ড খরচ না করে, গ্যালাক্সিতে প্রাণের অস্তিত্বের খোঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনেহয় স্বামী নিগূঢ়ানন্দজির সাহায্য নিলেই ভালো হবে। সময় এবং অর্থ দুইই বেঁচে যাবে আর আমরাও বিশ্ববাসী জানতে পারবো মহাবিশ্বের কোথায় কোথায় প্রাণের অস্তিত্ব আছে।
নিগূঢ়ানন্দজির মারাত্মক সব জ্ঞানের নজির উনার বইএর ছত্রেছত্রে সাজানো। যেমন তিনি 'জাতিস্মর' গ্রন্থের ৮৫ পৃষ্ঠাতে লিখেছেন “পি.সি.সরকার সকলের ঘড়ির কাঁটার সময় কমিয়ে দিতে পারেন কী করে? এ-বিষয়ে তাঁকেই জিজ্ঞাস্য।অধিমনোবিজ্ঞানে একে বলে সম্মোহন বা Pk (Psycho Kinesis)"। সত্যি মানতেই হচ্ছে নিগূঢ়ানন্দজির জ্ঞানের বড়োই অভাব। যার এত জ্ঞান, এত অলৌকিক, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা, যিনি বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্তকিছুর খবরাখবর জেনে ফেলেছেন তিনি পি.সি.সরকারের ঘড়ির কাঁটার সময় পিছিয়ে দেওয়ার আষাঢ়ে গল্প কে সত্যি বলে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। কারন ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়া শুধুমাত্র গল্পতেই সম্ভব, বাস্তবে কেউই এমন কোনো দিন ঘটায়নি এবং ঘটাতেও পারবেন না। চ্যালেঞ্জ রইলো। আর Pk বা Psycho Kinesis হচ্ছে আরেকটা বিজ্ঞানবিরোধী থিওরি। বিজ্ঞানের মুখোশের আড়ালে থাকা প্যারাসাইকোলজিস্ট রা যতই সিক্সথ সেন্স, সাইকো কাইনেসিস, দে'জা ভূ, ই.এস.পি.র গপ্পো বাজারে ছড়ুক না কেন সেসব কোনোদিনই বিজ্ঞানের দরবারে প্রমাণিত হবেনা।
না, এর বেশী লেখা মানেই স্বামী নিগূঢ়ানন্দজি কে তোল্লাই দেওয়া। সত্য জানতে প্রিয় পাঠক বন্ধুরাই প্রয়োজনীয় বই পত্র গুলো পড়ে নিয়ে নিজের যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে দেখুন। নিজেই বুঝবেন ' কুছ তো গড়বড় হ্যায় দয়া'।
আত্মা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেই আধ্যাত্মবাদের কথা উঠে আসবে। অভিধান জানাচ্ছে আত্মা সংক্রান্ত কিংবা আত্মা সম্বন্ধীয় মতবাদ ই হলো - আধ্যাত্মবাদ কিংবা অধ্যাত্মবাদ। এমন অনেকেই আছেন যারা অবশ্যই উচ্চশিক্ষিত এবং হয়তো বিজ্ঞানের কোনো শাখায় পড়াশোনাও করেছেন। সেইসব মানুষের ভেতর অনেকেই অন্ধবিশ্বাস এবং আজন্মলালিত বিশ্বাস কে আঁকড়ে ধরে আছেন আজও। এমন কথা অনেকেই বলে থাকেন যে 'ধর্মের সাথে কিংবা আধ্যাত্মবাদের সাথে বিজ্ঞানের কোনো দন্দ নেই'।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিজ্ঞান কি আদৌ ঈশ্বর,অলৌকিক, অতীন্দ্রিয় আত্মা কিংবা আধ্যাত্মবাদ কে সত্যিই মেনে নিয়েছে? এর এককথায় উত্তর হচ্ছে না, না এবং না। কারন,বিজ্ঞানের দরবারে কোনো কিছু তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন সেটা বিজ্ঞানের - পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত এই তিন সহজ - সরল ধাপে উপনিত হয় বা সাফল্য (পাশ) লাভ করে। এমনটা আগেও হয়েছে কল্পিত প্রস্তাবনা বা হাইপোথিসিস। অর্থাৎ কোনো ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে যদি মনে হয় (সন্দেহ জনক কিছু রয়েছে) গবেষণা চালানো প্রয়োজন, তাকেই বলা হয় ' হাইপোথিসিস'। এখান থেকেই বিজ্ঞানের ঘরে প্রবেশ করার পক্রিয়া শুরু হয়।
ঈশ্বর, আধ্যাত্মবাদ, অলৌকিক ইত্যাদি এখনও পর্যন্ত হাইপোথিসিস এ পা টাই রাখতে পারেনি, বাকি তিন ধাপ তো অনেক দুরের কথা। এখনও পর্যন্ত এমন কিছু ঘটনা ঘটেনি যা ইঙ্গিত করে ঈশ্বর,অলৌকিক অথবা আধ্যাত্মবাদ কে। এখনও সেই রকম কিছু ঘটেনি যার জন্য বিজ্ঞান পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখবে,তারপর আসবে একটা সিদ্ধান্তে। ঈশ্বর, অলৌকিক কিংবা আধ্যাত্মবাদের কোনো কার্যপ্রলাপ এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান কে প্রভাবিত করতেই পারেনি। তাই বিজ্ঞান আজও মাথা ঘামায়নি যে ঈশ্বর, অলৌকিক, অতীন্দ্রিয়, আত্মার অস্তিত্ব আদৌ আছে, নাকি নেই। ঈশ্বর, আত্মা ইত্যাদি সবটাই শুধুমাত্র মনোজগৎ এর কল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই নয়।
একদল ধর্মগুরু অথবা বিজ্ঞানী কিংবা নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যাক্তিরা (বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই কিন্ত বিজ্ঞানমনষ্ক,যুক্তিবাদী হওয়া যায়না। যুক্তিবাদী সাজা যায় কিন্ত হওয়া যায় না কারণ, এটা একটা হয়ে ওঠার ব্যাপার। যেটা সবাই পারে না। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা এবং জিজ্ঞাসু মন) যতই প্রচার করুক, যতই তত্ত্বকথা শোনাক না কেন “বিজ্ঞান ঈশ্বর, অলৌকিক, আত্মার অস্তিত্ব কে স্বীকার করে নিয়েছে “তবুও কোনোদিনই এটা প্রমাণিত হবে না বিজ্ঞানের দরবারে।
প্রাচীন ভারতীয় দর্শন যে মূলত নিরীশ্বরবাদী দর্শন ছিলো সেটাই হয়তো জানেন না আমজনতার একাংশ। বুদ্ধ, চার্বাক, মিমাংসা, মাধ্যমিক, জৈন ইত্যাদি নিরীশ্বরবাদী দর্শন। আমজনতা কে মিথ্যের জালে ভুলিয়ে রাখার প্রয়াস চলছে,চলবে। আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বহুদিন আগেই সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলে কিংবা আক্রমণ করেছিল বুদ্ধ এবং চার্বাক দর্শন। এছাড়া দে'জ পাবিলিশিং থেকে প্রকাশিত, প্রবীর ঘোষ এর লেখা “অলৌকিক নয়, লৌকিক “৪র্থ খণ্ডেও আত্মা, আধ্যাত্মবাদ এবং জাতিস্মরের স্ববিরোধীতা, বুজরুকি এবং ভণ্ডামো উপযুক্ত তথ্যসহ তুলে ধরা আছে। চাইলে কেউ পড়ে দেখতেই পারেন।
গৌতম বুদ্ধ ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই একজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী এবং অবশ্যই নিরীশ্বরবাদী মানুষ। তাঁর মুল চারটি সিদ্ধান্ত জানলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বুদ্ধের মূল চারটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে - (১) ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করা, (২) আত্মাকে ' নিত্য ' স্বীকার না করা, (৩) কোনও গ্রন্থ কে স্বতঃ প্রামাণ স্বীকার না করা, (৪) জীবন প্রবাহ কে স্বীকার করা। গৌতম বুদ্ধর মৃত্যুর পরে বৌদ্ধ ধর্ম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হীনজান এবং অপরটি মহাজান। দুঃখ এটাই, যে বুদ্ধ ছিলেন সম্পূর্ণরুপে নিরীশ্বরবাদী সেই বুদ্ধ কে আজ ঈশ্বর বানিয়ে বিষ্ণুর অবতার রুপে পূজো করা হচ্ছে। সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকা পড়লেই সেটা লক্ষ্য করা যায়,কারণ বুদ্ধ কে ঈশ্বর বনিয়ে, নানা অলৌকিক ব্যাপারে উনাকে জড়িয়ে ক্রমাগত প্রচারের কাজটা এই পত্রিকা করেচলেছে। বুদ্ধ মনে করতেন -”চিত্ত বিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান আর আত্মা একই বস্তু"। তিনি এটাও জানালেন “আত্মা বা চিত্ত বিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান যেহেতু শরীরেরই ধর্ম (এখানে ধর্ম অর্থে গুণ কেই বুঝিয়েছেন বুদ্ধ। যেমন আগুনের ধর্ম বা গুণ হচ্ছে দহন না জ্বলন) তাই শরীর বিনাশের সাথে সাথেই আত্মার ও বিনাশ ঘটে। দার্শনিক জগদীশ্বর সান্যাল তাঁর ' ভারতীয় দর্শন ' গ্রন্থে লিখেছেন - বুদ্ধদেব বলেছিলেন, জন্মান্তর বলতে চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ ধারণ করা বোঝায় না। জন্মান্তর অর্থে একটি জীবন থেকে আর একটি জীবনের উদ্ভব বোঝায়। গৌতম বুদ্ধের মতে নির্বাণ মানে দুঃখের বিনাশ কেই বোঝায়। এই নির্বাণ লাভ করেই সিদ্ধার্থ গৌতম ' বুদ্ধ ' হয়েছিলেন। যারা গৌতম বুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ জীবনী না পড়েই কিংবা বিকৃত জীবনী পড়েই চেঁচায় তাদের বোঝানো বেজায় মুশকিল। বুদ্ধকে বিকৃত করার খেলায় সামিল মনুবাদীদের একাংশ থেকে দার্শনিক বা চিন্তাবিদ ছাপ দেওয়া ব্যাক্তিরা। ওরা জানে এক এবং জানায় আরেক। একে ভণ্ডামি ছাড়া আর কিইবা বলা যায়। মনুবাদীদের বা ব্রাহ্মণবাদীদের দ্বারা শুদ্র বা দলিত মানুষের অত্যাচার চলেছে বহুযুগ ধরে, এই ধারা আজও অব্যাহত। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যাক সংবিধানের প্রণেতা বাবা সাহেব আম্বেদকর এর। উনি শুদ্রদেরকে সমাজে তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য এবং কট্টরপন্থী হিন্ধুত্ববাদীদের হাত থেকে হিন্দুধর্ম কে সরিয়ে আনতে এবং মানবিক গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অনড়,স্থবির হিন্ধুধর্ম নিজের স্থানে অটল থাকার কারণে ব্যার্থ হয়ে আম্বেদকর, ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে নাগপুরে ৫ লক্ষ নিম্নবর্গীয় বা দলিতকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দু উপাসনাধর্ম ত্যাগ করন এবং জাত-পাত হীন বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করেন।
'চার্বাক দর্শন' বস্তুবাদী দর্শন। এই দর্শন- ঈশ্বর, আত্মা, পরলোক, স্বর্গ- নরক, জন্মান্তর ইত্যাদি কে যুক্তির শানিত অস্ত্রের আঘাতে কেটে টুকরো টুকরো করে ছেড়েছিল। তাই ভাববাদী দর্শনপন্থীরা সজত্নে এড়িয়ে চলতেন চার্বাক দর্শন কে। এই কারণেই হয়তো চার্বাক কে লোকায়ত দর্শন আখ্যা দিয়েছিল সেযুগের ভাববাদী শিবিরের তাত্ত্বিক নেতা থেকে ম্যাক্সমুলার বা শঙ্করাচার্য প্রমুখরা। এই বস্তুবাদী বা লোকায়ত দর্শনে ' আত্মা বা চেতনা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম ব্যাতিত অন্য কিছুই মনে করেনা। এই বস্তুবাদী দর্শন থেকে সামান্য কিছু নির্যাস তুলে ধরছি, মুল সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করে। যেমন- -
(১) চৈতন্য রুপে আত্মার পাকযন্ত্র কোথা? তবে তো পিণ্ডদান নেহাতই বৃথা।
(২) ব্রাহ্মণ জীবিকা হেতু তৈরি শ্রাদ্ধাদি বিহিত। এছাড়া কিছুই নয় জেনো গো নিশ্চিত।।
(৩) যদি, শ্রাদ্ধকর্ম হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ। তবে, নেভা প্রদীপে দিলে তেল উচিৎ জ্বলন।।
শেষে একটা অপ্রিয় সত্য বলতে বাধ্য হচ্ছি। স্বামী অভেদানন্দ থেকে স্বামী নিগূঢ়ানন্দ'র মতন অনেকেই আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বই-পত্র লিখেছেন। স্বামী অভেদানন্দ কিংবা স্বামী নিগূঢ়ানন্দ আজ আমাদের ভেতর নেই। বহুদিন আগেই উনারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। একটা প্রশ্ন জেগেছে এইমূহুর্তে, এই দুজন বিখ্যাত স্বামীজির উচিৎ ছিল মৃত্যুর পরে যদি একটা জীবন থেকেই থাকে তাহলে সেটা জানানোর জন্য নিজেরাই বিদেহী আত্মা রুপে মর্তে এসে জানান দেওয়া। কিন্ত আজ পর্যন্ত ওনারা আত্মা রুপে মর্তে এসে কোনো রকমের প্রামাণ দেননি। দেননি ওপরে ঈশ্বর নামক কেউ সত্যিই আছে কিনা, তার স্বরুপ কি, নিরাকার নাকি সাকার ইত্যাদির "প্ল্যানচেটে আত্মাকে আনা সম্ভব”এই তত্ত্বে বিশ্বাসীরা,পরামনোবিজ্ঞানী, ভুত - প্রেতাত্মা গবেষক বা অনুসন্ধানকারীরা চেষ্টা করে একবার দেখতে পারেন, যদি অভেদানন্দজি কিংবা নিগূঢ়ানন্দজির বিদেহী আত্মাকে টেনে আনা সম্ভব হয়। তাহলে বিশ্বের তাবড় যুক্তিবাদী, ঈশ্বর এবং আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী মানুষের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যাবে আধ্যাত্মবাদ কে এবং আত্মা বলে বাস্তবিকই কিছু আছে সেটাও প্রামাণ হয়ে যাবে এই ফাঁকে।
পরিশেষে একটা মজার ঘটনা জানাই। মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষের ক্রমাগত যুক্তির আঘাতে পেরে উঠতে না পেরে, স্বামী অভেদানন্দজি রচিত ‘মরণের পারে’ গ্রন্থের আত্মা সংক্রান্ত অনেক আজগুবি, বিজ্ঞানবিরোধী তথ্য বা বক্তব্যে কে ছেঁটে ফেলে বর্তমানে বইটি প্রকাশ করছেন 'শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ'। হাতে গরম প্রমাণ পেতে উক্ত বইটি পড়ে মিলিয়ে দেখে নিতেই পারেন কেউ। এটা নিঃসন্দেহে বড় জয় যুক্তিবাদী মানুষের। জয় যুক্তিবাদ।
ঋণ স্বীকার : প্রবীর ঘোষ, শিবাশীষ বসু, রামকৃষ্ণ মন্ডল, উইকিপিডিয়া, কিছু প্রয়োজনীয় পত্র-পত্রিকা।