সমস্ত লেখাগুলি

সঙ্ঘ পরিবারের আসল চেহারা -
অভিষেক দে
May 20, 2025 | যুক্তিবাদ | views:3 | likes:0 | share: 0 | comments:0

অখণ্ড ভারত বা অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র আদতে সম্পূর্ণ ভাঁওতা। আসল কথাটি হচ্ছে অখণ্ড ব্রাহ্মণরাষ্ট্র। এই ব্যপারে The All India BAMCEF নামক সংগঠনের সভাপতি Waman Chindhuji Meshram জানিয়েছেন, “হিন্দুরাষ্ট্র মানে শাস্ত্র অনুযায়ী ব্রাহ্মণদের সমস্ত জায়গায় আধিপত্য। তাই ব্রাহ্মণরা কখনওই  ‘ব্রাহ্মণরাষ্ট্র’এর দাবি করে না। একটু ঘুরিয়ে হিন্দু রাষ্ট্রের দাবি করে।”


যুগে-যুগে ব্রাহ্মণেরা প্রচার করেছে তারা সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্বগুণসম্পন্ন। তারা সকল প্রকার দোষত্রুটির ঊর্ধ্বে। এক্ষেত্রে কিছু উদাহরণ দিলেই বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে। যেমন, চাণক্য বলেছেন, ব্রাহ্মণ যে অপরাধই করুক না কেন তাকে হত্যা করা বা শারীরিক দণ্ড দেওয়া চলবে না (সূত্র- অর্থশাস্ত্র ৪/৮/৯)। রামকৃষ্ণ দেবের মতে, ব্রাহ্মণ হলেই সব দোষ মাফ (সূত্র-শ্রীরামকৃষ্ণ দক্ষিণেশ্বর মন্দিরে ভক্তসঙ্গে / ১৩ পরিচ্ছেদ, ১৮৮৪,১৯শে সেপ্টেম্বর)। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ছাড়া শূদ্র এবং শূদ্রের মত অন্যান্য মানুষদের বেদ পড়ার কোনও অধিকার নেই (সূত্র- গীতা ১৮/৪১ এর শঙ্করভাষ্য)। 


আজকের ব্রাহ্মণ রাষ্ট্র থুড়ি অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্রের দাবীদারদের চিন্তাধারা কেমন সেটা জানতে একটু তলিয়ে দেখতে হবে আমাদের। ‘আরএসএস’ বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক-এর প্রতিষ্ঠা ১৯২৫ সালে। প্রতিষ্ঠাতা ড: হেডগেওয়ারের পরে এম. এস. গোলওয়ালকর আরএসএস-এর পরিচালক হন। গোলওয়ালকর ১৯৪০ সালে এই দায়িত্ব নেওয়ার পর ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত টানা ৩৩ বছর ‘আরএসএস’-এর পরিচালক এর দায়িত্ব সামলেছিলেন। 


১৯৩০-সালে সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সময় দেশবাসীকে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের তেরঙ্গা পতাকা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে সত্যাগ্রহসহ ব্রিটিশ বিরোধী সমস্ত আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে আহ্বান জানান কে. বি. হেডগেওয়ার। আরএসএসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা নাথুরাম বিনায়ক গডসেকে ‘খাঁটি’ দেশপ্রেমিক বলা চলে। জীবনে কোনওদিন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশ না নিলেও ১৯৪৮ সালের ৩০ জানুয়ারি গান্ধীজীকে হত্যা করে বিজেপির চোখে হিরো হয়ে যায়। এখন ভারতে হিন্দু জাতীয়তাবাদের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। তার নামে হচ্ছে পাঠাগার থেকে মন্দিরও।


‘হিন্দুরাষ্ট্র’ বই-এর লেখক এবং হিন্দুত্ব আইডিওলজির জনক বিনায়ক দামোদর সাভারকর। ইংরেজ সরকারের কাছে মুচলেকা দিয়ে (বিরোধীদের ‘মুচলেকা ম্যান’ আখ্যা পেয়েছেন) লেখেন যে তিনি আর কোনও দিনও ব্রিটিশ বিরোধী ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নেবেন না। দেশভক্তির কী আশ্চর্য নমুনা! 


১৭ ডিসেম্বর, ১৯৬০ সাল। গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তব্য দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ পেলেন আরএসএস-এর দ্বিতীয় সঙ্ঘচালক এম. এস. গোলওয়ালকর। সেখানে তিনি বলেন- “আজ ক্রস-ব্রিডিংয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা কেবল প্রাণীদের উপর করা হয়। কিন্তু মানুষের উপর এ জাতীয় পরীক্ষা করার সাহস আজকের তথাকথিত আধুনিক বিজ্ঞানীও দেখাননি।........যে কোনও শ্রেণির বিবাহিত মহিলার প্রথম সন্তান অবশ্যই নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণ দ্বারা জন্মগ্রহণ করা উচিত এবং তারপরে তিনি তার স্বামী দ্বারা সন্তানের জন্ম দিতে পারেন।”

পরবর্তী কালে ‘আরএসএস’-এর মুখপাত্র ‘অর্গানাইজার’ পত্রিকাতে ১৯৬১ সালের ২ জানুয়ারী ৫ নম্বর পৃষ্ঠাতে এই খবরটি ছাপা হয়েছিল। উনি আরও বলেছিলেন, “হিন্দুরা ব্রিটিশদের সাথে লড়াই করে তোমাদের শক্তি খরচ না করে আসল শত্রু মুসলমান, খ্রিস্টান আর কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে লড়াই করো।”











এবারে বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদের মুখ যোগী আদিত্যনাথের কথা কিছু জানাই। উনি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ২০১৭ সালের ১৯ মার্চ শপথ গ্রহণ করেন। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর (NCRB) তথ্যানুযায়ী যোগী আদিত্যনাথ মুখ্যমন্ত্রী হওয়া ইস্তক উত্তরপ্রদেশ দলিত ও নারী নির্যাতন চরমে যার উল্লেখ প্রথমে করেছি। এনার বক্তব্য ও আচরণ দেখলে মনেই হবে না ইনি কোনও অহিংসবাদী, শান্তসৌম্য যোগী, বরং উগ্রভাবাপন্ন, ফ্যাসিবাদী একজন ভোগী বলাই শ্রেয়। অনেকে ওনাকে উত্তর কোরিয়ার কিম উন জং-এর সাথেও তুলনা করেন। কারণ, যোগী আদিত্যনাথ-এর আপন দেশে আইন কানুন বড়ই  সর্বনেশে। ০১/১০/২০২০-আনন্দবাজার অনলাইন থেকে জানা যাচ্ছে, যোগী আদিত্যনাথের মুখ্যমন্ত্রীত্বের প্রথম দু’মাসে উত্তরপ্রদেশে ৮০৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৭ সালের জুলাই। যোগী সরকারের বয়স তখন মাত্রই চার মাস। আগস্ট ২০২০ তে অগস্টে প্রকাশিত NCRB রিপোর্ট জানাচ্ছে, ২০১৯ সালে উত্তরপ্রদেশে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ৫৯,৮৫৩। যা দেশের মধ্যে সর্বাধিক। এর মধ্যে ধর্ষণের মামলার সংখ্যাই ৩,০৬৫টি। অর্থাৎ গড়ে দৈনিক প্রায় ১১ জন মহিলা ধর্ষিতা হন ওই রাজ্যে। রিপোর্ট বলছে, এদের মধ্যে ৩৪ জনকে ধর্ষণের পর খুন করা হয়েছে। ২০১১ সালে, ডকুমেন্টারি ফিল্ম জাফরান যুদ্ধ - হিন্দু ধর্মের র‌্যাডিকালাইজেশন ও ঘৃণ্য বক্তৃতার মাধ্যমে উত্তরপ্রদেশে সাম্প্রদায়িক বিভেদ প্রচার করার জন্য আদিত্যনাথকে অভিযুক্ত করেছিল (“How Yogi Adityanath Made it to Where He Is” ‘The Wire’ 09/02/2019)।


বরাবরই বিতর্কের কেন্দ্রে থেকেছেন উত্তরপ্রদেশের গোরখপুরের গোরখনাথ মঠের মুখ্য পুরোহিত বা মোহন্ত যোগী আদিত্যনাথ। ছাত্রাবস্থা থেকেই এই যোগী ছিল জাতপাত ও বর্নভেদের ঘোর সমর্থক। সাথে চরমতম নারী ও মুসলিম বিদ্বেষী। মুসলিম নারী সম্পর্কে তার বিস্ফোরক মন্তব্য যা ২০১৪ সালে করেন – “কবর থেকে তুলে মুসলিম মেয়েদের ধর্ষন করা হবে।” এখনও পর্যন্ত যোগীর বিরুদ্ধে ৬২ টি দাঙ্গা বাঁধানোর অভিযোগ, ১৭ টি খুনের অভিযোগ (যার মধ্যে ৮ টি দলিত পরিবারকে খুন) রয়েছে (সূত্র- উত্তরপ্রদেশ প্রশাসনিক রিপোর্ট -- ০৩/০২/১৬, দ্য টেলিগ্রাফ পত্রিকা)। দলিতদের প্রতি আদিত্যের ভাবনা অতি ভয়ংকর। “দলিতরা দাস হয়েই জন্মেছে, তাই দাসত্ব করাই তাদের পবিত্র কর্তব্য” (সূত্র- ১৯৯৫/৮/৩ - টাইমস অফ ইন্ডিয়া, লক্ষ্ণৌ সম্মেলনের বক্তব্য)। দলিত নারী সম্পর্কে তার বক্তব্য- “দলিত নারী ধর্ষন করা পাপ নয়, কারণ তার শরীর অপবিত্র হলেও যোনি অপবিত্র নয়”(২০০১/১/১৩, গোরক্ষনাথ মঠে বসে বলেন যা বর্তমান পত্রিকায় “সন্ন্যাসাশ্রম ও আদিত্যের মানব ভাবনা” শিরোনামে প্রকাশিত)। যোগীবাবুর অনুপ্রেরণা পেয়েই হয়তো ২০২০ সালে আমরা দেখেছি মণীষা বাল্মীকির ধর্ষণকান্ড এবং প্রমাণ লোপাট করতে রাতের অন্ধকারে ধর্ষিতার দেহ জ্বালিয়ে দেওয়ার ঘটনা। 


রাজনীতিতে অংশ গ্রহন করা তথা নারী সংরক্ষন নিয়ে বিজেপি পশ্চিমি প্রভাবে নরম মনোভাব দেখাচ্ছে বলে রীতিমত খোলা চিঠি দিয়ে সাংসদ পদ আর দল থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন ২০১৫ সালে। তিনি সেই খোলা চিঠিতে লিখেছিলেন- “নারী আর পুরুষকে মোটেই সমান করে তৈরি করা হয়নি। মেয়েদের ঠাঁই হলো রান্ন ঘরে, পুরুষদের দেখাশুনা করার জন্য।” ২০১০ সালে যখন মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষন বিল পাশ করার কথা ওঠে, তখন তিনি বলেন- “আমাদের হিন্দুশাস্ত্রে (পড়ুন মনুসংহিতা) নারী স্বাধীনতার কথা বলা হয়নি, নিয়ন্ত্রনের কথা বলা হয়েছে। মেয়েদের সত্যি সত্যি স্বাধীনতার প্রয়োজন নেই। এতে ওরা স্বেচ্ছাচারী হয়ে সমাজ ধ্বংস করবে।” 


বিজেপির এই অখণ্ড ভারত বা হিন্দুরাষ্ট্র (পড়ুন ব্রাহ্মণ রাষ্ট্র) গঠনের তীব্র ইচ্ছে যা উচ্চবর্ণের আদেশ মেনেই সেটি করবার মূল উদ্দ্যেশ্য পুরোপ্রদেশে মনুসংহিতার শাসন লাগু করা। এই মনুসংহিতা বা মনুস্মৃতিতে রয়েছে মোট ২,৭০০টি শ্লোক এবং ১২ টি অধ্যায় যা খুব মন দিয়ে পড়লেই বোঝা যায় এতে ছত্রে ছত্রে আছে নারী ও শুদ্রদের প্রতি নির্যাতন ও বিদ্বেষের স্পষ্ট সুর। ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর  বাবাসাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকরের নেতৃত্বে ‘মনুস্মৃতি’ পুড়িয়ে দিয়ে প্রতিবাদ বিক্ষোভ দেখানোর ঘটনা যা প্রমাণ করে। বিজেপি, আরএসএস এর প্রিয় গোলওয়ালকর, সারভারকার, মোহন ভাগবত কিংবা যোগী আদিত্যনাথ এই মনুসংহিতার শাসনকেই প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধপরিকর। এই হিন্দুধর্মীয় আইনি শাসন গ্রন্থকে অস্ত্র করে ফের তারা সতীদাহপ্রথা, স্তনকর, বাল্যবিবাহ, নির্বিচারে দলিত হত্যা, নারীকে শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে গৃহবন্দী রাখা, দেবদাসী প্রথা, বিধবাবিবাহ রোধ ইত্যাদি করে মধ্যযুগ ফিরিয়ে আনতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ তাই তাদের ব্রাহ্মণরাষ্ট্র থুড়ি অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র চাইই চাই। 


হিন্দুধর্মে জাতপাত এর স্রষ্টা জৈবলি, উদ্দালক ও আরুণি এবং আরুণি শিষ্য যাজ্ঞবল্ক্য যাদের উত্তরসূরি সঙ্ঘ পরিবারের সদস্যরা  হিন্দুধর্মের সবচেয়ে বড় হাস্যকর দিক হচ্ছে হিন্দুদের চারবর্ণে বিভক্ত করবার পরে এখন মোহন ভাগবত থেকে নরেন্দ্র মোদীর গলায় শোনা যাচ্ছে- ‘সকল হিন্দু এক হও।’ যদি এক হওয়াই লক্ষ্য ছিল তাহলে ভাগাভাগি কেন? পৃথিবীর অন্যান্য দেশে দাস-বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে দেখেছি কিন্তু ভারতে জ্বলতে দেখিনি। এই মহান দেশে দাস-বিদ্রোহের আগুন জ্বলতে দেয়নি জন্মান্তরবাদের জলকামান। যে ধর্ম একশ্রেণীর মানুষকে শ্রেষ্ঠ আর একশ্রেণীকে অস্পৃশ্য, অচ্ছুৎ করে রাখে সে ধর্ম, ধর্ম নয় বরং ক্রীতদাস বানিয়ে রাখার ষড়যন্ত্র। 


গণদাবী পত্রিকায় (৭০ বর্ষ ৩৬ সংখ্যা ২৭ এপ্রিল, ২০১৮) একটি গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হয়েছে। “জোর করে ধর্মান্তরিত করার অভিযোগ বরাবরই বিজেপি করে থাকে৷ এবার যাতে সেই অভিযোগ তুলতে না পারে সে জন্য উক্ত দলিতরা স্বেচ্ছায় বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণের ফর্ম পূরণ করে জেলাশাসকের দপ্তরে জমা দিয়েছেন৷ স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, দলিত অপমানের প্রতিবাদে এই ধর্ম পরিবর্তন। অর্থাৎ দলিতদের কাছে এই ধর্মান্তর আসলে প্রতিবাদ আন্দোলনের একটা রূপ।” এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখা ভালো, বাবা সাহেব আম্বেদকর, ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর নাগপুরে প্রায় পাঁচ লক্ষ নিম্নবর্গীয় বা দলিত মানুষকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দুধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধধর্মকে গ্রহণ করেছিলেন। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে অক্টোবর ২০২২ সালে উত্তরপ্রদেশের লখনৌতে যেখানে ১৫ হাজার দলিত,আদিবাসী মানুষেরা, হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করেছে।


পরিশেষে, অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র বা অখণ্ড ভারত কিংবা অখণ্ড ব্রাহ্মণ রাষ্ট্রের কট্টর সমর্থকদের উদ্দ্যেশ্যে কিছু কথা জানিয়ে লেখার ইতি টানবো। 

কট্টর ইসলামিক দেশ হিসেবে চিহ্নিত ‘সুদান’ তাদের রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’কে ত্যাগ করে “ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র”তে পরিণত হচ্ছে। বাস্তব এটাই যে, আধুনিক পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রই কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পরিণতিতে পৌঁছবে, আজ, কাল কিংবা পরশু। এটাই ভবিতব্য। একটি রাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু জনগণের ধর্ম যা-ই হোক না কেন, আধুনিক পৃথিবী যেহেতু গণতন্ত্রের, ধর্মমুক্তির, যুক্তিবাদ, বিজ্ঞান, বিজ্ঞানমনষ্কতার। তাই কেউ যদি গায়ের অথবা গলার জোরে এসব অস্বীকার করে, তাহলে অস্তিত্ব-সংকট তারই। মোটেই গণতন্ত্র, ধর্মমুক্তি, বিজ্ঞানমনষ্কতা অথবা যুক্তিবাদের নয়। আমাদের প্রতিবেশী, ছোট্ট এবং গরিব দেশ নেপাল এই সত্য কথাগুলো অনেক আগেই বুঝেছিল বলেই বেশ কয়েক বছর আগে হিন্দুরাষ্ট্র (হ্যাঁ, পৃথিবীর একমাত্র হিন্দুরাষ্ট্র ছিল নেপাল) থেকে ধর্মনিরপেক্ষতায় আশ্রয় নিয়েছিল। ভারতকেও একদিন এই পথেই আসতে হবে। হবেই।


ডিরোজিও: যে ঝড়ের পাখিকে প্রয়োজন আজও -
অভিষেক দে
May 19, 2025 | জীবনী | views:6 | likes:0 | share: 0 | comments:0

শিবনাথ শাস্ত্রী তাঁর “রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ” গ্রন্থে লিখেছেন- “চুম্বক যেমন লৌহকে  আকর্ষণ করে তেমনি তিনিও তাঁর বালকদিগকে আকর্ষণ করিতেন”। সেই চুম্বকটির আজ জন্মদিন। উনি হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। ওনার জন্ম ১৮ এপ্রিল, ১৮০৯। 

ডিরোজিও একজন ইউরেশীয় কবি, মুক্তমনা চিন্তাবিদ এবং শিক্ষক। তবে দুঃখের বিষয় খুবই অল্পবয়সেই এই তরুণ প্রাণ অকালে শেষ হয়ে যায় কলেরা রোগে (২৬ ডিসেম্বর, ১৮৩১)। অনেকেই হয়ত জানেন না, তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং বিশিষ্ট অভিনেতা উৎপল দত্তের পরিচালনায় ১৯৮২ সালে ডিরোজিয়োর অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তাঁর জীবনের শেষ দুই বছরকে ভিত্তি করে “ঝড়” নামক একটি সিনেমা তৈরি হয়। “ঝড়” সিনেমাটির মোট ১২ টি পার্ট আছে।

ডিরোজিও কলকাতার এন্টালি-পদ্মপুকুর অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ফ্রান্সিস ডিরোজিও ছিলেন একজন খ্রিস্টান ইন্দো-পর্তুগিজ অফিস কর্মী এবং তাঁর মাতা ছিলেন সোফিয়া জনসন ডিরোজিও। 

ডিরোজিও, ডেভিড ড্রুমন্ডের ধর্মতলা অ্যাকাডেমি স্কুল থেকে পড়াশোনা করেছিলেন, যেখানে তিনি ছয় থেকে চোদ্দো বছর পর্যন্ত একজন ছাত্র ছিলেন এবং ১৮২৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে ১৭ বছর বয়সে ডিরোজিও নতুন হিন্দু কলেজের ইংরেজি সাহিত্য এবং ইতিহাসের শিক্ষক হিসেবে নিয়োজিত হয়েছিলেন।

তখনকার সময়ে ইয়ং বেঙ্গলের তরুণেরা ছিলেন বেশ চঞ্চল প্রকৃতির। তাঁদেরকে সন্ধ্যা বেলায় জোর করে ঠাকুর ঘরে নিয়ে গেলে সেখানে বসে ধর্মগ্রন্থ পড়বার পরিবর্তে হোমার, ইলিয়ডের বই থেকে উদ্ধৃতি পাঠ করতেন। দেবদেবীকে প্রণাম করার পরিবর্তে বলতেন, ‘গুড মর্নিং, ম্যাডাম/স্যার। দিনের বেলা লোকজনকে দেখিয়ে গোমাংস ও মুসলিমদের হাতেগড়া রুটি খেয়ে উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের খাদ্যবিধিতে আঘাত করতেন। হিন্দুদেবী কালীকে নিয়ে ছড়া কাটতেন,  হাতের নাগালে কোনও ব্রাহ্মণ পেলে “আমরা গরু খাই গো” বলে উত্যক্তও করতেন। এভাবে হিন্দুদের জাত্যাভিমানে বা বলা ভালো তথাকথিত ধর্মবিশ্বাসে আঘাত হানার জন্য যত ধরনের দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় আসতো, তার সবটুকুর প্রয়োগ তাঁরা করতেন। 

ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে ডিরোজিও তাঁর অনুগামীদের অর্থাৎ হিন্দু কলেজের ছাত্রদের নিয়ে যে সংগঠন গড়ে তোলেন সেটি, “ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গ” নামে পরিচিত। এই সংগঠনের উদ্দ্যেশ্যে ছিল- (১) তরুণপ্রজন্মের মধ্যে যুক্তিবোধ, বিজ্ঞানমনষ্কতার বিকাশ ঘটানো। (২) নারীদের উচ্চশিক্ষিত গড়ে তোলা, (৩) সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস এবং জাতপাত ইত্যাদির বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা এবং এইসকল বিষয়ে তাঁর ছাত্রদের মধ্যে অনুসন্ধিৎসা ও জিজ্ঞাসু মনন গড়ে তোলা, (৪) স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের বিকাশ ঘটানো (৫) সংবাদপত্রের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন ইত্যাদি। এইপ্রসঙ্গে জানাই, ১৮২৮ সালে কলকাতার মানিকতলা এলাকায় “অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন” প্রতিষ্ঠা হয়েছিল সমাজের কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস ইত্যাদির বিরুদ্ধে কাজকর্মের জন্যেই।

ডিরোজিও তার মাত্র ২২ বছরের জীবনে এমন বেশকয়েকটি কাজ করে গেছেন যা সত্যি অবাক করার মতন। জীবনে চূড়ান্ত আর্থিক এবং সামাজিক অবরোধের মধ্যে পড়েও তিনি যতদূর এগোতে পেরেছিলেন তা অকল্পনীয়। এখানে প্রশ্ন উঠতে পারে ডিরোজিও কি সত্যিই যুক্তিবাদী ছিলেন বা ওনাকে কে কি যুক্তিবাদী, বিজ্ঞানমনষ্ক বলা যাবে? 

এইপ্রশ্নের উত্তরে কিছু খোলামেলা আলোচনা করা যেতে পারে, যেমন- পৃথিবীতে এমন কেউই নেই যে বা যিনি সম্পূর্ণ দোষত্রুটি মুক্ত। তাই সমালোচনার ঊর্ধেও কেউ নন। কোন মানুষকে সঠিক বিচার করতে গেলে দেশ, কাল, সামান্যই পরিস্থিতি এরূপ বিবিধ বিষয় বিবেচনা করতে হয়।

ডিরোজিও যেসময় জন্মেছিলেন তখন পরাধীন ভারতে সেই সময় কারো পক্ষে কতটুকুই বা বিজ্ঞানমনস্ক বা আরও ভালোভাবে বললে সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী হওয়া সম্ভব ছিল?তবে ডিরোজিও নিজ সময়ের থেকে কয়েক যোজন এগিয়ে ছিলেন। আক্ষরিক অর্থেই তিনি তার পারিপার্শ্বিক সমাজে চিন্তা, চেতনার, বিজ্ঞানমনস্কতার এমন এক প্রচন্ড ঝড় তুলেছিলেন যাকে সামাল দিতে বেসামাল হয়েছিল তৎকালীন উচ্চবর্ণের হিন্দু সমাজ। এইজন্যই কি তিনি শ্রদ্ধার পাত্র হতে পারেন না?  ডিরোজিও ছিলেন খ্রিস্টান পরিবারের সন্তান

 গির্জা ও খ্রিস্টধর্ম সম্পর্কে তাঁর অভিমতের কারণে তাঁর মৃত্যুর পরে পার্কস্ট্রিটের গোরস্থানে তাকে সমাহিত করতে বাধা দেওয়া হলে গোরস্থানের ঠিক বাইরে তাকে সমাহিত করা হয়।

ইয়ংবেঙ্গল বা নব্যবঙ্গীয় গোষ্ঠীর সদস্যগণ ছিলেন  রামতনু লাহিড়ী, রসিককৃষ্ণ মল্লিক, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, দক্ষিণারঞ্জন মুখােপাধ্যায়, প্যারীচাঁদ মিত্র,লালবিহারী দে, মাধবচন্দ্র মল্লিক, তারাচাঁদ চক্রবর্তী, শিবচন্দ্র দেব, কিশোরী চাঁদ মিত্র, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রাধানাথ শিকদার, কাশীপ্রসাদ প্রমুখরা। ডিরোজিওর অকাল মৃত্যুর পরে বহু ডিরোজিয়ান অধঃপতিত হয়ে আবার হিন্দুয়ানী, বাবু কালচারের চোরাস্রোতে ডুবে গিয়েছিল যদিও তার দায় অবশ্য ডিরোজিওর হতে পারেনা। 

এখানে একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৮৮২ সালে গড়ে ওঠে “Bengal Theosophical Society” যার সভাপতি হয়েছিলেন একদা ডিরোজিয়ান পন্থী, বুদ্ধিজীবী, যুক্তিবাদী হিসেবে চিহ্নিত প্যারীচাঁদ মিত্র। সংগঠনটির সহ-সভাপতি ছিলেন দ্বিজেন্দ্রলাল ঠাকুর ও শ্যামাশংকর রায় সহ অনেকেই যার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন আইরিশ রমনী, থিওসফিস্ট আনি বেশান্ত যিনি ১৮৯৩ সালে ভারতে আসেন এবং সাড়াজাগিয়ে প্রেতচর্চা শুরু করেন। 

ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা যে সামাজিক ও ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিল তা ডিরোজিওর মৃত্যুর পরও সক্রিয় ছিল। কিন্তু ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের সাফল্য ছিল খুবই সামান্য। ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন শেষপর্যন্ত ব্যর্থ হয়। বিভিন্ন পণ্ডিত ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলনের বিভিন্ন ত্রুটি-বিচ্যুতি, সীমাবদ্ধতা ও ব্যর্থতার কারণ উল্লেখ করে জানিয়েছেন- 

(১) নেতিবাচক ভাবাদর্শ: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সমস্ত কর্মসূচিই ছিল নেতিবাচক। তাঁদের কোনো গঠনমূলক কর্মসূচি ছিল না। হিন্দুধর্ম সম্পর্কে সবকিছু না জেনেই তারা এই ধর্মের বিরোধিতায় উগ্রভাবে সোচ্চার হন। অথচ পাশ্চাত্য সভ্যতা সম্পর্কেও তাঁদের কোনোও স্বচ্ছ ধারণা ছিল না। তাদের এই কালাপাহাড়ি মনোভাবের জন্য হিন্দুসমাজ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

(২) জনসমর্থনের অভাব: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের আন্দোলনকে সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারেননি। ড. সুমিত সরকার বলেছেন যে, মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী অংশ ছাড়া বাঙালি সমাজের বৃহত্তর অংশের ওপর ইয়ং বেঙ্গল মতাদর্শের কোনোও প্রভাব পড়েনি।” অভিজাত পরিবারের শহরের কিছু তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে এই আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল।

(৩) সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠীর অনেকেই ইংরেজ কোম্পানির সহযোগী হিসেবে বিলাসবহুল জীবনযাত্রা অতিবাহিত করেন। সমাজের সাধারণ খেটে খাওয়া কৃষক শ্রমিকের সঙ্গে তাঁদের কোনোও যোগাযোগ ছিল না।

(৪) উগ্রতা: ইয়ং বেঙ্গল গ‌োষ্ঠীর সদস্যদের উগ্র ও অতি বিপ্লবী কার্যকলাপ সমাজে আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিল। তাই কলকাতার এলিটিস্ট সমাজে এবং পত্রপত্রিকার মধ্যেই তাদের কার্যকলাপ সীমাবদ্ধ ছিল। ঐতিহাসিক ডেভিড কফ তাঁদের ভ্রান্ত পুঁথি-পড়া বুদ্ধিজীবী বলে অভিহিত করেছেন।

(৫) দরিদ্রদের প্রতি উদাসীনতা: ইয়ং বেঙ্গল গোষ্ঠী দেশের দরিদ্র কৃষক ও শ্রমিকদের দুরবস্থা ও সমস্যা সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন ছিলেন। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে সৃষ্ট কৃষকদের দুর্দশা এবং কুটিরশিল্প ধ্বংসের ফলে দরিদ্র সাধারণ মানুষের আর্থিক দুর্দশা থেকে মুক্ত করার কোনোও উদ্যোগ তারা গ্রহণ করেননি।

(৬) মুসলিম-বিচ্ছিন্নতা: ইয়ং বেঙ্গল আন্দোলন শুধু হিন্দু সমাজের সংস্কার নিয়ে চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত ছিল। মুসলিম সমাজের সংস্কার নিয়ে গোষ্ঠীর সদস্যরা কোনোও চিন্তাভাবনা করেননি।

(৭) সংস্কারবিমুখতা: ডিরোজিওর মৃত্যুর পরবর্তীকালে তাঁর অনুগামীদের অনেকেই সংস্কারবিমুখ হয়ে সংস্কার কর্মসূচি থেকে নিজেদের সরিয়ে নেয়। অনেকে সরকারি চাকরি বা ব্যাবসায় মনোযোগ দিয়ে নিজেদের সংসার জীবনে উন্নতির চেষ্টা করেন। রসিককৃষ্ণ মল্লিক, মাধবচন্দ্র মল্লিক, গোবিন্দচন্দ্র বসাক প্রমুখ ডেপুটি কালেক্টর এবং কিশোরীচাঁদ মিত্র ও শিবচন্দ্র দেব ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হন। 

পরিশেষে জানাতে চাই, এই ক্ষণজন্মা মানুষটির আজ বড়ই প্রয়োজন। যে ঝড়ের বেগে আসবেন এবং ভেঙ্গেচুরে একাকার করে দিয়ে যাবে সমস্ত অন্ধভক্তি, উগ্রদ্বেষপ্রেম, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, জাতপাত, বিদ্বেষের রাজনীতি। আজ বিশ্বজোড়া অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটা সংঘর্ষ খুবই জরুরি। তারপরেই হবে নির্মাণ, একটা সুস্থ, সুন্দর সমাজের। 

প্রসঙ্গ: ড্রাগস ও ম্যাজিক রেমেডিজ আইন এবং... -
অভিষেক দে
Nov. 26, 2024 | কুসংস্কার | views:888 | likes:0 | share: 0 | comments:0

গত ১৯/১২/২০২২ -এ সন্ধে ০৭:০০ থেকে রাত ০৯:৩০ পর্যন্ত ছিলাম অনলাইন আড্ডায় যেখানে একটি বিজ্ঞান সংগঠনের কয়েকজন তরুণ-তরুণী, আইনি বিশেষজ্ঞ, ও অভিজ্ঞ বয়স্করা যুক্ত ছিলেন। আলোচনার মূল বিষয় ছিল, The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954, এবং The Drugs and Cosmetic Act 1940 (Amendment 2020)। আলোচনা হয়েছে তুমুল জমজমাট। সেসবই সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরলাম।


ভারতীয় পার্লামেন্ট কর্তৃক গৃহীত আইন "The Drugs and Magic Remedies (objectionable advertisement) Act 1954" যা ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং ১ মে ১৯৫৪ সালে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যায় দ্বিতীয় অংশের প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত হয়। এই আইনটি ৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে ভারত সরকারের Ministry of Health and Family Welfare দ্বারা Amendment হয়েছে। অন্যদিকে, "The Drugs and Cosmetics Act 1940" যার শেষ Amendment হয়েছে ১৫ ডিসেম্বর ২০২০ তে। 


উক্ত দু’টি আইনানুসারে মন্ত্র-তন্ত্র, রেইকি, ম্যাগনেটোথেরাপি, জেমথেরাপি, তাবিজ-কবজ, রত্নপাথর, দৈব শক্তি, অলৌকিক ক্ষমতা বা জাদুশক্তি ইত্যাদির দ্বারা কোনও রোগ সারানোর দাবী আইনত অপরাধ। কোনও ওঝা, গুণিন, জানগুরু, সরকারি রেজিস্ট্রেশনবিহীন ভুয়ো ডাক্তার কিংবা প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসক (MBBS), অলৌকিক ক্ষমতাধর, দৈব চিকিৎসক, জ্যোতিষী, তান্ত্রিক ইত্যাদিরা এই আইন ভাঙলে অর্থাৎ রোগমুক্তির দাবী বা রোগ সারানোর প্রচার করবার জন্য রয়েছে ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা বা সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে আজীবন কারাদণ্ডের বিধান অথবা জেল ও জরিমানা দুটোই। 


এইখানে জানিয়ে রাখা ভালো, ২৮ নভেম্বর ২০০১ সালে দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি.সি.প্যাটেল এবং বিচারপতি এ.কে. সিকরি-র ডিভিশন বেঞ্চ কেন্দ্রীয় সরকারকে নোটিশ পাঠিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অলৌকিক ক্ষমতা বলে অসুখ বা কোনও সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখালে জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, বিজ্ঞাপনদাতা ও বিজ্ঞাপন প্রকাশক প্রচার মাধ্যমের বিরুদ্ধে যেন "The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954" অনুসারে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়। সে খবরের সংক্ষেপসার ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ২২ জুন ২০০৩ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রক জানিয়েছে - রেইকি বা স্পর্শ চিকিৎসা যাঁরা করেন, তাঁরা নিজের নামের আগে 'ডাক্তার' শব্দটা কোনওভাবেই ব্যবহার করতে পারবেন না। কারণ এই চিকিৎসা পদ্ধতির কোনও সরকারি স্বীকৃতি নেই। স্বাস্থ্যমন্ত্রক স্পষ্ট করে এটাও জানিয়েছে যে, রেইকি সহ জেম থেরাপি, কালার থেরাপি, ম্যাগনেটোথেরাপি, আরোমা থেরাপি, মিউজিক থেরাপি ইত্যাদি তথাকথিত প্রতিটি চিকিৎসা পদ্ধতিই বেআইনি এবং এইসব পদ্ধতি শেখানো কিংবা প্রয়োগকারী ব্যক্তি কোনও ভাবেই নিজের নামের আগে 'ডাক্তার' শব্দটাকে ব্যবহার করতে পারবেন না।


১৯ মার্চ ২০০৯ সালে ভারত সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ দপ্তর একটি নোটিশ জারি করে [GSR 884 (E)] The Drugs and Cosmetics Act (1940) Amendment করেছিল। সেই নোটিশে জানানো হয়েছে, প্রতিটি ওষুধের ওজন, আয়তন, উপাদান সমূহের পরিমাণ ওষুধের লেবেলের গায়ে না সাঁটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে গণ্য হবে। কোনও ওষুধ সেবনের ফলে রোগীর মৃত্যু বা আশঙ্কাজনক ক্ষতি হলে ওষুধ প্রস্তুতকারকের শাস্তি হিসেবে আজীবন কারাদন্ড পর্যন্ত হতে পারে ও দশ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানাও হতে পারে। এই আইনে "cosmetics" দ্রব্যাদিও পড়ছে এবং যা "ISI Standard" এর মান দ্বারা নির্ধারিত হওয়ার পর বাজারে বিক্রি করা যাবে। উক্ত দু’টি আইনে, ওষুধ বা 'ড্রাগ' বলতে বোঝানো হয়েছে, মানব শরীরে যা কাজ করে বলে দাবি করা হবে যেমন তাবিজ-কবজ, মাদুলি, যাগ-যজ্ঞ ইত্যাদি অনেক কিছুই যা কিন্তু ড্রাগের সংজ্ঞায় পড়ছে।


The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 আইনের প্রথম সংশোধন হয় ১৯৬৩ তে। এই আইনে 9(A) ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই আইন ভঙ্গকারীদের 'Cognizable Offence' হিসেবে গন্য করা হবে। অর্থাৎ কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের না করলেও পুলিশ কোনও ভাবে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রাথমিক জানার ভিত্তিতে কোনও অভিযুক্তকে Warrant ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে (Notwithstanding anything contained in The Code of Criminal Procedure 1898 an Offence Punishable under this Act shall be Cognizable)। 


আগে Drugs and Magic Remedies Act ভঙ্গকারীদের অপরাধ ছিলো 'Non-Cognizable' অর্থাৎ এক বা একাধিক ব্যক্তিকে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করতে হত। পুলিশ সরকারের তরফ থেকে অভিযোগকারীর পক্ষে অভিযুক্তর বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করতেন। আদালত অভিযুক্তর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বা ওয়ারেন্ট দায়ের করলে তবেই পুলিশ অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করতে পারতেন।

এই উল্লিখিত আইন ভাঙ্গাটা যেহেতু Non-Cognizable অপরাধ বলে 1963 সালে আইন সংযোজনের আগে পর্যন্ত গণ্য করা হত, তাই আদালত অভিযুক্তের বাসস্থল কিংবা ব্যবসা কিংবা চাকরিস্থলে থানা মারফত অভিযুক্তকে সমন পাঠাতেন। সমন অর্থাৎ আদালতের নির্দেশ। যাতে লেখা থাকে কবে, কখন, কোন আদালতে হাজিরা দিতে হবে। যেহেতু উল্লেখিত এই আইন ভাঙ্গাটা Criminal Offence বা ফৌজদারি অপরাধ তাই অভিযুক্তকে আদালতে হাজির হয়ে জামিন নিতে হত।


কোনও জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, ওঝা, জানগুরু ইত্যাদি বুজরুক প্রতারকের বিরুদ্ধে  Magic Remedies আইন ভেঙ্গেছে বলে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করার পরও কোনওও বিশেষ কারণে পুলিশ নিরব দর্শক থাকতেই পারেন। তখন আপনি অভিযোগকারী হলেও পুলিশের কাছে অভিযোগ করার প্রমাণপত্রের ভিত্তিতে (যেমন ডাইরি নং অথবা লিখিত অভিযোগ গ্রহণের থানার সিলমোহর ও স্বাক্ষর করা অভিযোগপত্র) আদালতে মামলা করা যায়। একে 'Complain Case' বলে। এই মামলার ভিত্তিতে আদালত সামনস্ পাঠাবেন অভিযুক্তর কাছে। অভিযুক্ত আদালতে হাজির হয়ে জামিন নেবেন। সমন অগ্রাহ্য করলে আদালত অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার করার জন্য পুলিশকে আদেশ দেবে। 


এত দূর পড়ে প্রিয় পাঠক-পাঠিকারা সাময়িক বিভ্রান্ত হতে পারেন। তারা মনে করতে পারেন উক্ত ড্রাগ আইন শুধু তাদের বিরুদ্ধে যারা মন্ত্রতন্ত্র, তাবিজ-কবজ ইত্যাদি কিংবা অলৌকিক উপায়ে রোগ সারানোর দাবী জানাবে অথবা যে ব্যক্তি রোগ মুক্ত করবার প্রতিশ্রুতি দেবে। যদিও বিষয়টি ঠিক তেমন নয়। এখানে একটি বিশেষ খবর তুলে ধরছি যা ৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ সালে "এই সময়" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম - "বিজ্ঞাপনী-চমকে ঠকে লাইন ডাক্তারের চেম্বার, আদালতে"। -- "টিভির পর্দায় বীরেন্দ্র সহবাগ, হর্ষ ভোগলেদের দেখে আশা জেগেছিল মনে। টাকে চুল গজানোর বিজ্ঞাপনে মজে অনেক টাকা খরচ করেছিলেন কড়েয়ার যুবক। কিন্তু চুল গজানোর বদলে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার শিকার হন তিনি। সংশ্লিষ্ট সংস্থায় অভিযোগ জানাতে গেলে আমলই দেওয়া হয়নি। বাধ্য হয়ে ক্রেতাসুরক্ষা আদালতের দ্বারস্থ হন ওই যুবক। আলাদত ওই সংস্থাকে ৬০ হাজার টাকা জরিমানা করে ভুক্তভোগীকে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে।


ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন স্থূলতা কমানোর বিজ্ঞাপনে ভরসা করে বোকা বনে যাওয়া হুগলির মধ্যবয়সীও। ভুঁড়ি কমিয়ে রোগা হতে গিয়ে বিপত্তি বেধেছিল। বেহালার গৃহবধূ অবশ্য বিজ্ঞাপনী ওষুধে স্তন ক্যান্সার নিরাময়ের স্বপ্ন দেখে জীবনটাই হারিয়ে ফেলেন। আবার বেলঘরিয়ার এক তরুণ প্রাণে বাঁচলেও মুখমণ্ডলের পোড়া ত্বকের চিকিৎসা করাতে গিয়ে অবসাদের শিকার হন। ফর্সা হওয়ার ক্রিম লাগিয়ে তাঁর শ্যামলা মুখ কালো হয়ে গিয়েছিল। এমন ভুক্তভোগী কম নয়। বিজ্ঞাপনী চমকে আস্থা রেখে পস্তানোর নজির অসংখ্য। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিজ্ঞাপনের দাবি বাস্তবে মেলে না। উল্টে বিজ্ঞাপনে মজে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডের বড়ি খেয়ে কিংবা তেল বা ক্রিম মেখে হরেক শারীরিক সমস্যার শিকার হন অনেকেই। সে সব সঙ্কট সামলাতে হয় চিকিৎসকদেরই। অনেক মামলাও হচ্ছে ক্রেতাসুরক্ষা আদালতে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের আক্ষেপ, মানুষের হুঁশ ফিরছে না। স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, সে জন্যই চটকদার ও বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনী চমকে রাশ টানতে আইন সংশোধন করতে চলেছে কেন্দ্র। ১৯৫৪-র ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিজ (অবজেকশনেবল অ্যাডভার্টাইজমেন্ট) আইন কড়া করতে সংশোধনী বিলের খসড়া তৈরি করেছে স্বাস্থ্যমন্ত্রক। তাতে বলা হয়েছে, চুল পড়া, চুল পাকা, ফর্সা হওয়া, ক্যান্সার নিরাময়, প্রেশার-সুগার কমানো, লম্বা হওয়া, রোগা হওয়া, স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি, স্তন ও লিঙ্গবর্ধনের দাবি বা অর্শ, ফিসচুলা, ক্লান্তি, দুর্বলতা, যৌনসমস্যা, শীঘ্রপতন, বুড়িয়ে যাওয়া, দাঁত শিরশিরানি ইত্যাদি নিরসনের দাবি করে বিজ্ঞাপন চলবে না। আইন ভাঙলে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার সংস্থানও রাখা হয়েছে সংশোধনী বিলে।" 


আরেকটি খবরের অংশ তুলে ধরলাম, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০-"এই সময়" পত্রিকা থেকে- 


"অমুক তেলে টাকে চুল গজায়! তমুক বড়িতে দূর হয় ক্লান্তি, বাড়ে যৌনশক্তি! এই তেলের ব্যবহারে লিঙ্গবর্ধন অনিবার্য! ওই হেলথ ড্রিঙ্কে লম্বা হওয়া অবশ্যম্ভাবী! অমুক টনিকে স্মৃতিশক্তি ক্ষুরধার হবে! তমুক ক্রিম ব্যবহারে ফর্সা হবে গায়ের রং! হরেক পণ্যের এ সব চটকদার প্রচার তো ছিলই। বিজ্ঞাপনী বাজারে এর সঙ্গে ইদানীং যোগ হয়েছে এমন সব দাওয়াই, যা নাকি ম্যাজিকের মতো নিরাময় ঘটায় ডায়াবিটিস, আর্থ্রাইটিস, এমনকী ক্যান্সারের। এই সব পণ্যের যাবতীয় বিজ্ঞাপনে এ বার কঠোর ভাবে রাশ টানতে উদ্যোগী হল কেন্দ্র। এমন অবাস্তব ও মনভোলানো বিজ্ঞাপনী চমকের রমরমা বন্ধে আইন সংশোধন করতে চলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। পুরোনো আইনে শাস্তির সংস্থান ছিল নখদন্তহীন। তা বাড়িয়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড ও ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ১৯৫৪-র ড্রাগস অ্যান্ড ম্যাজিক রেমিডিজ (অবজেকশনেবল অ্যাডভারটাইজমেন্ট) আইনকে কড়া করতে সম্প্রতি সংশোধনী খসড়া বিল তৈরি করেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক। ২০২০-র সেই প্রস্তাবিত বিলের খসড়া নিজেদের ওয়েবসাইটে দিয়ে দেশবাসীর কাছে মন্ত্রক পরামর্শ বা আপত্তির কথা জানতে চেয়েছে আগামী ১৯ মার্চের মধ্যে। খসড়ায় বলা হয়েছে --- ৭৮ রকমের অসুখ বা সমস্যা (আগে ছিল ৫৪টি) নিরাময়ে বিভ্রান্তিকর এই সব মনমোহিনী বিজ্ঞাপন কোনও গণমাধ্যমে দেওয়া যাবে না। বর্তমান সংস্থানে প্রথম দু’বার আইন লঙ্ঘনের শাস্তি যথাক্রমে ছ’ মাস ও এক বছরের জেল। জরিমানার কোনও অঙ্ক বলা নেই সেখানে। প্রস্তাবিত সংশোধনীর খসড়ায় আইন লঙ্ঘনের শাস্তি প্রথম বার দু’ বছরের কারাদণ্ড ও ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা। পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে তা যথাক্রমে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা।... কেন্দ্রীয় এক স্বাস্থ্যকর্তার কথায়, ‘বর্তমান আইনে যে সব ওষুধের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ, তার অনেকগুলিই এখন অচল। আবার অনেক আয়ুর্বেদ-ইউনানি ওষুধ বর্তমান আইনের আওতায় নেই। এই সব ফাঁক গলে বহু পণ্যের বিজ্ঞাপনী চমক বেড়ে গিয়েছে। অথচ তার সঙ্গে বাস্তব সমস্যা সমাধানের সম্পর্ক কম।’ কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যকর্তারা জানাচ্ছেন, গত দেড় বছরে এমন বহু পণ্য ও ওষুধের অবাস্তব বিজ্ঞাপন এবং তার কুফল সংক্রান্ত হাজারখানেক অভিযোগ জমা পড়েছে সরকারের কাছে। এর মধ্যে কেরালা ও তামিলনাড়ুতে দু’টি মৃত্যুর নজিরও রয়েছে। বছর দেড়েক আগে রাজ্যসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে কেন্দ্রীয় আয়ুষ প্রতিমন্ত্রী শ্রীপদ যেসোনায়েকও জানান, ‘গ্রিভান্স এগেনস্ট মিসলিডিং অ্যাডভারটাইজমেন্ট’ পোর্টালে ওই অভিযোগগুলি দায়ের হয়েছে এবং এ ব্যাপারে কড়া অবস্থান নিতে কেন্দ্র বদ্ধপরিকর। এর পরেই কয়েকটি অ্যালোপ্যাথি ও আয়ুর্বেদ-ইউনানি ওষুধের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ করা হয়।


বিশেষজ্ঞরা অবশ্য এই আইনের প্রয়োগ নিয়ে সন্দিহান। ক্যালকাটা স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ক্লিনিক্যাল ফার্মাকোলজি বিভাগের প্রধান চিকিৎসক শান্তনু ত্রিপাঠী বলেন, ‘আইন কড়া করা হচ্ছে, খুব ভালো কথা। কিন্তু বর্তমান নিরীহ আইনটিও কি কখনও কড়া হাতে প্রয়োগ করা হয়েছে? ৫৪টি অসুখ বা সমস্যার ক্ষেত্রে নিষিদ্ধ বিজ্ঞাপনী প্রচারের জন্য কবে কে শাস্তি পেয়েছে যে নয়া আইন সম্পর্কে এত আশাবাদী হব?"


আশাকরি, প্রিয় পাঠক বন্ধুরা বুঝতে পেরেছেন, The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954 এবং The Drugs and Cosmetics Act 1940 আইনানুযায়ী, টাকে চুল গজানো কিংবা ফর্সা হওয়ার ক্রিম অথবা যৌন সমস্যা মেটানোর হিজিবিজি বিজ্ঞাপনও ড্রাগস আইনে নিষিদ্ধ এবং বে-আইনি। 


এই ড্রাগস ও ম্যাজিক রেমেডি আইন নিয়ে একজন স্বঘোষিত যুক্তিবাদী মানুষ নিজের অখণ্ড জ্ঞান জাহির করেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। এটা ২০২০ সালের ঘটনা। কোটিপতি ও কুখ্যাত রাজজ্যোতিষী অনিমেষ শাস্ত্রীর "জ্যোতিষ শাস্ত্র বিজ্ঞান" এইধরনের কুযুক্তি ও তার লোকঠকানো জ্যোতিষ বিদ্যার প্রতারণার বিরুদ্ধে লড়াই করবার সময় "ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি"র সহযোদ্ধা, অনির্বাণ পাল একটি পোস্টার বানায় যেখানে লেখা ছিল- "The Drugs & Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act 1954 এবং The Drugs & Cosmetics Act 1940 অনুসারে জ্যোতিষশাস্ত্রের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করার দাবি বেআইনি।" 


এমতাবস্থায় সেই যুক্তিবাদী মশাই মাঠে নামলেন এটা প্রমাণ করতে যে এসকল আইনে রোগ সারাবার দাবি করা হলে তবেই তা আইনবিরুদ্ধ হবে কিন্তু পরীক্ষায় পাশ, মামলায় জেতা, শত্রু বিনাশ এসব তথাকথিত অলৌকিক দাবি করলে কিছুই করা সম্ভব নয়। আসল কথায় বলে, দারোগার চেয়ে চৌকিদারের হাঁক বেশি হয়। সেই যুক্তিবাদী মশাইয়ের এক স্যাঙাত বাবু আরও একধাপ এগিয়ে বললেন, এইসব আইনে সরাসরি কোথাও নেই যে জ্যোতিষের মাধ্যমে সমস্যা সমাধান আইনবিরোধী।


সত্যিই কী তাই? এইসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর পেতে, জ্যোতিষীদের বিজ্ঞাপন এবং আইনের দিকেই চোখ দেওয়া যাক। পত্রপত্রিকায় সাড়া ফেলে দেওয়া নামীদামী কিছু জ্যোতিষীরা (যারা আবার তান্ত্রিকও হয়ে গেছে) সকল সমস্যা সমাধানের গ্যারান্টি দিয়ে বিজ্ঞাপন দেয় যা দেখে নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত জনগণ এদের কাছে ছোটেন। তারপরে এই প্রতারকেরা পাঁচশো থেকে পাঁচ লাখ যা খুশি নেয় হিজিবিজি তাবিজ-কবজ, রত্নপাথর ইত্যাদির বিনিময়ে। এদের প্রতারকদের সবার ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে তাদের বহু দাবির মধ্যে রোগ নিরাময় এবং অন্যান্য অলৌকিক দাবি আছে। অর্থাৎ, প্রশাসন চাইলেই উপরোক্ত ড্রাগস আইনানুসারে ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু সেই যুক্তিবাদী মশাইয়ের এসব জানা সত্ত্বেও কূটতর্কে প্রবৃত্ত হলেন। 


এবার ড্রাগস আইন নিয়ে আর একটু আলোচনায় গিয়ে দেখা যাক কেউ যদি রোগ সারাবার দাবি ছাড়াও অন্যান্য অলৌকিক দাবি করে তাদের উপরোক্ত আইনানুসারে দোষী সাব্যস্ত করা যায় কিনা।


Drugs & Magic Remedies (Objectionable Advertisements) Act no.21, 1954 এর মূল সংজ্ঞা বা Long Title অংশে আছে "An act to control the advertisement of drugs in certain cases, to prohibit the advertisement for certain purposes of remedies alleged to possess magic qualities and to provide for matters connected therewith."


এখানে 'certain cases', 'to provide for matters connected therewith' শব্দবন্ধের দিকে প্রিয় পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রেই জানেন যখন কোনও আইনের প্রয়োগবিধি নিয়ে আলোচনা করা হয় তখন প্রতিটি শব্দ এবং তার ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন ব্যাখ্যা নিয়ে আইনবিদদের ভিতর চুলচেরা বিশ্লেষণ, বাদানুবাদ হয়ে থাকে। উপরোক্ত সংজ্ঞার বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়, "অলৌকিক ক্ষমতাসম্পন্ন ওষুধ প্রয়োগে সমস্যা সমাধান এবং সেই সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনকে প্রতিহত করার জন্য এই আইনের উপস্থাপনা করা হয়েছে"।


আইনে যদি শুধুমাত্র রোগ নিরাময়ের বিজ্ঞাপন প্রতিহত করার কথা থাকত তাহলে 'certain cases' না লিখে সরাসরি 'certain diseases' লেখা হত, আর 'connected therewith' অংশটা দিয়ে সামগ্রিক সবকিছুকেই জড়িয়ে নেওয়া হত না।


আইনটা আরও বিস্তারিত পড়লেই বোঝা যাবে এই আইনের প্রকৃতি হচ্ছে 'inclusive'। সরাসরি লেখা সম্ভব হয়নি এমন কিছু প্রাসঙ্গিক বিষয়েও আইনের প্রয়োগের জন্য সংজ্ঞার শুরুতে বিভিন্ন স্থানেই জুড়ে দেওয়া হয়েছে, "In this Act, unless the context otherwise requires,-"

অর্থাৎ, "আইনানুসারে, যদি না অন্যভাবে প্রয়োজন হয়"। আইনে 'ড্রাগ' বা 'ওষুধে'এবং 'ম্যাজিক রেমেডিজে'র সংজ্ঞায় কিন্তু শুধুমাত্র পরিচিত ওষুধের নাম করা হয়নি। খুব স্পষ্ট ভাষায় লেখা আছে তাবিজ, কবচ, মাদুলি, তন্ত্রমন্ত্র, জড়িবুটি এবং অলৌকিক সমস্যা সমাধানের দাবি করা যে কোনও প্রকারের জৈব এবং অজৈব পদার্থকেই গণ্য করা হবে। 


তাহলে বোঝা যাচ্ছে, কোন ব্যক্তি যদি তন্ত্রমন্ত্র, তাবিজ-কবচ, রত্ন ইত্যাদির সাহায্যে রোগ সারাবার দাবি করে তবে তা দণ্ডনীয় অপরাধ। যুক্তিবাদী মশাইয়ের স্যাঙাৎ বাবু অবশ্য বোঝাতে চেয়েছেন জ্যোতিষীর বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু বলা নেই। কিন্তু উনি বুঝলেনই না, জ্যোতিষী, তান্ত্রিক ইত্যাদিরাও আইনের চোখে 'ব্যক্তি' হিসাবেই গণ্য হয়।


আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সরাসরি রোগ সারাবার দাবি ছাড়া এরা আর যেসব দাবি করে তার অন্যতম হল বশীকরণ। বশীকরণ মানে হল তাবিজ-কবচ ইত্যাদির সাহায্যে অন্যের মস্তিষ্কের উপর নিয়ন্ত্রণ। সোজা ভাষায়, বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে স্নায়ুকোষের উপর নিয়ন্ত্রণ বা প্রভাব বিস্তার। উপরোক্ত আইনের ২ (বি), (সি) ধারা অনুযায়ী কিন্তু মানুষ এবং অন্য প্রাণীর শরীরের আনবিক স্তরেও বা অন্য কোনভাবে প্রভাব বিস্তার পর্যন্ত আইনত নিষিদ্ধ। একইভাবে শত্রু দমনকে যদি খুন নাও ধরি, শত্রু বশীকরণ কিন্তু মনে করতেই পারি।


রত্ন ধারণ করিয়ে পরীক্ষায় ভাল রেজাল্ট করাবে বলেছে? জ্যোতিষীরা রত্নের সুফলের সাধারণত যে বৈজ্ঞানিক (!!) ব্যাখ্যা দেয় তা হল সূর্যের রশ্মির সাতটা রঙ যাকে নাকি কসমিক রে বলে, সেটা রত্নের মাধ্যমে শোষিত হয়ে শরীর তথা মস্তিষ্কের উন্নতি সাধন করে। এটা যে অবাস্তব সে ব্যাখ্যা নাহয় বাদ থাক। কিন্তু এটাও যে আইনের আওতায় পড়ছে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন।


তারপর ধরুন, বিজ্ঞাপনে স্বামী বা স্ত্রী অন্যের প্রতি আকর্ষণ হারাচ্ছেন, দাম্পত্যসুখ পাচ্ছেন না বলে থাকে। এই কথায় প্রছন্নভাবে বশীকরণ বা যৌনসুখ ফিরিয়ে আনার কথা কি বলা নেই? 


সোজা ভাষায়, যে সকল দাবি এসব মহাশয়েরা করে থাকেন সেগুলো কিন্তু আইনের আওতায়ই পড়ে। এদের কারণে কেউ মারা গেলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পর্যন্ত হতে পারে। এর জন্য সরাসরি জ্যোতিষী, তান্ত্রিক, ওঝা, গুনীন, পীর, ফকির আইনে এসব আলাদাভাবে বলে দেওয়ার দরকার হয় না। 


আগেই উল্লেখ করেছি, ১৯৬৩ সালে বিজ্ঞাপন বিরোধী আইনকে 'cognizable' করা হয়েছে। অর্থাৎ পুলিশ প্রশাসন কোন অভিযোগ ছাড়াই স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে ব্যবস্থা নিতে পারে। তাছাড়া যখনই এসব কেসে পুলিশ গ্রেফতার করে তখন কিন্তু প্রতারণা, জালিয়াতির ধারাগুলোও (রত্ন, যন্ত্রম এসব দিয়ে মামলা জেতানো ঢুকে গেল) প্রয়োগ করে। অলৌকিক বিজ্ঞাপন বিরোধী আইনের ১৩ নম্বর ধারাতেও কিন্তু বলা আছে এর সাথে যদি অন্য কোনও ধারা উপযুক্ত হয় সেগুলোও একইসাথে প্রয়োগ করা হবে। 


আলোচনার সূত্রে এটাও জানিয়ে রাখি, পশ্চিমবঙ্গ বিজ্ঞান মঞ্চ সংগঠনের তরফে সৌরভ চক্রবর্তী, জ্যোতিষ এবং বিভিন্ন ধরনের বশীকরণ সংক্রান্ত এবং যাদু চিকিৎসা বা ম্যাজিক রেমিডি সংক্রান্ত বিজ্ঞাপনগুলি সংবিধানের ৫১ এ(এইচ) ধারার পরিপন্থী হওয়ায় সেগুলিতে লাগাম টানার জন্য কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক রেগুলেশন আইন এবং কেবল টেলিভিশন নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণকারী নিয়মাবলীর অন্তর্ভুক্ত বিজ্ঞাপন ও অনুষ্ঠান সূচক(code) অনুসারে বিজ্ঞাপনগুলির নিয়ন্ত্রণ সুনিশ্চিত করার জন্য বিজ্ঞান মনস্কতা ও যুক্তিবাদকে সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণ থেকে বলবৎ করবার জন্য এ রাজ্যে কুসংস্কার বিরোধী আইনের অভাব থাকায় যতদিন না বিধানসভায় এই মর্মে আইন পাশ হয় ততদিন পর্যন্ত আদালত যাতে একটি সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা (guideline) তৈরি করেন তা নিশ্চিত করার জন্য কলকাতা উচ্চ ন্যায়ালয়ে যে জনস্বার্থ মামলাটি দায়ের করেছিলেন তার শুনানির দিন ছিল গত ৮ এপ্রিল ২০২২। 


এই শুনানিতে বিজ্ঞান মঞ্চের পক্ষে আইনজীবী সব্যসাচী চ্যাটার্জী, মূল মামলার যুক্তিগুলি ব্যাখ্যা করেন। আদালত রাজ্যের ও কেন্দ্রের সরকার ছাড়াও এই মামলায় এ্যাডভার্টাইজমেন্ট স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়ার অনুপস্থিতিতে এই মামলাটির শুনানির একটি নির্দিষ্ট দিন ধার্য্য করেন। এর আগে এই মামলাটি চলাকালীণ অবস্থায় মহামান্য বিচারপতি শ্রী সঞ্জীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডিভিশন বেঞ্চ নির্দেশ দিয়েছিল যে দেশের অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেলকে এই মামলায় উপস্থিত থাকতে হবে। 


সেদিন, মহামান্য প্রধান বিচারপতি শ্রী প্রকাশ শ্রীবাস্তব ও মহামান্য বিচারপতি শ্রী রাজর্ষি ভরদ্বাজের ডিভিশন বেঞ্চ এই মামলাটিতে বিজ্ঞাপন নিয়ন্ত্রক সংস্থা এ্যাডভার্টাইজমেন্ট স্ট্যান্ডার্ড অথরিটি অব ইন্ডিয়াকে নোটিশ জারি করবার নির্দেশ দিয়েছেন। ৪ জুলাই এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য্য হয়েছিল। সর্বশেষ তথ্য এখনও এই লেখকের অজানা বলে জানাতে পারলাম না।


প্রিয় পাঠক-পাঠিকা। আপনি যদি পশ্চিমবঙ্গবাসী হন এবং আপনার কাছে যথেষ্ট প্রমাণ থাকে কোনও বুজরুক, প্রতারকের বিরুদ্ধে তাহলে আপনি আপনার অভিযোগ জানাবেন এই ঠিকানায়- The Director, The Directorate of Drugs Control,  Government of West Bengal, P-16, India Exchange Place Extension, K.I.T. Building, 5th Floor, Kolkata-700073.


অভিযোগ দায়ের করার সময় স্মরণে রাখবেন, রোগ সারাবার কোনও বিজ্ঞাপন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে থাকলে তার জেরক্স কপি অভিযোগপত্রের সাথে যুক্ত করে দেবেন এবং মূল পত্রিকাটি যত্ন করে রেখে দেবেন যা মামলা চলাকালীন কাজে লাগবে। আপনার অভিযোগ পাওয়ার পর ড্রাগস কন্ট্রোল থেকে অভিযুক্তের কাছে জানতে চাইবে এই ধরনের তাবিজ কবচ ইত্যাদি (যা আইনের সংজ্ঞায় ওষুধ বা ড্রাগ) তৈরির বৈধ লাইসেন্স তার কাছে আছে কিনা? ড্রাগস কন্ট্রোলের দেওয়া লাইসেন্সগ ছাড়া ওষুধ বানানো বা বিক্রির জন্য জ্যাোতিষী-তান্ত্রিক ইত্যাদিদের বিরুদ্ধে পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের করবে ড্রাগস কন্ট্রোল। মামলাটি হবে অভিযুক্ত ব্যক্তি বনাম সরকার। আপনাকে বড়জোর সাক্ষী দেওয়া ছাড়া কিচ্ছুটি করতে হবে না। এবারে দু’টি খবর জানিয়ে লেখাটির পরিসমাপ্তি ঘটাবো। 


উত্তরাখণ্ডে রামদেব বাবার পতঞ্জলির ওষুধের রমরমা ব্যবসা। দেরাদুনের দিব্যা ফার্মেসি পতঞ্জলির পক্ষে এই সব আয়ুর্বেদিক ওষুধ তৈরি করে। এই রকম পাঁচটি ওষুধ হোল মধুগৃত, আইগৃত, থাইরোগৃত, বিপিগৃত ও লিপিডম। প্রস্তুতকারকদের পক্ষ থেকে এই সব ওষুধের উপাদান, ফর্মুলা ও গুনাগুন ব্যাখ্যা করে বিজ্ঞাপনের মাধমে প্রচার করা হোত যে এই ওষুধগুলি ডায়াবেটিস, গ্লুকোমা, গয়টার, উচ্চ রক্তচাপ এবং উচ্চ কোলেস্টেরল রোগীর পক্ষে উপকারী। 


কেরালার জনৈক ডাঃ কে ভি বাবু এই বিজ্ঞাপনগুলির বিরুদ্ধে উত্তরাখন্ডের স্বাস্থ্য নিয়ামক সংস্থার কাছে অভিযোগ করেন। অভিযোগে বলা হয় যে, এই বিজ্ঞাপন বিভ্রান্তিকর শুধু নয় এটা ড্রাগস অ্যান্ড কসমেটিকস অ্যাক্ট, ১৯৪০ এবং ম্যাজিক রেমেডিস অ্যাক্ট, ১৯৫৪ এর বিরোধী। সাধারণ মানুষ এ জাতীয় বিজ্ঞাপনে বিভ্রান্ত ও প্রতারিত হচ্ছেন। 


অভিযোগের সত্যতা অনুসন্ধানের পর উত্তরাখন্ড আয়ুর্বেদ ও ইউনানি লাইসেন্স অথরিটি, বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞাপনের দায়ে, দিব্যা ফার্মেসিকে এই সব ওষুধ বন্ধের নির্দেশ দেয় (সূত্র- দি টেলিগ্রাফ / ১০.১১.২০২২। লিংক -

https://www.telegraphindia.com/india/uttarakhand-bars-production-of-5-ramdev-medicines/cid/1897224)। 


এই খবরের আরেকটি বিশেষ খবর - রামদেবের দিব্য ফার্মেসির উৎপাদিত পাঁচটি ওষুধের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিল উত্তরাখণ্ডের আয়ুর্বেদ ও ইউনানি লাইসেন্সিং অথরিটি। আগের নির্দেশিকাকে সংশোধন করে শনিবার নতুন নির্দেশিকা জারি হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ওই ৫টি ওষুধ উৎপাদন জারি রাখতে পারবে রামদেবের সংস্থা (সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন, ১৩/১১/২০২২। লিংক- https://www.anandabazar.com/india/ban-on-ramdevs-5-products-revoked-by-uttarakhand-govt-dgtl/cid/1384018)। 


এতকিছুর পরেও কিন্তু বলব, এসব কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে আরও শক্তিশালী ও স্পষ্ট আইন দরকার। বিশেষত বিজ্ঞাপন বিরোধী আইনের তো ব্যাপক সংশোধন প্রয়োজন। কিন্তু আইন থাকলেই কিছু হয় না। ভারতে শাসকের স্বার্থে বহু উপযোগী আইন শুধুই মলাটবন্দি হয়ে পড়ে থেকে শুধুই ধুলোই জমে। তাছাড়া, প্রচুর সম্পদের চূড়ায় বসে থাকা প্রতারকেরা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি নিজেদের প্রতারণা চালিয়ে যায়। উদাহরণ, রামদেবের পতঞ্জলি ওষুধের ঘটনাটি। কিন্তু পুলিশ, প্রশাসন চাইলেও ড্রাগস ও ম্যাজিক রেমেডিস ভঙ্গকারীদের শুধুমাত্র আইনের অভাবে গ্রেফতার করতে পারবে না সেটি ডাহা মিথ্যে। প্রয়োজন শুধু সদিচ্ছা, যা অনেকেরই নেই।

তালাক - তালাক - তালাক -
অভিষেক দে
Nov. 25, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:5903 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দিনটি ছিল ২৩ আগষ্ট ২০১৭। অঝোরে কাঁদছিলেন নুসরত, কাঁদছিলেন সায়রা বিবি, কাঁদছিলেন নার্গিস, তাবসসুম এর মতন অনেকেই। এই কান্না কোনো দুঃখের নয়, বরং আনন্দের। আজ প্রবল তর্ক-বিতর্কের মধ্যেই ঐতিহাসিক একটি রায়-এ "তিন তালাক" বাতিল করে ভারতের শীর্ষ আদালত অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে- “তিন তালাক, অসাংবিধানিক, অবৈধ এবং ইসলামের অংশ নয়”। 


প্রধান বিচারপতি জে এস কেহর (শিখ) এর নেতৃত্বে ছিলেন পাঁচজন ভিন্নধর্মমতের বিচারপতির বেঞ্চ। যথা, এস আব্দুল নাজির (মুসলিম), কুরিয়েন জোসেফ (খ্রিস্টান), ইউ ইউ ললিত (হিন্দু) এবং রোহিন্তন ফলি নরিম্যান (পার্সি)। উক্ত পাঁচজন ব্যক্তিরা, আজ তাৎক্ষণিক বা Instant তালাক অর্থাৎ মাথাগরম করে শুধুমাত্র তিনবার তালাক উচ্চারণ করেই যে তালাক দেওয়ার কু-প্রথা সেটাই বাতিলের পথে হেঁটেছেন। যদিও আজ তালাক-এ-বিদ্দত বাতিল হলেও চালু থাকছে, তালাক-এ-এহসান এবং তালাক-এ-সুন্নত।


৩:২ অনুপাতে তিন তালাক মামলার নিষ্পত্তি হল অর্থাৎ তিনজন বিচারপতি পক্ষে এবং ২ জন বিচারপতি বিপক্ষে ছিলেন। সুপ্রিম কোর্ট আরো জানিয়েছে, সরকারকে আগামী ৬ মাসের মধ্যে আইন প্রণয়ন করতে হবে এবং সরকার যদি এই কাজে ব্যার্থও হয় তাহলেও তিনবার তালাক উচ্চারণ করে কেউই বিবাহবিচ্ছেদ গ্রাহ্য হবে না। 


তালাক শব্দের অর্থ বিচ্ছিন্ন, ত্যাগ করা ইত্যাদি। ইসলাম ধর্মে আনুষ্ঠানিক বিবাহবিচ্ছেদকে তালাক বলা হয়। স্বামী সর্বাবস্থায় তালাক দিতে পারেন। স্ত্রী শুধুমাত্র তখনই তালাক দিতে পারবেন, যদি বিয়ের সময় এর লিখিত অনুমতি দেওয়া হয়। পরিভাষায় তালাক এর অর্থ "বিবাহের বাঁধন তুলিয়া ও খুলিয়া দেওয়া, বা বিবাহের শক্ত বাঁধন খুলিয়া দেওয়া "স্বামী তার স্ত্রীর সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দেওয়া।


২০০৮ সালের হিসেবে দেখা যায় বাংলাদেশে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যেই তালাক প্রবণতা বেশি। কারণ পিতৃতান্ত্রিক সমাজে বর্তমানে নারী মুখবুজে সব অন্যায় অত্যাচার সহ্য করেন না। প্রতিবাদ করেন। ইসলামে তালাকের পর একজন মহিলাকে ইদ্দত পালন করতে হয়। সেই (ইদ্দত কালীন) সময়ের মধ্যে একজন মুসলীম নারীর পুন:বিবাহ ইসলামে নিষিদ্ধ। একজন মুসলীম নারীর জন্য ইদ্দত দুই প্রকার বা ভাগে ভাগ করা সম্ভব। প্রথমত তালাকের পর, একজন মুসলীম নারীকে তার তালাকের পর ৯০ দিন বা তিন চন্দ্রমাস অপেক্ষা করতে হবে। এই ৯০ দিন হচ্ছে ইদ্দত কালীন সময়।


উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে,পদ্ধতিগত দিক দিয়ে তালাক তিন প্রকারঃ- (ক) আহসান বা সর্বোত্তম তালাক, (খ) হাসান বা উত্তম তালাক এবং (গ) বিদ'ই বা শরিয়া বিরূদ্ধ তালাক। আবার, ক্ষমতা বা এখতিয়ার গত দিক দিয়ে তালাক পাঁচ প্রকারঃ- (১) তালাক-এ-সুন্নাত (২) তালাক-এ-বাদী (৩) তালাক-এ-তাফবীজ (৪) তালাক-এ-মোবারত এবং (৫) খোলা তালাক। অন্যদিকে কার্যকর হওয়ার দিক দিয়ে তালাক প্রধানত দুই প্রকারঃ- (১) তালাক-এ-রেজী ও (২)তালাক-এ-বাইন। তালাক-এ- বাইন আবার দুই প্রকারঃ- (১)বাইনে সগির ও (২) বাইনে কবির। মর্যাদা ও অবস্থানের দিক থেকে তালাক চার প্রকারঃ- (১)হারাম (২)মাকরুহ (৩)মুস্তাহাব ও (৪)ওয়াজিব। 

২৮ ডিসেম্বর ২০১৮। অনেক আলোচনা, সমালোচনা, তর্ক-বিতর্কের মাঝেই কেন্দ্রীয় সরকার অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদীর সরকার দ্বারা আজ লোকসভায় পাশ হলো তিন তালাক বিল।  

তবে শুধু তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের বিল টাই আজ পাশ হয়েছে, তিন তালাক বন্ধের নয় কিন্তু। আমাদের মনে রাখতে হবে, তাৎক্ষণিক তিন তালাক ও তিন তালাক এক নয়। তালাক-এ-বিদ্দত বন্ধের জন্য বিল পাশ করিয়েছেন নরেন্দ্র মোদীর সরকার কিন্তু বাকি তিন তালাক যেমন চলছে, তেমনই কি চলবে? প্রশ্নটা তুলেছেন বহু বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তিরা। তাদেরেই অনেকে জানাচ্ছেন, "আজ লোকসভায় নরেন্দ্র মোদী সরকার তাৎক্ষণিক তিন তালাক বিল পাশ করানোয় অনেকেই এমন ভাবে আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে যেন তিন তালাক প্রথাটাই বন্ধ হয়ে ভারত থেকে চিরতরে।" 


এইপ্রসঙ্গে জানাই, সংবিধানে উল্লেখিত "ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র" ভারতে তিন তালাক চালু রয়েছে শুধু তাই নয়, তথাকথিত স্বাধীনতার ৭৪ বছর পরেও ভারতে লাগু আছে শরীয়া আইন- "The Muslim Personal Law (Sharia) Application Act, 1937"। আইনিবিশেষজ্ঞ ওসমান মল্লিক জানাচ্ছেন, ভারতে এই শরীয়া আইন শুধু মুসলিমদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। মূলতঃ বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, উত্তরাধিকার, দত্তক, অভিভাবকত্ত্ব এর মত বিষয় গুলি শরিয়া আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ফৌজদারি দণ্ডবিধির ক্ষেত্রে এখানে শরীয়া আইন কার্যকরী নয়। মূলতঃ এই আইন দ্বারা ভারতীয় মুসলিম মহিলারা নিষ্পেষিত ও শোষিত।


অন্যদিকে কয়েকজন মুসলিম ব্যক্তিরা জানাচ্ছে- "তাৎক্ষণিক তিন তালাক ইসলামে তো এমনিতেই অবৈধ এবং নিষিদ্ধ। তাছাড়া পৃথিবীর ২০টি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র তাৎক্ষণিক তালাক বহুদিন পূর্বে থেকে নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। 


সাংবাদিক শুভজ্যোতি ঘোষ

বিবিসি বাংলা, দিল্লি, ১৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ এর একটি রিপোর্টে লিখেছেন- 

"গত বছরের অগাস্টে এক ঐতিহাসিক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে বেআইনি ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আইন প্রণয়নের ভার তারা ছেড়ে দিয়েছিল সরকারেরই ওপর। এরপর এই প্রথাকে শাস্তিযোগ্য করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার 'দ্য মুসলিম উইমেন প্রোটেকশন অব রাইটস ইন ম্যারেজ অ্যাক্ট' নামে একটি বিলও আনে, যা সাধারণভাবে 'তিন তালাক বিল' নামেই পরিচিতি পায়। গত বছরের ডিসেম্বরে ওই বিলটি ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হয়ে গেলেও রাজ্যসভায় সেটি বিরোধীদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

অনেক বিরোধী দলের নেতাই যুক্তি দেন, ভাল করে খুঁটিয়ে দেখার জন্য বিলটিকে একটি সংসদীয় সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানো উচিত। ওই বাধার মুখে বিলটি পাস করাতে না-পেরে সরকার এখন ঘুরপথে সেটিকে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে আইনে পরিণত করল। বুধবার সকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।


ভারতের আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এরপর বিরোধী কংগ্রেসকে আক্রমণ করে বলেন,"তাদের দলের সর্বোচ্চ নেত্রী একজন মহিলা (সোনিয়া গান্ধী), তা সত্ত্বেও নিছক ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতির জন্য তারা পার্লামেন্টে আইন করে এই বর্বর প্রথা বন্ধ করতে রাজি হলেন না, সেটাই আশ্চর্যের ও দু:খের।" তবে পার্লামেন্টে যে বিলটি আনা হয়েছিল, তার তুলনায় এদিন আনা অর্ডিন্যান্সে শাস্তির বিধান বেশ কিছুটা শিথিল করা হয়েছে। মূল বিলটিতে ছিল তিন তালাক হয়েছে বলে অভিযোগ যে কেউ আনতে পারেন, এমন কী প্রতিবেশীরাও। অর্ডিন্যান্সে অবশ্য বলা হয়েছে কেবল মাত্র তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রী ও তার রক্ত সম্পর্কের আত্মীয়রাই অভিযোগ আনতে পারবেন।

এমন কী, তিন তালাক দেওয়া স্বামী যদি আপষ মীমাংসায় রাজি থাকেন, তাহলে স্ত্রী-র সেই অভিযোগ প্রত্যাহার করে নেওয়ারও সুযোগ থাকছে অর্ডিন্যান্সে।


অভিযুক্ত স্বামীর এর আগে জামিন পাওয়ারও কোনও সুযোগ ছিল না। কিন্তু অর্ডিন্যান্সটি বলছে, তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর বক্তব্য শোনার পর বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেট চাইলে অভিযুক্তের জামিন মঞ্জুর করতে পারবেন। কংগ্রেস এর আগে সরকারকে জানিয়েছিল, তারা পার্লামেন্টে বিলটিকে সমর্থন করতে রাজি - যদি কথা দেওয়া হয় যে তিন তালাক দেওয়ার অভিযোগে কোনও স্বামীর জেল হলে সে সময় তার স্ত্রীর আর্থিক ভরণপোষণের দায়িত্ব সরকারই নেবে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অবশ্য সে প্রস্তাব মেনে নেয়নি। তবে বিলের সমর্থনে তারা বেশির ভাগ রাজ্য সরকারের সমর্থন পেয়েছে বলেই দাবি করছে।


আইনমন্ত্রী রবিশঙ্কর প্রসাদ এদিন আরও বলেছেন, শুধুমাত্র ভারতের মুসলিম নারীদের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতেই সরকার এই পদক্ষেপ নিয়েছে। তার কথায়, "এই সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণই জেন্ডার জাস্টিস (সব লিঙ্গের জন্য ন্যায়) নিশ্চিত করার জন্য, এর সঙ্গে ধর্ম বা ভোটের রাজনীতির কোনও সম্পর্কই নেই।" খবরটির লিংক- https://www.bbc.com/bengali/news-45574788


৩০ জুলাই ২০১৯। ভারতের সংসদের উচ্চ কক্ষে তিন তালাক বিল পাশ হয়েছে। বিলটির নাম ‘মুসলিম মহিলা বিল-২০১৯ [The Muslim Women (Protection of Rights on Marriage) Bills, 2019]। এই বিলটির দুটি বিষয়ে আলোচনার অবকাশ রয়েছে। যেমন- ৩নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনও মুসলিম স্বামী তার স্ত্রীর প্রতি তালাক উচ্চারণ করলে, তা লিখিত বা যে ভাবেই হোক, সে তালাক বাতিল বা অবৈধ হবে (Sec. 3. Any pronouncement of talaq by a Muslim husband upon his wife, by words, either spoken or written or in electronic form or in any other manner whatsoever, shall be void and illegal.)। 


৪ নং ধারায় বলা হয়েছে, যে কোনও মুসলিম স্বামী উপরের ৩নং ধারা অনুযায়ী তার স্ত্রীর প্রতি তিন তালাক উচ্চারণ করলে সেই স্বামীর তিন বৎসর জেল এবং জরিমানা হবে (Sec. 4. Any Muslim husband who pronounces talaq referred to in Sec. 3 upon his wife shall be punished with imprisonment for a term which may extend to three years and shall also be liable to fine)।


এবারে তুলে ধরছি BBC News, বাংলা'র ৩১ জুলাই ২০১৯ এর অনলাইন পত্রিকার খবর। লিংক- https://www.bbc.com/bengali/news-49174195


"তিন তালাক দিলে তিন বছরের কারাদণ্ড, ভারতে আইন পাস।"'তিন তালাক' প্রথাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করে একটি আইন অনুমোদন করেছে ভারতের পার্লামেন্ট। মুসলমানদের 'তিন তালাক' প্রথাকে ফৌজদারি অপরাধ হিসাবে গণ্য করে একটি আইন অনুমোদন করেছে ভারতের পার্লামেন্ট। এই আইন ভঙ্গ করলে তিন বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। প্রথা অনুযায়ী, তিন বার তালাক উচ্চারণ করে, বার্তা পাঠিয়ে বা ইমেইল করে মুসলিম স্বামী তাদের স্ত্রীকে তালাক দিতে পারতেন।

ওই প্রথাকে অসাংবিধানিক বলে ২০১৭ সালে রায় দেয় ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। এই আইনের সমর্থকরা বলছেন, এর ফলে মুসলমান নারীরা আরো নিরাপদ হবেন। তবে বিরোধীদের দাবি, ফৌজদারি শাস্তির বিধানের কারণে হয়রানি এবং অপব্যবহারের সুযোগ তৈরি হবে। আইনের এই প্রস্তাবটি ২০১৭ সালেই প্রথম উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পার্লামেন্টের রাজ্যসভায় সেটি আটকে যায়, কারণ কোন কোন সংসদ সদস্য প্রস্তাবটিকে অন্যায্য বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ভারতীয় জনতা পার্টি বিলটির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে, আর প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের অবস্থান বিপক্ষে। তবে রাজ্যসভায় বিজেপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। মঙ্গলবার বেশ কয়েকজনের ওয়াক-আউট আর অনুপস্থিতিতে এই বিলের পক্ষে ভোট পড়ে ৯৯ আর বিপক্ষে ভোট পড়ে ৮৪।


এই ফলাফলকে 'লৈঙ্গিক সমতার' বিজয় বলে বর্ণনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। তবে অনেকে অভিযোগ করছেন, এর মাধ্যমে হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি আসলে মুসলমানদের লক্ষ্যবস্তু করছে। অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন পার্টির এমপি আসাদুদ্দিন ওইসি বলেছেন, নতুন আইনটি মুসলিম সত্ত্বার ওপর বিজেপির আরেকটি আঘাত। দলটি ২০১৪ সাল থেকে ক্ষমতায় রয়েছে।


এর আগে মিশর, সংযুক্ত আরব আমিরাত, পাকিস্তান, বাংলাদেশের মতো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে তিন তালাক প্রথাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে ভারতে এই প্রথার ব্যবহার চলে আসছিল, যা বিবাহ এবং বিচ্ছেদের আইনের সঙ্গে খাপ খায় না।

২০১৮ সালের ১৯শে সেপ্টেম্বর তিন তালাক প্রথাকে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা একটি অর্ডিন্যান্স বা নির্বাহী আদেশ জারি করে।


তিনবার তালাক উচ্চারণ করে স্ত্রীকে বিবাহ বিচ্ছেদ দিলে এই আইন অনুযায়ী মুসলিম পুরুষদের তিন বছরের জেল ও আর্থিক জরিমানার বিধান থাকছে। তালাকপ্রাপ্ত স্ত্রীর খোরপোষ পাওয়ারও অধিকার থাকবে। গত বছরের অগাস্টে এক ঐতিহাসিক রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট তিন তালাককে বেআইনি ও অসাংবিধানিক বলে ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এ ব্যাপারে আইন প্রণয়নের ভার তারা ছেড়ে দিয়েছিল সরকারেরই ওপর। এরপর এই প্রথাকে শাস্তিযোগ্য করে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার 'দ্য মুসলিম উইমেন প্রোটেকশন অব রাইটস ইন ম্যারেজ অ্যাক্ট' নামে একটি বিলও আনে, যা সাধারণভাবে 'তিন তালাক বিল' নামেই পরিচিতি পায়। ডিসেম্বরে ওই বিলটি ভারতীয় পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হয়ে গেলেও রাজ্যসভায় সেটি বিরোধীদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে পড়ে। তবে এখন সেটি আইনে পরিণত হলো।"


তাৎক্ষণিক তিন তালাক এর মতন অমানবিক কু-প্রথার বিরুদ্ধে বিল পাশ করানো নিঃসন্দেহে নরেন্দ্র মোদি সরকারের বিড়াট বড় সাফল্য। অনেকেই ওনাকে বিদ্যাসাগর, রামমোহনদের মতনই বড় মাপের সমাজ সস্কারক ভাবতে শুরু করেছেন ইতিমধ্যে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আছেন নিজের মধ্যেই। অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, যা ইসলামে ইতিমধ্যেই বাতিল ও নিষিদ্ধ, যা ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশও নয় তাকে অসাংবিধানিক আখ্যা দিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়, বিল পাশ করানো এবং গেরুয়া শিবিরের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছাস, সত্যিই  হাস্যকর। নরেন্দ্র মোদী সরকার কেন অভিন্ন দেওয়ানি বিধি বা ইউনিফর্ম সিভিল কোড লাগু করতে উদ্যোগী নন? কেন শুধু তালাক-এ-বিদ্দত? কেন তালাক-এ-আহসান এবং তালাক-এ-সুন্নতকেও পুরোপুরি বাতিল করার বিল পাশ করানোর উদ্যোগ নেই প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রীর? 


কলকাতা নিবাসী একজন গুণী বাঙালি লেখক জানিয়েছেন, "ভারতের সর্বশেষ ২০১১ আদমসুমারি অনুযায়ী ২৩ লক্ষ ৭০ হাজার মহিলা বিবাহ বিচ্ছিন্না ছিলেন, যাদের মধ্য ১৯ লক্ষ হিন্দু মহিলা এবং মুসলিম বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলা ছিল ২৮ হাজার। এই ২৮ হাজার মুসলিম মহিলাদের কতজন তাৎক্ষণিক তিন তালাকের শিকার ছিলেন তার কোনও সরকারি তথ্য নেই। তবে ১৯ লক্ষ হিন্দু বিবাহ বিচ্ছিন্না মহিলাদের কেউ তিন তালাকের শিকার ছিলেন না, এ বিষয়ে দ্বিমত চলে না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মুসলিম মহিলাদের কথা ভেবে তিন তালাক বিল পাশ করাতে বিশেষ উদ্যোগী হয়েছেন যা খুবই ভালো পদক্ষেপ কিন্তু শুধু মুসলিম মহিলাদের সাথে হিন্দুধর্মে বিশ্বাসী মহিলাদের দিকটাও যেন উনি ভাবেন।" 


তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের বিল পাশ করে তিন তালাক বন্ধের কথা প্রধানমন্ত্রী বলছেন। তবে এটার জন‍্য বিল পাশ করার কোন দরকার নেই। সরকার যদি অভিন্ন দেওয়ানি বিধির বিল পাশ করতেন তাহলে আর কোন বিলের এ ব‍্যাপারে প্রয়োজনই ছিলোনা।  যারা বিল পাশ করছেন তারা সব বোঝেন, কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর অন্ধভক্তরা এসব কবে বুঝবেন? প্রশ্ন উঠেছে, মুসলিম পার্সোনাল ল-বোর্ড এর আচরণ, 'দ্য মুসলিম ওম্যান বিল ২০১৭ 'এর উদ্দেশ্য, অবিজেপি রাজনৈতিক দলের আলপটকা মন্তব্য এবং ভূমিকা নিয়েও (জানিনা কেন হটাৎ রাহুল গান্ধী ২০১৯ সালে মন্তব্য করেছিলেন-কেন্দ্রে ক্ষমতায় এলে তিন তালাক আইন বাতিল করবেন)। আপাতত তিন তালাক বিলটি জম্মু কাশ্মীর বাদে পুরো ভারতেই চালু হবে। সংবিধানের ১৪১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সুপ্রিম কোর্টের রায়ই দেশের আইন। সেই অনুযায়ী তাৎক্ষণিক তালাক এখন বৈধ বা গ্রাহ্য নয়।


২০১৯ সালে, জনৈক ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়ায় শেয়ার হওয়া একটি ভাইরাল পোস্টে তুলে ধরলাম - "সংসদের উভয় কক্ষেই ইতিমধ্যে পাশ হয়ে গিয়েছে তিন তালাক বিল। রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পেয়ে বুধবার থেকেই তা পরিণত হয়েছে আইনে। এই আইন মোতাবেক কোনও ব্যক্তি যদি তাঁর স্ত্রীকে তাৎক্ষনিক তিন তালাখ দেন তাহলে তিন বছর পর্যন্ত কারাবাসের সাজা হতে পারে। এক নজরে দেখে নেওয়া যাক বিলটির প্রধান চারটি বৈশিষ্ট।  


তাৎক্ষনিক তিন তালাখ এখন একটি ফৌজদারি অপরাধ। এর সর্বোচ্চ শাস্তি তিন বছরের জেল। অভিযুক্ত স্বামী আদালতে জামিনের আবেদন জানালে শুধুমাত্র পুলিশের বক্তব্য শুনেই তার ফয়সালা করতে পারবেন না বিচারক। তিন তালাক আইনের সেকশন ৭ (সি) অনুযায়ী যে মহিলাকে তাৎক্ষনিক তিন তালাখ দেওয়া হয়েছে, অর্থাৎ অভিযুক্ত ব্যক্তির স্ত্রীর বক্তব্যও এক্ষেত্রে শোনা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। শুধু বাধ্যতামূলক নয়, সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হবে অভিযোগকারিণী মহিলার বক্তব্যকেই।  

   

আইনের ভাষায় তিন তালাক দেওয়া একটি কম্পাউন্ডেবেল অপরাধ। অর্থাৎ অভিযোগকারিণী যদি চান, সেক্ষেত্রে আইনি প্রক্রিয়া থেকে মুক্তি পেতে পারেন অভিযুক্ত স্বামী। তিন তালাক আইনের ৭ (বি) ধারায় বলা হয়েছে অভিযোগকারিণী স্ত্রী যদি চান তাহলে তিনি তাঁর স্বামীকে অভিযোগ থেকে মুক্ত করতে পারেন। যদিও বিচারক মনে হলে কিছু বাড়তি শর্তাবলিও যুক্ত করতে পারেন অভিযুক্তের মুক্তির ক্ষেত্রে।  


তিন তালাক আইন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি যদি তাঁর স্ত্রীকে আইন মেনে তালাক দেন, তাহলে সেই দম্পতির নাবালক সন্তানদের নিজের হেফাজতে চাইতে পারবেন না স্বামী। এছাড়াও নাবালক সন্তানদের ভরণপোষণের জন্য স্বামীর থেকে খোরপোশ পাবেন স্ত্রী। কেবল মাত্র নাবালক সন্তানদের জন্যই নয়, বাকি নির্ভরশীল সন্তানদের জন্যও খোরপোশের আবেদন জানাতে পারবেন বিবাহ বিচ্ছিন্না স্ত্রী।   

এছাড়াও বিচার প্রক্রিয়ায় গতি আনতে আইনে বলা হয়েছে স্থানীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসেই হবে তালাক মামলার শুনানি।  দাম্পত্য বিবাদ সংক্রান্ত বিভিন্ন মামলায় দেখা গিয়েছে বাড়ি থেকে আদালতের দুরত্ব বেশি হওয়ার ফলে অনেক ক্ষেত্রেই অসুবিধায় পড়েন মহিলারা। সেই সমস্যার সুরাহা করতেই সরকারের এই পদক্ষেপ বলে মনে করা হচ্ছে।" 


অন্যদিকে ভারতে বসবাসকারী সেইসব ধর্মপ্রাণ মুসলিম ব্যক্তিদের (যারা নিজেদেরকে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে দাবী জানান)ও আজ এটা বুঝে নেওয়া বিশেষ প্রয়োজন যে, তিন তালাক যখন ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় এবং ইসলাম একে সমর্থনও করেনা তখন আপনাদেরই উচিৎ এগিয়ে আসা এবং এর বিরোধিতা করা। মনে রাখবেন  সরকারের দুর্নীতি, শোষণ, ফ্যাসিবাদ, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ইত্যাদি কাজকর্মের বিরোধীতা এবং একটি প্রাচীন কু-প্রথা বাতিলের বিরোধীতা এক জিনিস নয়। আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই, আরব অঞ্চলে 'ইদ্দা' নামক এক ধর্মীয় বিধান রয়েছে। এই বিধান মতে, স্বামী তার স্ত্রীকে তিন মাসের জন্য 'তালাক ' দিতে পারে এবং তিন মাস পরে আবার তালাক দেওয়া স্ত্রীকে গ্রহণ করতে পারে। এই মধ্যবর্তী সময়ে স্বামী কোনও নারীকে স্ত্রী করে তার চারটি স্ত্রী রাখার ধর্মীয় অধিকার বজায় রাখতে পারে। ধর্মের সূত্র ধরে মরোক্কোর সংবিধানে স্ত্রীকে স্বামীর আইনি ক্রিতদাসী করা হয়েছে। ও দেশের সংবিধানে বলা হয়েছে -স্ত্রী বাধ্য ও বিশ্বস্ত থাকবে স্বামীর কাছে, স্বামীর পিতা-মাতা ও আত্বীয়স্বজনের সম্মান রক্ষা করবে। স্ত্রী যদি তার মা- বাবাকেও দেখতে চায়, তাহলে স্বামীর অনুমতি নিতেই হবে (সূত্র- The Sisterhood of Man, by Newland Kathleen : W.W.Norton & Co..New York : 1979, Page- 24)। আপনারা যদি সত্যিই নারীকে "মানুষ" হিসেবে মনে করেন, যদি আপনারা নারী প্রগতি ও নারীপুরুষের সাম্য চান তাহলে সমস্তরকম কু-প্রথা, যুক্তিহীন ধর্মীয় বিশ্বাস বা আচার অনুষ্ঠান এবং কুসংস্কারের বিরোধীতা করুন। তাই মুসলিম সম্প্রদায়ের উচিৎ, সুপ্রিম কোর্টের রায় ও পাশ হওয়া এই বিলটিকে সম্মান জানানো। 


তিন তালাক এবং ইউনিফর্ম সিভিল কোড বা অভিন্ন দেওয়ানি বিধি নিয়ে সম্প্রতি আলোচনা হচ্ছিল ওসমান মল্লিক সমেত কয়েকজন সংবিধান এবং আইনিবিশেষজ্ঞদের সাথে। এই অভিন্ন দেওয়ানি বিধি সম্পর্কে ওসমান বাবু জানিয়েছেন - 

"সংবিধানের খসড়া বা ড্রাফটে ইউনিফর্ম সিভিল কোড ছিল ৩৫ নম্বর আর্টিকেল এর অন্তর্গত। সংবিধান সভায় এটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়।  মুসলিম সদস্যদের দিক থেকে এর জোরালো প্রতিবাদ হয়। বেশিরভাগ মুসলিম সদস্যদের বক্তব্য ছিল মুসলিম ব্যক্তিগত আইন অলঙ্ঘনীয়। এই আইনে কোনো পরিবর্তন আনা যাবেনা। তাই ইউনিফর্ম সিভিল কোড এর কথা সংবিধানে থাকা চলবেনা। 

২০১১ সালে সেকুলারিজম এর আদর্শকে পাথেয় করে আমরা একটি সংগঠন গড়ি। নাম- 'সেকুলার মিশন'। মূলত : সেকুলার স্টেট ও সেকুলার ফ্যামিলি এর আদর্শেকে প্রচারের উদ্দেশ্যেই এই সংগঠন। এরই মাঝে আমরা একটি উদ্যোগ নিয়েছিলাম - ইউনিফর্ম সিভিল কোড এর ড্রাফট তৈরীর। আপনাদের সকলকে জানাই সেই ড্রাফট এখন রেডি। A Complete Draft of Uniform Civil Code of India 06th December 2021 জমা পড়েছে law Commission সহ বিভিন্ন দপ্তরে। Marriage, Divorce, Maintenance, Succession, Adoption ও Guardianship -এই সব কটি বিষয়ই এই কোডের অন্তর্গত। রয়েছে ১১৫ টি সেকশন ও ৫টি তপশীল। 


কি আছে এই ড্রাফটে? চেষ্টা করছি আমরা একটি বাংলাতে বই বের করার। তার পরিশিষ্ট অংশ থাকবে এই ড্রাফট। সব ঠিক ঠাক এগোলে আগামী বইমেলাতেই আপনারা হাতে পাবেন এই বইটি। এখানে এই খসড়ার দু একটি সেকশন তুলে ধরছি :

1. (2): It extends to the whole of India, and applies to all citizens of India, irrespective of their religion, caste, creed, and custom

3. (b) any other law in force immediately before the commencement of this Act shall cease to apply in so far as it is inconsistent with any of the provisions contained in this Act.

(c) any practice, custom, or usage, in contravention of this Act, shall be treated null &void, ineffective, and illegal.

(d) there is no bar to practicing rituals or customs, subject to public order, decency, morality, and mutual consent of the parties, but no such customs or rituals shall have the status of Law.

লেখাটি শেষ করবার আগে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্যে আরেকবার চোখ বোলানো যাক। 

১) ৩১ জুলাই ২০১৯-তিন তালাক বিরোধী আইন পাশ করেছিল নরেন্দ্র মোদি সরকার। এর পুরো নাম- "The Muslim Women (Protection of Rights on Marriage) Bills, 2019"। ২০১৭-র ১৮ মে, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ভিত্তিতে এই আইন পাশ হয়।

২) ২০১১-র জনগণনা অনুসারে দেশের আট শতাংশ মহিলা মুসলিম। ১৫ অক্টোবর, ২০১৫- বিবাহ বিচ্ছেদের ক্ষেত্রে মুসলিম মহিলারা বৈষম্যের শিকার কি না তা দেখার জন্য প্রধান বিচারপতিকে জানায় সুপ্রিম কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ।

৩) ফেব্রুয়ারি, ২০১৬- উত্তরাখণ্ড ভারতের বাসিন্দা শায়রা বানু একটি পিটিশন দায়ের করেন ৷ তিনি আদালতকে জানান, উত্তরাখণ্ডে বাপের বাড়িতে গেছিলেন চিকিৎসার জন্য। সেইসময় তাঁর শওহর অর্থাৎ স্বামী তাঁকে একটি চিঠি পাঠান। ওই চিঠিতে তাৎক্ষণিক তালাক দেন শায়রার শওহর এরপর ১৫ বছর ধরে শওহরের সঙ্গে দেখা করতে পারেননি তিনি ৷ এমনকী তাঁর সন্তানদের সঙ্গেও দেখা করতে দেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন শায়রা। শায়রার শওহর এলাহাবাদে থাকতেন ৷ আদালতের কাছে তাৎক্ষণিক তিন তালাক বন্ধের আর্জি জানান তিনি  পাশাপাশি শায়রা জানান, মুসলিম ব্যক্তিরা তাঁদের বিবিদের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬- অ্যাটর্নি জেনেরাল মুকুল রোহাতগিকে এই বিষয়ে সহযোগিতা করার জন্য সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশ দেন।


৪) ২৮ মার্চ, ২০১৬- ‘মহিলা এবং আইন : পারিবারিক আইনের মূল্যায়ন এবং বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব ও উত্তরাধিকার সম্পর্কিত আইনের উপর লক্ষ্য’-বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের রিপোর্ট তৈরির জন্য কেন্দ্রকে নির্দেশ দেয় সুপ্রিম কোর্ট।  স্বতঃপ্রণোদিত এই মামলায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ড (AIMPLB)-এর মতো বহু সংস্থাকে যুক্ত করে শীর্ষ আদালত ৷


৫) ২৯ জুন, ২০১৬- সুপ্রিম কোর্ট জানায়, ‘‘সাংবাধিনাকি পরিকাঠামোর কষ্টি পাথর’’-এ বিচার হবে ‘তিন তালাক’। ৭ অক্টোবর, ২০১৬- সাংবিধানিক ইতিহাসে প্রথমবার শীর্ষ আদালতে কেন্দ্রীয় সরকার তিন তালাকের বিরোধিতা করে।  লিঙ্গ-বৈষম্য ও ধর্মনিরপেক্ষতার মতো বিষয়ে ভেবে দেখার কথা জানায় কেন্দ্র। ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭- মূল মামলার সঙ্গে আরও কয়েকটি আলোচনামূলক আবেদন যুক্ত করার অনুমতি দেয় শীর্ষ আদালত। ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭- পাঁচ বিচারপতিকে নিয়ে একটি সাংবিধানিক বেঞ্চ গড়ে সুপ্রিম কোর্ট। ওই বেঞ্চে তিন তালাক ও নিকাহ হালালা সংক্রান্ত যাবতীয় শুনানি ও আলোচনা হয়। 


৬) মার্চ, ২০১৭ - AIMPLB সুপ্রিম কোর্টকে জানায়, তিন তালাকের বিষয়টি বিচার ব্যবস্থার এক্তিয়ারের মধ্যে পরে না। ১৮ মে, ২০১৭- তিন তালাক সংক্রান্ত মামলার রায়দান স্থগিত রাখে।  ২২ অগাস্ট, ২০১৭- তিন তালাককে বেআইনি বলে ঘোষণা করে শীর্ষ আদালত এবং কেন্দ্রকে এই বিষয়ে আইন পাশ করানোর কথা জানায়। ডিসেম্বর, ২০১৭- লোকসভায় পাশ হয় মুসলিম মহিলা (বিবাহের অধিকারের সুরক্ষা) বিল।

৯অগাস্ট, ২০১৮- তিন তালাক বিলের সংশোধনীতে অনুমতি দেয় কেন্দ্র। ১০ অগাস্ট, ২০১৮- রাজ্যসভায় পেশ করা হয় তিন তালাক বিল। সমর্থন না পাওয়ায় সংসদের শীতকালীন অধিবেশন পর্যন্ত পিছিয়ে যায় বিল পাশ ৷১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১৮- মন্ত্রিসভায় অর্ডিন্যান্স পাশ হয় ৷ তিন তালাককে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং অপরাধ প্রমাণ হলে তিন বছরের জেল হেপাজতের নির্দেশ দেওয়া হয়।


৭) ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৮- বিরোধীরা রাজ্যসভার নির্বাচিত প্যানেলের দ্বারা বিলের পুনর্বিবেচনার আর্জি জানায়। ২০ জুন, ২০১৯ - রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ সমস্ত রাজনৈতিক দলকে তিন তালাক বিল পাশের আর্জি জানান। ২০ জুন, ২০১৯ - রাজ্যসভায় পেশ হয় মুসলিম মহিলা (বিবাহের অধিকারের সুরক্ষা) বিল। ২১জুন, ২০১৯- লোকসভায় পেশ হয় মুসলিম মহিলা (বিবাহের অধিকারের সুরক্ষা) বিল ৷ ২৫ জুন, ২০১৯- বিরোধীরা ওয়াক-আউট করে ৷ লোকসভায় পাশ হয় তিন তালাক বিল। 


৮) ৩০ জুলাই, ২০১৯- রাজ্যসভায় পাশ হয় তিন তালাক বিল। অবশেষে ১ অগাস্ট, ২০১৯ - মুসলিম মহিলা (বিবাহের অধিকারের সুরক্ষা) বিল বলবৎ হয়। তিন তালাক কে বেআইনি ঘোষণা করে সুপ্রিম কোর্ট।

পরিশেষে শুধু একটাই কথা রয়ে যায়, যা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলে গেছেন। উনি বলেছিলেন - "বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে, আমরা তখনও বসে/ বিবি তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি, ফিকাহ ও হাদিস চষে।"

বাঙালির, অতীত-বর্তমান- ভবিষ্যৎ -
অভিষেক দে
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:818 | likes:0 | share: 0 | comments:0

দিনকয়েক আগেকার কথা। কিছু প্রয়োজনীয় কাজে গিয়েছিলাম আসানসোলে। বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মা একটা চিরকুটে কয়েকটা জিনিসের নাম লিখে দিয়ে বলেছিল সময় পেলে আসানসোল বাজারে ঢুকে জিনিসগুলো কিনে আনতে। কাজ সেরে বিকেল প্রায় চারটে নাগাদ বাজারে ঢুকে উক্ত জিনিসপত্র কিনতে গিয়ে একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতা হয়েছিল ( অবশ্য এই অভিজ্ঞতা আগেও বেশ কয়েকবার হয়েছে)। এইখানে জানিয়ে রাখি আমার জন্ম এবং বেড়েওঠা আসানসোলে। বর্তমানে দুর্গাপুর শহরে আপাতত স্থায়ী ঠিকানা হলেও, জীবনের ২৯ টা বছর কাটিয়েছি এখানে। শহরটাকে হাতের তালুর মতন চিনি। এখানে অনেকেই আমাকে যেমন বেশ ভালোরকম চেনেন তেমন ভালোওবাসেন। 


যাইহোক মূল প্রসঙ্গে আসা যাক। আসানসোলে বাজারে একটা বহুপুরোনো মাড়োয়ারি ব্যক্তির দোকান রয়েছে। দোকানে নিজস্ব ফ্যাক্টরিতে বানানো বিভিন্ন পাঁপর, চিপস, বিউলিডাল বড়ি ইত্যাদি পাইকারি দরে বিক্রি হয়। দোকানে একজনই কর্মচারী, বাঙালি ( বয়স আন্দাজ প্রায় ২৪)। দোকানে কিছুটা ভীড় থাকায় দাঁড়াতেই হলো। মাড়োয়ারি ব্যক্তিটি তার কর্মচারীকে বারেবারে তাড়া দিচ্ছিল কারন আমাকে বাদ দিলে বাকি সবাই চরম ব্যস্ত যে। দোকানদার, বাঙালি ছেলেটির উদ্দ্যেশ্যে বলছে -"আরে বিট্টু, থোড়া হাত জলদি চালাও। আজ কুছ খায়াপিয়া নেহি ক্যায়া। ইতনা ঢিলা কাম করনে সে তুম মেরা দুকান মে হি তালা লগবা দোগে"। 


খুব খারাপ লাগছিল ছেলেটির এই দুর্দশা দেখে। খোঁজ নিলাম, মাত্র ৪৫০০ টাকা (যা আজকের মুদ্রাস্ফীতির বাজারে অপ্রতুল বলাই যায়) র জন্যে সকাল ৮ টা থেকে রাত ৮ টা পর্যন্ত ( মানে ১২ ঘন্টা) পরিশ্রম করছে এই বাঙালি ছেলে, বিট্টু। না, আমি আর বেশিক্ষণ দাঁড়াই নি। যা কিনতে গিয়েছিলাম সেসব না কিনেই এগিয়েছি অন্য দোকানে। 


আজ এই প্রশ্নটা উঠে আসা খুবই প্রয়োজন যে, বাঙালিরা কি অথবা কেন ব্যাবসায় বিমুখ? বাঙালিদের ব্যাবসা প্রসঙ্গে, কবিগুরুর সমসাময়িক ১৮৬১ সালে জন্মেও আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, বাঙালিদের বুঝতে একটুও ভুল করেননি। তাই হয়তো “ অন্ন সমস্যা ও বাঙালির নিশ্চেষ্টতা ” প্রবন্ধ সমেত নিজের অনেক লেখাতেই সেই সুর স্পষ্ট শোনা গেছে। উনি লিখেছেন- 

“আলস্যের নিদ্রায় সুখের স্বপ্ন” দেখে, "বুদ্ধির অহংকারে অন্ধ হইয়া” জীবন সংগ্রামে ফাঁকি দেয়। ফলে “বাঙালি সকল দিকের সকল ক্ষেত্র হইতে পরাজিত হইয়া পশ্চাদপদ হইতেছে। মাড়োয়ারি, ভাটিয়া, দিল্লীওয়ালা ব্যবসাবাণিজ্যের সকল ক্ষেত্র করতলগত করিতেছে, আর আমরা বাঙালিরা তাদের হিসাব লিখিয়া মাসমাহিনা লইয়া পরমানন্দে কলম পিষিতেছি। বাঙালি শ্রমজীবির দশাও কিছু ভাল নহে।” হিন্দু কেমিস্ট্রির লেখক, বাঙালিদের উদ্দ্যেশ্যে লিখেছেন- “আমাদের জীবনটা যেন দিনগত পাপক্ষয়। শুধু আলস্যের আরাম শয্যায় শয়ন করিয়া আমরা পদে পদে মনুষ্যত্বের লাঞ্ছনা ও অবমাননা করিতেছি। আজ বাঙালির পরাজয় পদে পদে।” 


প্রফুল্লচন্দ্র রায় ১০০ বছর আগে যেমন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তেমনই উনি লিখে গেছেন। তবে ওনার বক্তব্য নিয়ে সামান্য হলেও আলোচনার অবকাশ রয়েছে।

প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালিদের বলেছেন অলস, কুঁড়ে কথাটা কিছুটা ঠিক আবার খানিকটা ভূলও। মাছেভাতে বাঙালিদের একটা বড় অংশ কিন্তু সত্যিই ব্যাবসা বিমুখ। তারা সরকারি (অথবা বে-সরকারি) চাকরিজীবী হয়েই বেঁচে থাকায় অপরিসীম আনন্দ পায়। একটা উদাহরণ দিই। সেটা ২০০৩ সালের ঘটনা। আমার পরিচিত একজন দিদির শ্বশুরের দোকান ছিল আসানসোল বাজারে একেবারে রাস্তার ওপর। দিদির জীবনসঙ্গীর একবার বেশকিছু টাকার প্রয়োজনে ব্যাঙ্ক লোনের জন্য ঘুরেঘুরে নাজেহাল হয়ে শেষে দোতলা দোকানটাই বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয়। আমার বাবা সেই জামাইবাবুকে অনেক বুঝিয়েছিল, দোকান বিক্রি না করে গোডাউন হিসবে ভাড়া দিতে ( দোকানটি ছিল শাড়ি, অন্তর্বাসের। ব্যাবসাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তো পুঁজি প্রয়োজন। আবার পুঁজি থাকলেও যে ব্যাবসা দারুন ভাবে এগিয়ে যাবে এটাও ভুল। লাভ-ক্ষতি নিয়েই ব্যাবসা। তাছাড়া জামাইবাবুদের দোকান সেভাবে চলছিলও না)। কিন্তু একদিন চুপিচুপি সেই দোকানটি একজন হিন্দিভাষী ব্যক্তির কাছে ২২ লক্ষ টাকাতে বিক্রি হয়ে গেলো। প্রিয় পাঠকবন্ধুরা, এখন একটিবার ভাবুন, ২০০৩ সালে যেটা ২২ লক্ষ টাকায় বিক্রি হয়েছিল আজ ২০২২ সালে সেই দোকানের দাম কতটা বৃদ্ধি পেতো? দোকানটি বিক্রি করে সেইটাকা জামাইবাবু কি কাজে ব্যবহার করেছিলেন জানা নেই, তবে বর্তমানে উনি একটি বে-সরকারি সংস্থার অফিসে সকাল ১০টা থেকে সন্ধে ০৬টা পর্যন্ত কাজ করেন ১২ হাজার টাকা মাসিক বেতনে। এইকারনেই কি প্রফুল্লচন্দ্র রায় লিখেছিলেন- “আমরা দোকান করিয়া ফেল মারি। কারণ সর্বপ্রকার কষ্ট সহ্য করিয়া কৃতিত্ব অর্জনের প্রয়াস আমাদের যুবক গণের মধ্যে দেখা যায় না।” 


"বাঙালি ব্যাবসায় বিমুখ অথবা বাঙালিদের দ্বারা ব্যবসা হবে না" কথাগুলো আমি অন্তত মানিনা। আসলে এগুলো একপ্রকার অপপ্রচার এবং খুব সুকৌশলে আমাদের মননে ঢুকিয়ে দেওয়ার কাজ চালানো হয়েছে এবং হচ্ছেও। একসময় কলকাতা শহরজুড়ে বাঙালিদের দোকান ছিল চোখে পরার মতন। তাদের ব্যবসাও ছিল রমরমা। কিন্তু আজ সেসব অতীত। এখন পশ্চিমবঙ্গে মাড়োয়ারি, গুজরাটি কিংবা বিহার, উত্তরপ্রদশ থেকে আগত 'বেওসায়ীরা' তাদের ব্যবসা বৃদ্ধি করে ফুলেফেঁপে উঠলেও বাঙালিরা যে তিমিরে ছিল সেই তিমিরেই আটকে রয়েছে। বাঙালিদের একটা বড় অংশের আজ নিজের মাতৃভাষার বদলে হিন্দিপ্রীতি উত্তরোত্তর বৃদ্ধিও পাচ্ছে। ভারতীয় সংবিধান কোনো রাষ্ট্রভাষা না থাকলেও খুব কৌশলে হিন্দিকে ভারতের রাষ্ট্রভাষা বানানোর কাজ চলছে, চলবেও। দুঃখের বিষয় বাঙালিরাও এটা একপ্রকার প্রচার চালাচ্ছেন। আজ উচ্চবিত্ত বাঙালি পরিবার তাদের সন্তানদের নামীদামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তী করিয়ে অত্যাধুনিক বানানোর একটা প্রয়াসও লক্ষ্য করা যাচ্ছে কারন " আমার সন্তানের বাংলাটা ঠিক আসেনা " জাতীয় কু-যুক্তিও শোনানো হচ্ছে। 


আরেকটি গুরুতর বিষয় হচ্ছে, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে তরুণতুর্কী বাঙালি ছেলেমেয়েরা যখন হাতে অস্ত্র তুলে লড়াইয়ের ময়দানে, তখন কিছু বেইমান বাঙালি ব্রিটিশদের তাঁবেদারি করতে ভীষণ ব্যাস্ত ছিলেন। উদাহরণ হিসেব বলা যায়, মাস্টারদা সূর্যসেনের মাথার দাম যখন ব্রিটিশেরা ১০০০ টাকা ধার্য করে তখন শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ব্রিটিশদের দেওয়া ৬০ টাকার চাকরি করতেন এবং মাস্টারদা কে ধরিয়ে দিতে বিশেষ ভাবে সক্রিয় হয়ে উঠেছিলেন। যখন অসংখ্য তরুণ প্রাণ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অকালে ঝড়ে যাচ্ছিল তখন একদল বেনিয়ারা ব্রিটিশদের পদলেহন করে সুদের টাকা গুনে মুনাফা কামানোর দিকে বেশি নজর ছিল। পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষে অসহায় জনগণ যখন সামান্য ভাতের ফ্যানের জন্য হাহাকার করছে তখনও এই বেনিয়াদের দল অগুনতি লাশের ওপর দাঁড়িয়ে চালের কালোবাজারি করেছে এবং বলে গেছে 'বাঙালি লোগো সে বেওসা নেহি হোগা। উ লোগ মাছলিভাত খাকে গেহেরি নিন্দ মে যানে ওয়ালা বড়াহি আলসি কিসম কা জাতি হায়'।


পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল হয়েছে। কিন্তু বাঙালিদের সুদিন কি সত্যিই ফিরেছে? ফিরলে আজ সেই বিট্টু অন্যের দোকানে ৪৫০০ টাকা রোজগারের জন্য এতো পরিশ্রম না করে হয়তো নিজস্ব দোকানে কোনো ব্যবসা করতো, নিদেনপক্ষে মুদিখানা। 


কয়েকমাস আগে বন্ধু সুপ্রিয়র সাথে হাওড়া গিয়েছিলাম দিল্লিগামী ট্রেন ধরবো বলে। হাওড়া ব্রিজের (রবীন্দ্রসেতু) ওপর দাঁড়িয়ে বন্ধুটি বলছিল - "ব্রিটিশদের আমরা যতই গাল পারি তাদের উগ্রতা ও ফ্যাসিস্ট আচরণের জন্য, কিন্তু এটা মানতেই হবে তারা নিজেদের প্রয়োজনে দেশটাকে খোলনলচে বদলেছিল অনেকটাই। এই যেমন হাওড়া ব্রিজের কথাই ধরা যাক। অসংখ্যা গাড়ি যানবাহনের ভার নিয়েও ব্রিজটা আজও কেমন সুন্দর ভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ বর্তমানে কোনো ব্রিজের টেন্ডার ডাকা হলে সেটা অন্যরাজ্যের লোকেরা এসে বানাচ্ছে। এই বানানোতেও কোটিকোটি টাকার দুর্নীতি আর ব্রিজটাও তেমন টেকসই হয়না।উদাহরণ, বিবেকানন্দ সেতু।" 


বন্ধু সুপ্রিয়র কথাগুলো খুব ভুল নয়। আজ দুর্নীতি সর্বগ্রাসী। এই রাজ্যের শ্রমিকেরা নিজেদের সংসারে দুমুঠো অন্ন তুলে দিতে অন্য রাজ্যে পাড়ি দিতে বাধ্য হয় অথচ অন্যে রাজ্যের শ্রমিকেরা এখানে সুন্দর ভাবে কাজ করে অন্নসংস্থান করছে ( মালদহ, মুর্শিদাবাদ ইত্যাদি অঞ্চলের অনেক হিন্দু বাঙালি বা বাঙালি মুসলিমরা কাজের জন্যে ভীন রাজ্যে যায় না এটাকে কেউ অস্বীকার করতে পারবে না)। আজ কলকাতার বড়বাজার থেকে হাওড়া, ডানকুনি, রানিগঞ্জ, আসানসোল প্রায় সর্বত্র মাড়োয়ারি, গুজরাটি দের রমরমা ব্যাবসা এবং সেখান থেকে কোটিকোটি আয়। 


দিনেরশেষে এই প্রশ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়ায় যে, বাঙালিরা কি পারবে সেই হারানো দিনগুলোকে ফিরিয়ে আনতে? অলস, কুঁড়ে ইত্যাদির তকমা পাওয়া মাছেভাতে বাঙালিরা কি পারবে ব্যাবসায়ী রুপে প্রতিষ্ঠিত হতে? মাড়োয়ারি, গুজরাটিরা যেভাবে এই রাজ্যে শেকড়গেঁড়ে বসে কোটিকোটি টাকা ব্যাঙ্কে ভরছে, ঠিক তেমন কিছু কি বাঙালিরাও পারবে? 


লেখাটি শেষ করবো দেশের ডাক বইএ তরুণের স্বপ্ন প্রবন্ধে (পৃ. ৬-১০) সুভাষচন্দ্র বসুর একটি দারুন উক্তি দিয়ে যা উনি ১৯৩৮ সালে লিখেছিলেন। " অনেকে দুঃখ করে থাকেন, বাঙ্গালী মাড়োয়ারী বা ভাটিয়া হলো না কেন? আমি কিন্তু প্রার্থনা করি, বাঙ্গালী যেন চিরকাল বাঙ্গালীই থাকে। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, “স্বধর্ম্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরোধর্ম্ম ভয়াবহঃ”। আমি এই উক্তিতে বিশ্বাস করি। বাঙ্গালীর পক্ষে স্বধর্ম্ম ত্যাগ করা আত্মহত্যার তুল্য পাপ।"

আক্রান্ত মুক্তচিন্তকরা -
অভিষেক দে
Nov. 20, 2024 | যুক্তিবাদ | views:8790 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ফ্ল্যাশব্যাক ১) দিনটা ছিল ১৬০০ খ্রিস্টাব্দের ১৭ ই ফেব্রুয়ারী।মানবসভ্যতার ইতিহাসে এক কালো দিন হিসেব আজও যা চিহ্নিত। এই দিনে জিওর্দানো ব্রুনোকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করেছিল ধর্মের ধ্বজাধারী রক্ষকরা। বড় নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় তাকে। শেষ কথা বলার সুযোগই তাঁকে দেওয়া হয়নি। একটা দন্ডের সাথে পেছনে হাত বেঁধে, জিহ্বায় একটা পেরেক ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল যাতে ব্রুনো কোনোরকম শব্দ করতে না পারে। তারপর তাকে জীবন্ত আগুনে পুড়িয়ে হত‍্যা করেছিলো সেসময়ের ধর্ম যাজকরা। মৃত্যুর আগে কারাগারে আট বছর তাঁর উপর চলেছিল নির্মম অত্যাচার। ব্রুনোর অপরাধ, তিনি ছিলেন মুক্তচিন্তাকারী। অন্ধের মতন কোনোকিছু না মেনে সবেতেই প্রশ্ন তুলতে ভালোবাসতেন। ১৫৯১ সালে তিনি ইতালি ফিরে আসার কিছুদিন পর জিওভাননি মচেনিগো নামক একজন ব্যক্তি ব্রুনোর বিরুদ্ধে ধর্ম ও ঈশ্বর বিরোধীতার অভিযোগ আনেন। ১৫৯২ সালের ২২ মে ব্রুনোকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁকে ভেনিশিয়ান ইনকুইজিশনের মুখোমুখি করা হয় (ইনকুইজিশন হলো রোমান ক্যাথলিক গির্জার একটি বিচার ব্যবস্থা, যেখানে ধর্ম অবমাননাকারীদের বিচার করা হতো)। ব্রুনো খুবই দক্ষতার সাথে তাঁর বক্তব্য আদালতে উপস্থাপন করেন ও তাঁর বিরোধীতাকারীদের যুক্তি খণ্ডন করেন। বেশ কয়েক মাস ধরে জেরা চলার পর ১৫৯৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ব্রুনোকে রোমে পাঠানো হয়। সাত বছর ধরে রোমে ব্রুনোর বিচারপর্ব চলতে থাকে। এসময়ে তাঁকে নোনা টাওয়ারে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সেই মহা ঐতিহাসিক বিচারকাজের গুরত্বপূর্ণ কিছু নথি হারিয়ে গিয়েছে। বেশিরভাগই সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছিল এবং ১৯৪০ সালে বিচারকাজের সেসময়ের একটি সার-সংক্ষেপ পাওয়া যায়। এতে তাঁর বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগগুলো ছিল- (১) ক্যাথোলিক ধর্মমত ও ধর্মীয় গুরুদের মতের বিরুদ্ধে মতপ্রকাশ (২) খ্রিস্টীয় ধর্মমত অনুসারে স্রষ্টার ত্রি-তত্ত্ববাদ, যীশুর মৃত্যু ও পরে আবার শিষ্যদের কাছে দেখা দেয়ার বিষয়গুলো বিশ্বাস না করা (৩) যীশু ও তাঁর মা মেরিকে যথাযথ সম্মান না করা (৪) এই মহাবিশ্বের মতো আরো মহাবিশ্ব আছে, পৃথিবী গোল, সূর্য এই মহাবিশ্বের কেন্দ্র নয় এবং এটি একটি নক্ষত্র ছাড়া আর কিছু নয়- এই ধারণা পোষণ করা। 


সেদিনের ধর্মযাজক আজ নেই। নেই সেখানে উপস্থিত সেইসব জনতারাও যারা ব্রুনোকে হত্যার সময় উল্লাসিত হয়েছিল। ব্রুনোকে তারা খুন করেছিল ঠিকই কিন্তু ব্রুনো মারা গিয়ে এই প্রশ্নটা রেখে গেলো যে, "মুক্তচিন্তকদের হত্যা করেও কি মুক্তচিন্তার গতিকে রোধ করা কি আদৌ সম্ভব?"


ফ্ল্যাশব্যাক ২) " সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক, প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানহীন, সেখান কোনো ধর্মগুরুর জীবনীপাঠও বন্ধ হোক। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষার্জন করুক, বৃদ্ধি পাক তাদের জ্ঞানের উন্মেষ, তারা হয়ে উঠুক মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক এবং মানবতাবাদী "। 


ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি ( Science and Rationalists’ Association of India)  দীর্ঘবছর ধরে ওপরের দাবীগুলোতে সরব। কিন্তু চাইলেই তো আর সবকিছু খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব নয়। সুভাষচন্দ্র বসু বলেছিলেন- "স্বাধীনতা কেউ দেয় না, ছিনিয়ে নিতে হয়"। অনেকটা সেইরকম ব্যপার। 

স্বাভাবিক ভাবেই যুক্তিবাদী সমিতির এই দাবীদাওয়া আজও মেনে নিতে পারেনি শিক্ষকসমাজের একাংশ এবং বেশকয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন। ২০০১ সাল থেকে যুক্তিবাদী সমিতির পুরুলিয়া শাখার সম্পাদক এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চিঠি দিয়ে অনুরোধ জানিয়েছেন সরকারি ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে সরস্বতী পুজো ও নবী দিবস পালনকরা বন্ধ হোক। এইকাজ করতে গিয়ে প্রতিপদে বাঁধা এসেছে, মধুসূদন মাহাতোকে প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে ফোনও এসেছে তবুও যুক্তিবাদী সমিতির সহযোদ্ধারা নিজেদের দাবী এবং লক্ষ্যে আজও অবিচল। সুভাষচন্দ্র বসুর একটি উক্তি এখনে স্মরণ করা যাক। উনি বলেছিলেন- "জীবনে সংগ্রাম আর ঝুঁকি না থাকলে জীবনে বেঁচে থাকাটাই ফিকে হয়ে যায়"। 


গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে সামান্যতম হলেও আলোর দেখা পাওয়া গেছে। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ সালে "এইসময়" পত্রিকার অনলাইন পোর্টালে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম- "বিশ্ববিদ্যালয় 'ধর্মনিরপেক্ষ', মিলল না সরস্বতী পুজো করার অনুমতি"। সরস্বতী পুজো আয়োজনের অনুমতি দিল না কেরালার এক বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রীরা পুজো করতে চাওয়ায় কর্তৃপক্ষ জানিয়ে দিল, বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মনিরপেক্ষ, সেখানে পুজোর অনুমোদন দেওয়া যাবে না। এরই পাশাপাশি বেশকয়েকটি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় এগিয়ে এসেছে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সমস্তরকম ধর্মীয় অনুষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে। অন্যদিকে, সরকারি প্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজো বন্ধ করার খবর দিল্লির মোট ১০/১৫ টি খবরেরকাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। রইলো কিছু লিংক -1) http://www.sabguru.com/yukthivadi-samiti-demands-to-stay-on-saraswati-puja-in-govt-schools/

2) http://www.matnews.in/national/11330


ফ্ল্যাশব্যাক ৩) ৯ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ দিনটি কালোদিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেলো একটি সংবিধানে উল্লেখিত 'ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে'। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতির ত্রিপুরার কমলপুর শাখার অন্যতম সংগঠক সহযোদ্ধা দুলাল ঘোষ, মদ্ভাগবদগীতা থেকে রেফারেন্স তুলে কিছু প্রশ্ন রেখেছিলেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। খুব স্বাভাবিকভাবে এটি ভালোভাবে গ্রহণ করতে পারেনি কট্টর ধার্মীক বা ব্রাহ্মণ্যবাদীরা। তাই উন্মত্ত ধার্মীকদের দল চড়াও হয় দুলাল বাবুর বাড়ি। আসবাবপত্র ভাঙচুর থেকে দুলাল বাবু এবং তার পরিবারেকে হেনস্তা ও শারীরিক নিগ্রহ করে। এরপরে দুলাল ঘোষের পরিবার কমলপুর থানার অফিসার ইনিচার্জকে সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ জানিয়ে চিঠি লেখেন। চিঠির প্রতিলিপি পাঠানো হয়, SDM- Kamalpur Dhalai, SDPO -Kamalpur Dhalai, DM-Dhalai Ambassa, SP- Dhalai Ambassa সহ বেশকয়েকটি যায়গায় ও মিডিয়ায়। উক্ত ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিল, ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি, ত্রিপুরা যুক্তিবাদ বিকাশ মঞ্চ, ত্রিপুরা বিজ্ঞান মঞ্চ সমেত অনেকগুলো সংগঠন। শোনা গেছে, পুলিশ প্রশাসনের অপদার্থতায় অপরাধীরা নাকি এখনও বুক ফুলিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। 


ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় খন্ডে, নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন - (১) সাম্যের অধিকার, (২) স্বাধীনতার অধিকার, (৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (৪) ধর্মীয় অধিকার ( সংবিধান আমজনতাকে দিয়েছে ধর্মপালন বা ধর্মাচারণ করার স্বাধীনতা কিন্তু সেটা কখনওই প্রকাশ্যে নয় বরং একান্তে এবং অবশ্যই উগ্রতাবিহীন) (৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, (৬) শাষনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার। ভারতের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে চালু হয়। এবং ১৯৭৬-সালের ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতের সংবিধানে ' Secular ' শব্দটা যুক্ত হয়। ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধের ( Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে ' ধর্মনিরপেক্ষ ' ( Secular) শব্দটি ব্যাবহার করা হয়। যেখানে বলা হয়েছে - "We The People Of India, having solemnly resolved to costitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens;" অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি। আবার সংবিধান জানাচ্ছে, প্রতিটি নাগরিকদের কর্তব্য হচ্ছে বিজ্ঞানমনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। "It shall duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform.{Article 51A(h)Part iv A}"। দুলাল বাবু সংবিধানকে সম্মানে করেন বলেই আর্টিকেল ৫১ এ(এইচ) পার্ট-৪এ কে স্মরণে রেখেই মদ্ভাগবদগীতা থেকে শুধু প্রশ্ন তুলেছিলেন যেটা খুবই স্বাভাবিক বিষয়। কারন, একমাত্র মুক্তমনারা কোনোরকম অন্ধবিশ্বাসে বশ না হয়ে প্রশ্ন তোলেন, সঠিক প্রমাণভিত্তিক যুক্তি খোঁজেন অন্যদিকে সবকিছু বিনাপ্রশ্নে মেনে নেওয়া ধার্মীকদের স্বভাব।  


সেদিন দুলাল ঘোষ সমেত অনেকেই প্রশ্ন তুলেছিলেন, "চমকে,ধমকে, অস্ত্র দেখিয়ে কিংবা কোপ মেরে কি মুক্তচিন্তকদের কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা যায়?"


ফ্ল্যাশব্যাক ৪) সম্ভবত ২ ফেব্রুয়ারী ২০২২ থেকে হিন্দুধর্মের শাস্ত্র-গ্রন্থ থেকে তথ্য তুলে ধরে সরস্বতীপুজো সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করেছিলেন গবেষক, সুলেখক এবং দলিতদের ন্যায্য অধিকারের দাবীদাওয়া নিয়ে আন্দোলনকারী শরদিন্দু বিশ্বাস ওরফে শরদিন্দু উদ্দিপণ। ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি র মতন উনিও দাবী জানিয়েছিলেন সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক ধর্মমুক্ত সেখানে সমস্তরকম  ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মগুরুদের জীবনী পাঠ বন্ধ হোক। এতে ধর্মানুভূতী আক্রান্ত হয় ধার্মীকদের। শাস্ত্রগ্রন্থর সত্য ( যা ধর্মবেত্তা কিংবা ব্রাহ্মণরা জানাতে চায় না) প্রকাশ পাওয়া দেখে ভীত হয়ে তারা কলকাতা সাইবার ক্রাইম ব্রাঞ্চে অভিযোগ জানায় এবং নরেন্দ্রপুর থানায় এফআইআর করে। এরফলে ০৩/০২/২০২২ সকাল সাড়ে বারোটা নাগাদ নরেন্দ্রপুর থানার সাব-ইন্সপেক্টর সুশোভন সরকারের নেতৃত্বে একদল পুলিশ শরদিন্দু বাবুর বাড়ির দরজায় গিয়ে ডাকেন এবং দরজা খুলে দিলে শরদিন্দু বাবুকে ধাক্কা মেরে বিনা নোটিশে ওনার ঘরে ঢুকে টেবিল থেকে মোবাইল তুলে নেয় এবং ল্যাপটপ, বইপত্র ইত্যাদি ঘাটতে শুরু করেন। অবশেষে জোরপূর্বক তাঁকে নরেন্দ্রপুর থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। 


ঐদিনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ উপেক্ষা করে শরদিন্দু বাবুর অনুগামীরা ও শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধুরা নরেন্দ্রপুর থানায় ধিরে লধিরে জড়ো হতে থাকেন এবং কলকাতা হাইকোর্টের একাধিক বড়বড় উকিল এসে থানার বড়বাবুকে প্রশ্ন করা শুরুকরলে অবশেষে ৬ ঘন্টা পর শরদিন্দু বাবুকে এফআইআর এর কপিতে সই করিয়ে থানা থেকে ছাড়া হয়। ওনার নামে আইপিসি ৫০৪, ৫০৫ ধারায় মামলা রুজু হয়। গত ০৭/০২/২০২২ তারিখে তিনি কোর্টে উঠলে তাঁকে জামিন দেয়া হয়। 


গত ০৮/০২/২০২২- এ, AISA, APDR, AIPWA, CPI(ML) লিবারেশন সহ বেশকয়েকটি গণসংগঠনের সদস্যরা নরেন্দ্রপুর থানায় গিয়েছিলো শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দেখাতে ওই অন্যায় গ্রেফতারের প্রতিবাদে। কিন্তু 

কর্তব্যরত পুলিশ অফিসাররা বিক্ষোভকারীদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায়। শোনা গেছে ছাত্র সংগঠন AISA-র মহিলা কর্মীদের ওপর পুরুষ পুলিশরা অত্যাচারও নাকি করেছেন ( যেটা আআইনত দণ্ডনীয় অপরাধ)। এছাড়া সেদিনই সিপিআই(এম-এল) লিবারেশন দলের রাজ্য কমিটির নেতা মলয় তেওয়ারীসহ ১৫ জনকে পুলিশ গ্রেফতারও করে। এই ঘটনাগুলো প্রামাণ করে মুক্তচিন্তকদের ওপর এভাবেই আঘাত চলছে, চলবেও। 


খ্রিস্টজন্মের ৫০০ বছর আগে পিথাগোরাস, এনাকু, সিমেন্ডের মতো গ্রীক অনুসন্ধিৎসু পণ্ডিতেরা জানিয়েছিলেন, পৃথিবী সূর্যের একটি গ্রহ, সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী ও অন্য গ্রহগুলো ঘুরছে। এইকথাগুলো বলবার বিনিময়ে ধর্ম- বিরোধী, ঈশ্বর- বিরোধী, নাস্তিক মতবাদ প্রকাশের অপরাধে এঁদের বরণ করতে হয়েছিল অচিন্তনীয় নির্যাতন, সত্যের ওপর অসত্যের নির্যাতন, ধর্মের নির্যাতন। 

উক্ত মতকে ২০০০ বছর পরে পুস্তকাকারে তুলে ধরলেন পোল্যান্ডের নিকোলাস কোপারনিকাস। তাঁরই উত্তরসূরি হিসেবে এলেন জিওর্দানো ব্রুনো, গ্যালিলিও গ্যালিলি সহ অনেকেই। প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেন বৈজ্ঞানিক সত্যকে — "সূর্যকে ঘিরে আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীসহ গ্রহগুলো"।


বিগত কয়েক দশকে আমরা দেখেছি মুক্তচিন্তকদের ওপর কট্টর ধার্মীকদের আক্রমণ। আমরা হারিয়েছি- অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু, নিলাদ্রি চট্টোপাধ্যায় (নীলয় নীল), অনন্ত বিজয় দাস, ফয়সাল আফেরিন দীপন,

নাজিমুদ্দিন সামাদ, রাজিব হায়দার,শাফিউল ইসলাম, শাহজাহান বাচ্চু, রেজাউল করিম সিদ্দিকি, জুলহাজ মান্নান, মাহবুব রাব্বি তনয়, মহম্মদ শহীদুল্লাহ, মীর সানাউর রহমান, গোবিন্দ পানসারে, এম.এম.কালবুর্গি, গৌরী লঙ্কেশ, নরেন্দ্র দাভলকার সহ অনেকে। কিন্তু এতো হত্যা করেও কি মুক্তচিন্তকদের অগ্রগমন রোধ করা গেছে কি? কট্টরপন্থী ধার্মীক বা মৌলবাদীদের কাছে এই প্রশ্ন রেখে গেলাম। 


পরিশেষে জানাই, যুক্তির বা সত্যের পথে অনেক কাঁটা বিছানো। তবুও আমরা চলেছি সমস্ত বাঁধা অতিক্রম করেই। আজ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার বিচারে নাস্তিক /অধার্মিক / যুক্তিবাদীরা তৃতীয় স্থানে ( সূত্র- মনোরমা ইয়ারবুক ২০১৯। যাকে মান্যতা দেয় ওয়ার্ল্ড অ্যালম্যানাকও)। ২০১২ সালের 'উইন গ্যালপ গ্লোবাল ইনডেক্স অফ রিলিজিয়ন রিপোর্ট' অনুযায়ী ভারতের মোট জনসংখ্যার ৩ শতাংশ ছিল ঘোষিত নাস্তিক। এই হিসেবে ১৩০ কোটির ভারতে নাস্তিকদের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি ৯০ লক্ষ। মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষের জয় নিশ্চিত। তাদের দুর্বার গতিকে আটকানোর সাধ্য নেই কারোরই।

বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের সাথে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্নোত্তর


[হৃদয় মন্ডলকে এই প্রশ্নোত্তরের ভিডিওটির জন্য গ্রেফতার করা হয়, পরবর্তীতে মুক্তচিন্তকদের চাপে জামিন দিতে বাধ্য হয়]

মুন্সিগঞ্জ সদরের বিনোদপুর রামকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণীর ছাত্রদের সাথে তাদের বিজ্ঞানের সিনিয়র বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মন্ডলের সাথে ধর্ম ও বিজ্ঞান নিয়ে প্রশ্নোত্তরের একটি ভিডিও সম্প্রতি আলোচনায় এসেছে।  প্রায় ১৩ মিনিটের এই টেপটি ওই ক্লাসের ছাত্রদেরই রেকর্ড করা, যেটা পরে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়। শিক্ষক ও ছাত্রের প্রশ্নোত্তরের পুরো ট্রান্সক্রিপটি আজ পড়লাম। এইটা যদি উদ্যেশ্যপ্রণোদিত না হয়ে স্বপ্রনোদিত হয়ে জানার আগ্রহ থেকে হতো তাহলে এইটা হতে পারতো একটা উদাহরণীয় ছাত্র শিক্ষকের প্রশ্নোত্তর। 

আমি অনেকটা নিশ্চিত  করে বলতে পারি, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের অনেক শিক্ষকও এতটা ধৈর্যের সাথে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে এমনভাবে ছাত্রদের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারতো না। আমি আরো হলপ করে বলতে পারি বাংলাদেশের খুব কম শিক্ষার্থীদের কপালেই এমন অসাধারণ বিজ্ঞানের শিক্ষক জুটেছে। কিন্তু এইখানে এমন ঘটনা ঘটেছে যা কোন সভ্য দেশে কল্পনাতীত। এমনকি ১০-২০ বছর আগের বাংলাদেশেও কল্পনাতীত। এখানে নতুন একটি ঘটনা ঘটে। দশম শ্রেণীর সেই ক্লাসের কোন এক ছাত্র গোপনে হৃদয় বণিকের এই বক্তব্য রেকর্ড করে। চিন্তা করে দেখুন কেমন মানের ছাত্র আমরা এখন পয়দা করছি যে আপন শিক্ষককে বিপদে ফেলতে ইচ্ছে করে শিক্ষককে প্রশ্ন করা হয় এবং উদ্যেশপ্রণোদিত ভাবে সেই প্রশ্নের উত্তর রেকর্ড করা হয়। 

হৃদয় মন্ডলের সাথে শিক্ষার্থীদের প্রশ্নোত্তর পড়ে আমার মনে হয়েছে এই শিক্ষককে বাংলাদেশের সেরা শিক্ষক হিসাবে ঘোষণা করা উচিত। অথচ যেই কারণে তার সেরা শিক্ষক হওয়ার কথা সেই কারণে সে নিগৃহীত হচ্ছে। নিচে প্রশ্নোত্তরের কথোপকোটনটি কাট & পেস্ট করলাম। যেটি পড়লে জানবেন যে শিক্ষার্থীরা এক পর্যায়ে শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে "প্যারাডক্সিক্যাল সাজিদ"  বই পড়তে উপদেশ দিচ্ছে। এই বইই আমাদের নতুন প্রজন্মকে শেষ করে দিচ্ছে। এই বই পড়ে আমাদের নতুন প্রজন্ম বিজ্ঞান বিমুখ হচ্ছে। অথচ এই বইকে আমাদের বিজ্ঞানের বড় বড় শিক্ষকরাও প্রমোট করছে। এরা নিজেরাতো কূপমণ্ডূকতায় ভুগছেই সাথে আমাদের আগামী প্রজন্মকে অন্ধকারে ধাবিত করছে। 

"[00:00]

স্যার: কেউ দেখেছে? কোন কিছুইতো কেউ দেখেনি। এটা তারা বিশ্বাসের উপর রেখেছে। তোমরা যখন বিজ্ঞান আরো পড়বে তখন দেখবে বিজ্ঞানে আরো কতকিছু আসছে। আসলে আমরা বুঝে উঠতে পারি না বা চাই না সত্য জানতে। দেখো উন্নত বিশ্ব ধর্ম থেকে সরে যাচ্ছে। আর আমরা ধর্মান্ধ হচ্ছি।

[00:35]

ছাত্র: বহু ধরনের কথা ও থিওরিতো ধর্ম থেকেই এসেছে। বিজ্ঞানীরা ধর্ম থেকে এসব আবিস্কার খুঁজে পেয়েছেন।

স্যার: কোন কথা ধর্ম থেকে নেয়া হয়নি। কোনভাবেই না। বরং বিজ্ঞান থেকে নিয়ে ধর্ম চলছে, ধর্ম বানানো হয়েছে।

[01:10]

ছাত্র: আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) বহু বিজ্ঞানের সকল উৎস দিয়ে গেছেন। সাড়ে চার হাজার বছর আগে আমাদের হযরত মোহাম্মদ (স:) এসব বিজ্ঞানের কথা বলে গেছেন।

স্যার: সাড়ে চার হাজার বছর আগে কীভাবে? হযরত মোহাম্মদ তো ছিলেন সাড়ে  চৌদ্দশো বছর আগে। বিজ্ঞানীরা আবিস্কার শুরু করেছেন বহু আগে থেকে। মানে হযরত মোহাম্মদের আমল থেকেই বিজ্ঞান শুরু হয়েছে এমনটা তো নয়। 

[01:30]

ছাত্র: হ্যাঁ স্যার, হযরত মোহাম্মদ (স:) এর পূর্বে যারা বলে গিয়েছেন তাদেরটায় কোন যুক্তি পাওয়া যায়নি। কিন্তু আমাদের নবী হযরত মোহাম্মদ (স:) যা বলে গেছেন তা সব যুক্তিপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছে৷

স্যার: হযরত মোহাম্মদ এমন কী  বলে গেছেন যার প্রমাণ বিজ্ঞানীরা তার কাছ থেকেই পেয়েছেন? এমন কোন আবিস্কার ছিলো যা বিজ্ঞানীরা আগে করতে পারেননি?

এটা বিজ্ঞানের ক্লাস, ধর্মের ক্লাস নয়। বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে প্রমাণিত। আর ধর্ম হচ্ছে বিশ্বাস।

[02:00]

ছাত্র: স্যার আছে, অনেক প্রমাণ আছে যে ধর্মই বিজ্ঞানসম্মত।

স্যার: ধর্মের কোন প্রমাণ নেই। শেষমেশ ধর্মের ব্যখ্যা কোথায় যায় জানো? শেষমেশ ওই ঈশ্বর দেখে, ঈশ্বর সমাধান দেবেন, পরকালে বিচার হবে। এসব বিশ্বাসের বিষয়। কোন প্রমাণ নেই৷

[02:15]

ছাত্র: একটি বই আছে, পড়বেন। নাম হচ্ছে ‘থিওরি অব এভরিথিং’। পাবেন ডিমের ভেতর কুসুম কীভাবে আছে তা আল্লাহ আগেই বলে দিয়েছে৷ 

স্যার: আমি সব পড়েছি। না পড়লে কি বিজ্ঞান পড়ানোর শিক্ষক এমনিই হয়েছি? এগুলো সব গোঁজামিল দাবী। ওই বইয়ে এমন কিছুই লেখা নেই। বস্তুত ধর্ম মানুষের লেখা৷ সব ধর্ম মানুষের লেখা।

[02:45]

ছাত্র: স্যার বিজ্ঞানও তো মানুষের লেখা৷ 

স্যার: হ্যাঁ বিজ্ঞান অবশ্যই মানুষের লেখা। 

[02:55]

ছাত্র: স্যার, ধর্মের প্রমাণ আছে।

স্যার: ধর্মের কী প্রমাণ আছে আমাকে দেখাও।  

[02:04]

ছাত্র: কী যে বলেন স্যার! সারা বিশ্বে মুসলিমদের নিয়ে গবেষণা হয়েছে। সবাই দেখে ইসলামই সত্য। এটাই সত্য ধর্ম আর বাকি সব মিথ্যা। এটা বিজ্ঞানীরা প্রমাণ পেয়েছে।

স্যার: কোরআন যদি বিজ্ঞানের উৎস হয়ে থাকে তবে দেখাও কোরআন পড়ে কতজন বিজ্ঞানী হয়েছেন? পৃথিবীর ৯০% বিজ্ঞানী খ্রিষ্টান বা খ্রিষ্টান পরিবার থেকে আসা। 

[03:24]

ছাত্র: স্যার আমরা যেটাকে ধর্ম বলছি, এটাকে যদি আমরা [বিজ্ঞানের] দিকে নিয়ে যাই তবে সেটাই বিজ্ঞান। আর যদি বিজ্ঞানকে ধর্মের দিকে নিয়ে যাই তবে ওটাই বিজ্ঞান। মূল কথা হচ্ছে দুটোই এক জিনিস।

স্যার: এই যে খ্রিষ্টানরা এতোকিছু আবিস্কার করে, তাদের ধর্মের নিয়ম সেভাবে কেউই মানে না। তারা কি ধর্ম ব্যবসা করতে পারে না? অবশ্যই পারে। তারা ধর্ম ব্যবসা করছে কি? তারা ধর্মের ধারেকাছেও নেই। তারা আছে আবিস্কার নিয়ে৷ এই মুসলমানরা এগিয়ে যেতে হলে জ্ঞান-বিজ্ঞানে এগিয়ে থাকতে হবে৷ ধর্মান্ধতা বাড়লে সেটা সম্ভব নয়৷ এই চৌদ্দ শত বছর আগে ইসলাম এসেছে। বিজ্ঞান উন্নত হয়েছে ২০০ থেকে ৩০০ বছরে৷ তাহলে এতোদিন হুজুররা কী করেছেন? কী আবিস্কার করেছেন তারা? 

[04:40]

ছাত্র: শুরু থেকেই হুজুররা যা বলতেন তাই বিজ্ঞান হিসেবে মেনে নেয়া হতো। 

স্যার: তোমাদের হুজুররা বিজ্ঞানের কী পড়েছেন? কী জানেন? তারাতো বিজ্ঞান পড়েইনি সে অর্থে। এই যে ডারউইনের কথা বললাম, ডারউইন কি ধর্ম পড়ে বিজ্ঞানী হয়েছেন? 

[05:08]

ছাত্র: স্যার, ডারউইন যে ধর্ম পুস্তক পড়েনি তার প্রমাণ কী স্যার? 

স্যার: আরেহ ধর্ম পুস্তক পড়েই না ওরা বেশিরভাগ।

[05:10]

ছাত্র: স্যার, নাস্তিক ঠিক আছে। কিন্তু ওরা ধর্মের পুস্তক পড়েই এসব আবিস্কার করেছে। ধর্মের প্রমাণ পেয়েছে ওরা। 

স্যার: আরেহ আবিস্কারগুলো ধর্ম পুস্তক থেকে আসেইনি। কোন সুরা কোন হাদিসে আছে আবিস্কারের কথা? আবিস্কারের সূত্র? ধর্মটাতো কাল্পনিক বিশ্বাস। বাস্তবতার সাথে ওর সম্পর্ক কী? হ্যাঁ স্রষ্টা আছেই। স্রষ্টা না থাকলে গাছপালা কোথা থেকে এলো? এই গাছপালাগুলো তো মানুষ সৃষ্টি করেনি। মাটি মানুষ তৈরি করতে পারে না। মায়ের পেটে বাচ্চা মানুষ তৈরি করতে পারে না, ডিম থেকে বাচ্চা হওয়া। পাওয়ারতো থাকতে পারে। পাওয়ার থাকলে সেটা কার? সেটাই আল্লাহ, সেটাই ঈশ্বর। এই যে হযরত মোহাম্মদ। এরা কী? এরা হইলো মহাপুরুষ। এরা কেউ ঈশ্বর নন। 

[06:15]

ছাত্র: এরা আমাদের জ্ঞান দিয়েছেন।

স্যার: নৈতিক জ্ঞান হয়ত। ধর্ম মানুষকে জীবনযাপন এর কিছু নিয়ম বলে দেয়। মানুষ সেটা পালন করে। এর বাহিরে কি কিছু নেই? অবশ্যই ধর্ম পুস্তকের বাহিরে অনেক কিছুই আছে৷ ধর্ম এসেছেই মানুষকে শৃঙ্খলায় রাখার জন্য। আর কোন কিছুর জন্য নয়।

এই যে স্রষ্টা আছে বলা হয়, আমরাতো দেখিনি। যে জিনিস দেখিনি সে জিনিস নিয়ে মারামারি কাটাকাটির কোন মানে আছে? তোমার বিশ্বাস তোমার বিশ্বাসের জায়গাতেই রাখো। বিজ্ঞান হচ্ছে প্রমাণ সাপেক্ষ। বিজ্ঞান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে পৌঁছায়৷ আর ধর্মে অন্ধ হলে যা হয়, এই গরমে জোব্বা পরে থাকে। এটাতো বিজ্ঞানসম্মত নয়৷

এই যে তারের মাধ্যমে বিদ্যুৎ পাস হয়ে বাতি জ্বলে এটা বিজ্ঞান। এই যে A+B হোলস্কয়ারের সূত্র, এগুলো হিসেব করে মেলানো। এটাই বিজ্ঞান যা প্রমাণ সাপেক্ষ। এগুলো কি ধর্মগ্রন্থে আছে? আমরা অনেক সময় বিজ্ঞানকে ধর্মের সাথে মিলাই যা ঠিক নয়। হ্যাঁ ধর্ম মানুষকে সুশৃঙ্খল রাখে। বিজ্ঞান আলাদা কথা। বিজ্ঞান বিজ্ঞানই।

[08:27]

ছাত্র: ‘প্যারাডক্সিকাল সাজিদ’ বইটা পইড়েন স্যার। গুগল প্লে স্টোরে পাবেন।

স্যার: আমি পড়েছি। প্রতিনিয়ত আমি বিজ্ঞানের বই পড়ি। এসব গোঁজামিলের বইও আমার পড়া আছে। ওই  বই থেকে বিজ্ঞান শিখতে হবেনা আমার৷ এই যে মুসলমানরা মুসলমানের মত ধর্ম প্রচার করে, হিন্দুরা হিন্দুদের মত আর খ্রিষ্টানরা তাদের মত করেই ধর্মের ব্যখ্যা করে। এই জাত আর ধর্ম নিয়েই দ্বন্দ্ব। 

[09:00]

ছাত্র: আমরা যদি বলি, ধর্মের বিভিন্ন জিনিস যুক্ত করে বিজ্ঞানীরা বিজ্ঞানের ক্রেডিট নিচ্ছে?

স্যার: আরেহ বিজ্ঞান তো প্রমাণ দিয়েই আসছে। ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সম্পর্ক কী? নেয়া দেয়ার প্রয়োজন কেন আসবে? বিজ্ঞান তো কোন বিশ্বাস নয়।

[09:12]

ছাত্র: আমরা যদি ১৪০০ বছর পেছনে যেতে পারতাম তবে তো আমরা দেখতেই পেতাম আমদের সামনে সব প্রমাণ চলে আসতো।

স্যার: ধর্ম পুস্তক ১৪০০ বছর আগের লেখা৷ তার আগে কোথায় ছিলো? এর আগে মানুষ ছিল না? সভ্যতা ছিল না? তবে?

[09:26]

ছাত্র: কোরানের আগেও ৩ টি বই ছিলো। 

স্যার: যবুর ছিলো, ইঞ্জিল তো ২৫০০ বছর আগের। আর বৌদ্ধদের ছিলো। আমাদের হিন্দু ধর্মের বেদ ছিলো বড়জোর সাত হাজার বছর আগের। তাতে লাভ কী ? মানুষ লক্ষ লক্ষ বছর ধরে পৃথিবীতে। তখন এসব পুস্তক কোথায় ছিলো? তাহলে? এখন আমরা যতটুকু পাই সেটুকু নিয়েই ধর্মের কথা বলি৷ আমরা এখন ধর্ম নিয়ে গ্যাঞ্জাম করি! কেন করি? আমরা গ্যাঞ্জাম করব না। শিখব, জানব। কোনপ্রকার ঝামেলা করব না ধর্ম নিয়ে। অর্থাৎ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করার কোন মানে নেই। জিনিসটা হচ্ছে তোমরা বুঝে কাজ করবে৷ ধর্ম একটা কথা বললেই ঝাঁপিয়ে পড়বে না। ধর্ম বলল কান নিয়েছে চিলে আর চিলের পেছনে দৌড়াতে হবে ব্যপারটা এমন নয়। 

হনুমান নাকি সূর্যটাকে কানের ভেতর রেখেছে। আমাদের হিন্দু ধর্মের যারা বয়স্ক তারা খুব বিশ্বাস করে যে এই হনুমানের কানের মধ্যে সূর্য থাকে, এখন প্রশ্ন হচ্ছে হনুমান যদি কানের ভেতর সূর্য রাখে তবে পৃথিবীর ১৩ লক্ষ গুন বড় হচ্ছে সূর্য। এই পৃথিবী সূর্যের ১৩ লক্ষ গুন ছোট! এই ছোট পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে হনুমান কিভাবে তার কানের ভেতর সূর্য রাখে?

এই রকম গাঁজাখুরি গল্প যারা করে তাদের গল্প বিশ্বাস করতেই হবে? কেন আমরা এসব বিশ্বাস করব? কমবেশি সব ধর্মের মধ্যেই এরকম গাঁজাখুরি গল্প আছে। আমরা সচেতন থাকবো। এসব বলতে গেলেই বিতর্ক। যাক তোমাদের পড়ানো শুরু করি। এসব বিতর্কে যেয়ে লাভ নেই।

ধর্মের ভালো দিকও আছে খারাপ দিকও আছে। ভালো না থাকলে খারাপ এলো কোথা থেকে? এই যে দিন দেখতে পাচ্ছো, এই দিন কীভাবে এলো? রাত আছে বলেই তো আমরা দিন বলতে পারি।

এই যে কালো ব্যাগ, এটা কালো তুমি বুঝলে কীভাবে? এই যে লাল ব্যাগ, তোমরা সবাই কেন লাল দেখতে পাচ্ছো?

এই যে বিজ্ঞান, বিজ্ঞান এরকমই স্পষ্ট বিষয়। বিজ্ঞান হচ্ছে বাস্তবতা।

এই গাঁজাখুরি গল্প করে, এসব কারা করে? খারাপ মানুষেরা করে।

এই গাঁজাখুরি গল্প খারাপ মানুষগুলো করে তাদের ব্যবসা টেকানোর জন্য।

এই যে হনুমানের গল্প, হিন্দুদের মধ্যে যারা পড়াশোনা করে তারা কিন্তু এসব বিশ্বাস করে না। যারা মূর্খ লোক আছে তারাই এসব বিশ্বাস করে। কিছু লোক আছে ঘুরেফিরে খায়। সারাদিন কাজ করে না। এরে ওরে এটা সেটা বলে বাটপারি করে অন্ন যোগায়। ওরাই এই মূর্খদের শিষ্য বানায়। এরপর বসে বসে খায়। তারাই বলে হনুমানের কানে সূর্য আছে আর এসব শুনে মূর্খ লোকেরা তাদের টাকাপয়সা দেয়।

এই যে তোমরা লেখাপড়া শিখেছো, তোমরা ধর্মের পুস্তক পড়বে। অন্যের কথা শুনে লাফাবে কেন? তোমরা তো মূর্খ নও।

[12:50]

ছাত্র: স্যার আমরা তো কোরআন পড়েই এসব পাচ্ছি। তাছাড়া ওয়াজ শুনি, ওয়াজ শুনেও অনেক কিছুই শিখছি।

স্যার: ওয়াজ যে শোন, ওয়াজে কত ধরনের কথাই বকে, ভেবে দেখেছো? মানুষকে হত্যা করতে বলে, বাজে কথা বলে। হিংসা ছড়ানো হয় খেয়াল করেছো? শুনে ধর্ম মানতে হবে কেন? নিজে পড়েই ধর্ম মানো।"

ডাইনির নামে হত্যাকান্ড ও সংবিধান কী বলে? -
অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:733 | likes:0 | share: 0 | comments:0

সময়টা ২০০১ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাস। বাঁকুড়ার একটি গ্রামে গিয়েছি বন্ধু কৌশিক এর মামাতো দাদার বিয়েতে। বিয়ের আগের দিন সন্ধেবেলা গ্রামে পৌছে মেতে গেছি বিয়ের অনুষ্ঠানে। পরের দিন খুব ভোরে উঠে বন্ধুর একজন মামার সাথে বন্ধু  কৌশিক এবং আমি বেরিয়েছি শীতের সকালে গ্রাম ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে এক যায়গায় দেখি অনেক মানুষের ভীড়। ব্যাপার টা কি জানতে আমরা তিনজনে উক্ত স্থানে চলে আসি। দেখি কয়েকজন হোমড়াচোমড়া ব্যাক্তি খুব উত্তেজিত হয়ে কয়েকজন কে যেন কড়াভাষায় কিছু বলছে এবং তাঁদের অনতিদূরে একজন ষাটোর্ধ মহিলা অসহায় ভাবে মাটিতে মাথা নীচু করে কাঁদছেন। বন্ধুর মামা আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বিষয় টা জেনে এসে আমাদের জানালেন, উক্ত মহিলা নাকি ডাইনি। গ্রামের একজন কে দেখলাম উনি নাকি গুণিন, তিনিই নাকি জানিয়েছেন উক্ত মহিলাটি একজন ডাইনি এবং মহিলার পরিবার কে গ্রামের মাতব্বর দের কাছে পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে এর জন্য নইলে গ্রামে থাকা উক্ত পরিবারটির পক্ষে নাকি  অসম্ভব।


ডাইনির ব্যাপারে গল্পের বইতে আগে অনেক পড়েছি, কিন্ত এভাবে সরাসরি একজন ডাইনি কে দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম বিষয়টা সেদিন ভালোভাবে না জানার দরুন। জানিনা, ডাইনি ঘোষিত সেই মহিলা এবং তাঁর পরিবারটি আদৌ অতগুলো  টাকা দিয়ে গ্রামে থাকতে পেরেছিলেন কিনা। অনেক পরে জেনেছি ডাইনি বা ডায়েন বলে বাস্তবে কিছুই হয় না,ওসব গল্পগাঁথাতেই সম্ভব। কিন্ত আমি বললেই বা লোকে মানবে কেন? বাড়ির চালে ফনফন করে লাউ গাছ বেড়ে উঠছিল,কড়াও পরেছিল রাশি রাশি। আচমকা গাছ শুকিয়ে মরে গেলো। কেউ কি তবে কু-নজর দিয়েছে গাছে? কে-সে? ডাইনি নয় তো? সদ্য প্রসুতির সন্তান ক্ষিদের জন্য কাঁদছে অথচ মায়ের স্তনে মুখ দিচ্ছে না, কেউ কি মায়ের স্তন ভেড়ে দিয়েছে? সে, ডাইনি নয় তো? ছটফটে শিশুটা কেমন যেন হঠাৎ করেই ঝিমিয়ে গেছে। এটা ডাইনির কু-নজর নয়তো? এই তো গতবছর হারাণ এর মা এর পায়ে ঘা হয়, মলম লাগিয়েও কাজ হয় নি শেষে গ্রামের একজন গুণিনের কাছে জানতে পারলো গ্রামেরই এক ডাইনি, সেই পা এর রোগ টা জিইয়ে রেখেছে। শেষে গুণিন কে দক্ষিণা দিয়ে কিসব শেকড়বাকড় পরে সুস্থ হলো।


শুধু আদিবাসী সমাজ নয়, শিক্ষার সু্যোগ না পাওয়া কিংবা শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত শহুরে মানুষের একাংশও ডাইন বা ডাইনি বা ডায়েন এ গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। আদিবাসী সমাজে এই বিশ্বাস হচ্ছে সমুদ্র গভীর। কোনো গ্রামের কোনো গুনিন,জানগুরু, ওঝা,দিখলি, সৎসখা ইত্যাদিরা যদি কোনো মহিলাকে একবার ডাইনি ঘোষণা করে দেয় তাহলে সেই মহিলাকে বাঁচানো খুবই সমস্যার। গ্রামের মোড়ল বা মাতব্বর দের বিধান মতো ঘোষিত ডাইনির পরিবার কে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিয়ে তবে গ্রামে থাকতে হয়। কখনওবা ডাইনি বলে যাকে দেগে দেওয়া হয় তাঁকে প্রকাশ্যে নির্মম ভাবে হত্যাও হয়। খবরের কাগজে প্রায়শই এমন খবর আমাদের চোখে পরে। বিভিন্ন দেশের নানান গল্পগাঁথায় ডাইনি নিয়ে প্রচুর কাহিনী রয়েছে এসব গল্পই ধিরে ধিরে আমজনতাকে ডাইনির প্রতি বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। বাধ্য করে শেখাতে যে, ডায়েন বা ডাইনিদের কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা-টমতা আছে, এবং ডাইনিরা সমাজের ক্ষতিই করে থাকে। স্টার প্ল্যাস হিন্দি চ্যানেলে তো ডাইনির প্রতি জনগণের বিশ্বাস জাগাতে  ' নজর ' নামে একটা সিরিয়াল পর্যন্ত হয়েছে। এইধরনের সিরিয়াল বা সিনেমার প্রভাব মানবজীবনে অনেক। ডাইনি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে না জানি কত অসহায় মহিলারা সামাজের চোখে অপরাধী হয়ে অত্যাচারিত হবে, হচ্ছেও। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে এসব চললেও কোনো প্রতিবাদ,প্রতিরোধ নেই। এই প্রসঙ্গে একটি লজ্জাজনক ও নৃশংশ ঘটনার কথা আপনাদের শোনাই।


রাঁচির মান্দার ব্লকের কাঞ্জিয়া মারাইটোলি গ্রাম। এই গ্রামেই গত ৭ই অগাস্ট, ২০১৫ সালে পাঁচজন মহিলা কে পিটিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে একদল উন্মত্ত গ্রামবাসী।

উক্ত পাঁচজন মহিলার অপরাধ, তারা নাকি " ডাইনি"। রাঁচির এই গ্রামে কেউ ডাইনি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেনা, বরং গভীরে বিশ্বাস করে। ফলে যা হয় সেটা সত্যিই ভয়াবহ।

২০১৪ সালে এই মারাইটোলি গ্রামের পাশেই একজন মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে  হত্যা করার পরে গ্রামের এক ওঝার নিদান মতে সাইকেলের হ্যান্ডেলে উক্ত মহিলার কাটা মাথা নিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হয়।পুলিশ প্রশাসন কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করেই। পুলিশ আসায় গ্রামবাসীরা জানায়, খুন করে বেশ করেছি। (তথ্যসূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ আগষ্ট ২০১৫)।


পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ র অগাস্ট পর্যন্ত ডাইনি সন্দেহে কিংবা বিশ্বাসে এই গ্রামে ১২৪ জন মহিলা দের নির্মম ভাবে হত্যা হয়েছে। আরেকটি ঘটনা এই প্রসঙ্গে আরেকটি জঘন্য ঘটনার কথা শোনা যাক।


বাঁকুড়া সিমলাপাল অঞ্চলের চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার গত প্রায় দেড়বছর হল গ্রামে ফিরতে পারছেন না। কারণ তিনি নাকি ডাইন বা ডাইনি। গ্রামের একজন

জানগুরুর নির্দেশে, পরিবারটিকে জমিজমা বিক্রি করে জরিমানাও দিতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তাঁদের ভিটেমাটিতে থাকার অধিকার নেই।

বর্তমানে একটা আদিবাসী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনুগ্রহে পরজীবির মত বেঁচে আছেন ওনারা। অদ্ভুত এই অবস্থা। প্রশাসন সব জেনেও অন্ধ সেজে বসে আছে।

আশ্চর্য হলেও, রাগ হলেও এটাই আমাদের ভারত।

প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব কান্ড ঘটলেও তারা নির্বিকার।


" ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি " র পুরুলিয়া শাখার সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো, দীর্ঘবছর ধরে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া সহ জঙ্গলমহল এলাকায় যুক্তিবাদী বা  সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।  বিশেষ ভাবে ডাইনি সমস্যা সহ আদিবাসী এলাকার আরেকটি সমস্যা নাবালিকা বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ মধুসূদন মাহাতো সহ কয়েকজন মুক্তমনা সহযোদ্ধারা নিরলস ভাবে কাজ করছেন। সম্প্রতি, মধুসূদন মাহাতো, তথ্যের অধিকার আইনে রাজ্যে সরকারের স্টেট ক্রাইম ব্যুরোর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে কত মানুষকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে?

সরকার লিখিত ভাবে জানিয়েছে এবিষয়ে কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। ভাবা যায়! যেখানে তথ্যই নেই সেখানে প্রতিকার দুরাশা করাটা বোকামো।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনের দারস্থ হয়েও সুবিচার পাননি চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার। এই অবস্থাই কি চলছে, চলবেও? প্রশাসন কি এভাবেই জেগে ঘুমাবে? কিছু আলোচনার সময়ে মধুসূদন মাহাতোর দাবী, কাউকে ডাইনি বলে দেগে দেওয়ার পেছনে একটা গভীর চক্রান্ত আছে। দেখা যাচ্ছে, যেই বছর কম বৃষ্টিপাত বা অনাবৃষ্টির ফলে খরার প্রকোপ দেখা যায় সেবছরই ডাইনির ঘটনা বেশি শোনা যায়। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতন যায়গায় এমনিতেই চাষাবাদ খুব কম হয় বৃষ্টি বা জলের অভাবে। তাই কয়েকজন ধূর্ত ব্যাক্তি এই বিষয় টাকে হাতিয়ার করে। তাঁরা বুজরুক, প্রতারক ওঝা,গুণিন, জানগুরু ইত্যদিদের সাথে মিলে কোনো মহিলা কে ডাইনি ঘোষণা করে দেয় এবং সঙ্গে থাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা। স্বাভাবিক ভাবে অনেকেরই সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে চলে অত্যাচার এবং গ্রামে একঘরে করে রাখার বিধান। সোজা কথা, উদ্দ্যেশ্যে, কোনো মহিলাকে ডাইনি বলে দেগে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নোংরা চক্রান্ত। যেহেতু গ্রামগঞ্জে আজও ডাইনির ক্ষমতায় বিশ্বাসী (পড়ুন অন্ধবিশ্বাসী) মানুষের অভাব নেই তাই বিশ্বাসীরাও দল কোমড় বেঁধে নেমে পড়ে যাকে ডাইনি ঘোষণা করা হয়েছে তাঁর অথবা তাঁর পরিবারের ওপরে ক্রমাগত চাপ দিতে জরিমানার টাকা দেওয়ার জন্য।


যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা মনোবিজ্ঞান আজকের মতন এতো উন্নত হয়নি সেসময় অজানা জ্বর বা রোগের প্রাদুর্ভাব কে অনেকে বোঙ্গা বা দেবতার অভিশাপ নয়তো ডাইনির কারসাজি ধরে নিতো। অবস্থা এখনো পালটায় নি। আজও প্রত্যন্ত গ্রামে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই। তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের ৭৩ বছর পরেও। আজও একশ্রেণীর মানুষের পরনে কাপড় নেই, হাতে রোজগার নেই, সু-চিকিৎসা নেই, পেটে খাদ্য দেওয়ার মতন অবস্থা নেই, পারিস্কার পানীয়জল নেই, বাসস্থান নেই, মাথার ওপরে ছাদ নেই। এই নেই এর রাজ্যে আছে শুধু প্রতারণা, বুজরুকি, ধর্মের সুড়সুড়ি। গলা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবে থাকা দেশে নাগরিক অধিকার আজ খর্ব। আমজনতা তাঁদের সংবিধান স্বীকৃত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। যে দেশে শুধুমাত্র ঘুষ দিয়ে কাজ করাতেই বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যায় সেদেশের জনতা সু-চিকিৎসার সুযোগ না পেলে এবং সচেতনতার অভাবে এসব ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের খপ্পরে পরে সর্বসান্ত হয় এবং ডাইনি ঘোষিত বলে অত্যাচারিত,লাঞ্ছিত হয় প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্তে। আসলে পুরুষশাসিত সমাজের মাথারা নারী কে কোনো দিনই ' মানুষ ' হিসেবে দেখেনি কিংবা ভাবেনি। সর্বদাই ভেবেছে ভোগের সামগ্রী অথবা সংসার সামলানোর যাবতীয় কাজ করার একটা যন্ত্র।


প্রায় দুশো খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ডাইনিতত্ত্ব বা ডাকিনিতত্ত্বের রমরমা শুরু হয় এবং দ্রুত ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রেসিন্যান্ড স্কট নামক একজন ব্যাক্তি প্রকাশ করেন ' The Discovery of Witchcraft ' নামের গ্রন্থ টি। উক্ত বইটির মূল আলোচনা ছিল মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে ঘোষনা করে সমাজ মিথ্যেই তাঁদের ওপরে অত্যাচার করেছে। স্কট এর বইটি প্রায় সর্বত্রই ধিক্কৃত হয়েছিল সেসময়। এরও আগে ১৪৮৬ সালে খ্রিষ্টান ধর্মে পোপের নির্দেশে ' The Witche's Hammer ' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই গ্রন্থেই বলা হয়েছিল ডাইনিরা সমাজের শত্রু, ওরা অশুভ শক্তি, তারা মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাক জানে,সাধারণ মানুষ থেকে পশুপাখি দের ক্ষতি করে, নানান অসুখ তৈরী করে, রক্ত শুষে নেয়। তাই পোপের নির্দেশ ছিলো, ওদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ওঁদেরকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে শেষ করে দেওয়া হোক। 'The Witche's Hammer ' গ্রন্থটির সময় থেকে বহুযুগ ধরে প্রকাশ্যে মানসিক রোগিণী অর্থাৎ মহিলাদের উপর বারে বারে আঘাত এসেছে যা আজও ক্রমবর্ধমান। এখন হয়তো ডাইনি ঘোষিত কোনো মহিলাকে জীবন্ত জ্বলিয়ে দেওয়া হয়না, কিন্ত যা যা অত্যাচার হয় সেটা কোনো অংশেই কম নয়। রাঁচির মারাইটোলি গ্রামের ঘটনাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, যা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই সমস্যার শেকড় কতটা গভীরে।


National Crime Record Bureau র তথ্য অনুযায়ী, সাল ২০০০ থেকে ২০১৬ র মধ্যে ডাইনি ঘটনায় অত্যাচারিত ও খুন হয়েছেন ২৫০০ জন মহিলা। এতো গেলো সরকারি হিসেবে।  কিন্তু বিভিন্ন মানবধিকার বা যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনষ্ক সংগঠনের দাবী সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেশি। ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ  পর্যন্ত ডাইনি অপবাদে শুধু ইউরোপেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল ৮০ হাজার মহিলাকে। এই জঘন্যতম কান্ড শুধু ইউরোপ নয়, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড সহ অনেক দেশেই ছিল যথেষ্ট আকারে।


শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যাক বিখ্যাত লেখিকা প্রয়াত মহাশ্বেতা দেবীর। উনি দীর্ঘসময় ধরে আদিবাসী দের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের দাবীতে প্রচুর কাজ করেছেন, বিশেষ ভাবে ডাইনির ঘটনা নিয়ে। আরেকজন ব্যাক্তি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে মহাশয়। উনিও ডাইনি নামক একুশ শতকের লজ্জাজনক কান্ড নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন। কিন্তু ওনার কিছু বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার অবকাশ রয়েছে। যেমন শ্রী বাস্কের  একটি লেখা ' আদিবাসী সমাজের সংস্কার ও কুসংস্কার ' এর এক যায়গায় উনি লিখেছেন- " এটাকে (ডাইনি) কুসংস্কার কিংবা অন্ধ বিশ্বাস যাই বলি না কেন, ভারতবর্ষের প্রায় সব আদিবাসী সমাজেই এই ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা দেখা যায়। যদিও সকলেই জানে এর প্রয়োগ অসামাজিক তবুও তারা এর মোহমুক্ত হতে পারেনি। আদিবাসী সমাজের  কাছে এটা নিদারুণ অভিশাপ "। 

অর্থাৎ, শ্রীবাস্কের ধারণায়, ডাইনির মত একটা ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা চলছে। তাঁর মানে উনিও মনে করেন ডাইনি বা ডাইন বা ডায়েন বাস্তবে হয় এবং তাঁদের সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা থাকে। গভীর দুঃখের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছি ডাইনির প্রতি এমন অন্ধবিশ্বাস থাকলে, যতই মিটিং মিছিল আন্দোলন কিংবা লেখালিখি হোক না কেন সমস্যাটা মোটেই দূর করা সম্ভব নয়। ডাইনির প্রতি গভীর বিশ্বাসও রাখবো আবার এর বিরুদ্ধে কলম চালাবো এটা সোজাসাপটা স্ববিরোধীতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আরো দুঃখ পাই যখন ব্যাক্তিগত ভাবে পরিচিত কয়েকজন বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীরাও মনে করেন এই পৃথিবীতে সত্যিই ডাইনির অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাঁরা নিজের ক্ষমতার বলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে একদা পত্রপত্রিকায় ঝড় তোলা স্বঘোষিত ডাইনি ইপ্সিতা রায়চৌধুরী' র কথা। ১৯৮৮ সালে উনি সাড়াজাগিয়ে এসেছিলেন। সেসময় পত্রপত্রিকায় ওনাকে নিয়ে গাদা গাদা নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছিল। কয়েকটি পত্রিকাতো ওনাকে ভালো ডাইনি আখ্যা দিয়ে প্রশংসায় ভরা লেখা পর্যন্ত লিখেছে।  কিন্তু তারপরে যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীদের দ্বারা ওনার বুজরুকি ফাঁস হয়। আগষ্ট থেকে ডিসেম্ভর ১৯৮৮ সাল নাগাদ বিভিন্ন পত্রিকায় উনার বুজরুকি ফাঁসের নানান মুখরোচক খবর প্রকাশিতও হয়।


কোনো ওঝা,জানগুরু,গুণিন, সৎসখা, দিখলি ইত্যাদিরা ডাইনি সন্দেহে কোনো মহিলার ওপরে অত্বাচার করলে বা ডাইনি বলে ঘোষণা করলে, তাঁদের জেলে ঢোকাবার জন্য আমাদের দেশে বেশ কয়েকটা ভালো ভালো আইন রয়েছে। কিন্তু আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা এই দেশে টাকা এবং রাজনীতিক পরিচিতি থাকার সুবাদে অপরাধীরা অনেক বে-আইনি কাজ করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরায় শুধুমাত্র জনগণের আইন বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে। সরকার চাইলেই আইন কে মলাটবন্দি অবস্থায় ফেলে না রেখে, জনগণ কে এই বিষয়ে সচেতন করতে পারে। আমজনতা এইসব আইনের ব্যাপারে সঠিক ভবে জানলে নিজেরাই এইসব প্রতারকদের জেলে ঢোকাতে পারেন অনায়াসেই।


" নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও  শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তোনাহি প্রতদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"।


" অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি "  র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নরেন্দ্র দাভোলকর, যাকে মৌলবাদী কট্টরপন্থীরা নৃশংশ ভাবে হত্যা করেছিল, তিনি ২০০৩ সাল থেকেই একটা আইন কে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। অবশেষে " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 " লাগু হয়। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং

" The Drugs and Cosmetics Act 1940 " এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।


সাংসদ প্রবর্তিত The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954, আইনটি ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং ১ মে ১৯৫৪ তে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যার দ্বিতীয় অংশের, প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত হয়। জম্মু ও কাশ্মীর বাদে ভারতের সর্বত্র এই আইন প্রযোজ্য।


The Drugs Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 আইনের সংশোধন হয় ১৯৬৩ তে। এই আইনের ৯(এ) ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই আইন ভঙ্গকারীদের Cognizable Offence হিসেবে গন্য করা হবে। অর্থাৎ কেউ কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের না করলেও পুলিশ কোনোও ভাবে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রাথমিক জানার ভিত্তিতে কোনো অভিযুক্তকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে (Notwithstanding anything contained in The Code of Criminal Procedure 1898 an Offence Punishable under this Act shall be Cognizable)..


" The Drugs And Cosmetics Act 1940 "  Amendment GSR 884 (E)..বিভিন্ন সময়ে এই আইন সংশোধন হয়েছে। যেমন,১৯৫৫,১৯৫৭,১৯৬২,১৯৬৪,১৯৬৪ এবং শেষ এমেন্ডমেন্ট হয় ২০০৯ সালে। ১৯ মার্চ ২০০৯ তারিখে ভারতের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ জারি করেছে কেন্দ্রের ' স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর '। এই আইনে এবার থেকে শাস্তির পরিমান আজীবন কারাদণ্ড এবং সাথে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা।


কয়েকজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষ এই রাজ্যে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে মহারাষ্ট্রের ধাঁচে একটা জোরালো বা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে সরব। ইতিমধ্যে উনারা আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। এনারা যেই আইনটি আনতে চান তার নাম " The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill ২০১৬। " আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে।


আইন আছে কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ নেই। গোদীলোভো কোনো রাজনৈতিক দলই চায়না আন্তরিক হতে, তাই তাঁরা ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থেই আমজনতার তথাকথিত ধর্মবিশ্বাস কে আঘাত করতে নারাজ। নইলে সরকার চাইলে কড়া হাতে এইসব অমানবিক ও জঘন্য কাজ অনায়াসেই বন্ধ করতে পারে ব্যাপক আকারে সচেতনতার প্রচার ও প্রাসারের মাধ্যমে সঙ্গে ওঝা,জানগুরু ইত্যদিদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ব্যাবস্থা করে। এর সাথেই প্রয়োজন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র গড়ে তোলা। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে আজও বহু গ্রামগঞ্জে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই, নেই পর্যাপ্ত ওষুধ এবং ডাক্তার। তাই তো অজানা রোগ, জলবাহিত রোগ ইত্যাদিকে  ডাইনির প্রকোপ আখ্যা দিয়ে স্বার্থলোভী ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের প্রতারণা অবাধে চলছে।


ডাইনি বলে বাস্তবে কিছুই নেই ওসব গল্পের বই এবং সিনেমা সিরিয়ালেই সম্ভব। এইধারণা কে মনে গেঁথে নিলে এবং আন্তরিক হলে অবশ্যই বন্ধ করা যাবে এই ডাইনির ঘটনা গুলোকে। এর জন্য বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীদের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে নাটকের মাধ্যমে,  কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, প্রচার মাধ্যমে, ব্যাপকভাবে ডাইনির বিরুদ্ধে সচেতনতা মূলক অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নিতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সঙ্গে প্রশাসনের উচিৎ নজর রাখা কোনো গ্রামে কাউকে ডাইনি ঘোষণা হওয়ার খবর পেলেই দ্রুত ব্যাবস্থা নেওয়া এবং যে বা যারাই কোনো মহিলাকে ডাইনি আখ্যা দিয়েছে তার বিরুদ্ধে কড়া হাতে ব্যাবস্থা নেওয়া।


পর্ব-২।


গত ৫ জুলাই ২০২১ ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ এ ডাইনি সন্দেহে একজন মহিলাকে হত্যা করা হয়েছে। এর প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের কড়া শাস্তির দাবী জানিয়ে ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী নবীন পট্টনায়ক কে ইমেল করেছি। খবর পেয়েছি সরকার এখনও নাকি কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। এই সূত্র ধরেই

কথা হচ্ছিল ফ্রিথিংকার এবং সোশ্যাল অ্যাক্টিভিস্ট মিঃ দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার (Activist Dr Dibyajyoti Saikia) সাথে।

গত ১৪ আগষ্ট ২০১৫ সালে অসম বিধানসভায় পাশ হয়েছে ডাইনি হত্যা প্রতিরোধ আইন। " THE ASSAM WITCH HUNTING (PROHIBITION, PREVENTION AND  PROTECTION) ACT 2015 " অসম বিধানসভায় আলোচনার পর বিলটি গৃহীত হয় এবং ২৯ জুন ২০১৮ সালে সরকারি গেজেটে প্রকাশিত হয়। উক্ত আইনে কোনো মহিলাকে ডাইনি অপবাদ দিলে অভিযুক্তকে ৩ থেকে ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানার সুপারিশ করা হয়েছে। ডাইনি অপবাদে কাউকে অত্যাচার করা হলে ৫ থেকে ১০ বছর কারাদণ্ড ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা এবং ডাইনি বলে অপবাদ দেওয়ার ক্ষেত্রে জনতা জড়িত থাকলে সকলের কাছ থেকে ৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আদায়ের বিধান থাকছে। ডাইনি অপবাদে খুন করার অভিযোগে ৩০২ ধারায় বিচার হবে। ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করায় কেউ আত্মহত্যা করলে প্ররোচনার দায়ে ৭ বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজা ও এক থেকে ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হবে। তদন্তে গাফিলতি হলে সংশ্লিষ্ট তদন্তকারীদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সে ক্ষেত্রে জরিমানার পরিমাণ হবে ১০ হাজার টাকা। সরকারের দাবি, অসমের এই আইন বিহার, ওড়িশা, ঝাড়খণ্ড ও মহারাষ্ট্রের চেয়েও কড়া হবে। উল্লেখ্য, কিছু সময় আগে ঝাড়খণ্ডের রাঁচির মাণ্ডরে ডাইনি অপবাদে পাঁচ মহিলাকে পিটিয়ে খুন করা হয়। অন্য রাজ্যগুলির প্রত্যন্ত গ্রামে মাঝেমধ্যেই ডাইনি অপবাদে অত্যাচারের অভিযোগ ওঠে।

অসমে পাশ হওয়া আইনে ডাইনি অপবাদে অত্যাচার চালানো, একঘরে করা বা হত্যার ঘটনায় তিন বছর থেকে যাবজ্জীবন সাজার সুপারিশ থাকছে। সেই সঙ্গে উক্ত আইনে হাতুড়ে চিকিৎসকদের বেআইনি অনুশীলন ও সালিশি সভা বন্ধেরও কথা বলা হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে ডাইনি অপবাদে একঘরে হওয়া, জখম হওয়া, নিরাপত্তাহীনতায় ভোগা মহিলা বা পুরুষকে ক্ষতিপূরণ এবং ডাইনি-শিকারের বলি হওয়া পরিবারের অনাথ শিশুদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থাও করা হবে।


এই আইনটি লাগু করার পেছনে দিবজ্যোতি সাঁইকিয়ার অবদান অনেক।

অসমে গত ৭ বছরে ডাইনি অপবাদে প্রায় ৭০ জনের বেশি খুন করা হয়েছে। এই ঘটনা বেশি ঘটেছে শোণিতপুর, লখিমপুর, মাজুলি, বড়ো ও সাঁওতাল অধ্যূষিত জেলাগুলিতে। পুলিশ তদন্ত চালিয়ে দেখেছে, অনেক ঘটনার পিছনেই রয়েছে জমি বিবাদ বা ব্যক্তিগত শত্রুতা। রাজ্য পুলিশ ডাইনি হত্যা রোধে বিশেষ অভিযান চালাচ্ছিল। পাশাপাশি বীরুবালা রাভা ও দিব্যজ্যোতি সাঁইকিয়া ডাইনি হত্যা রোধে আন্দোলন গড়ে তোলেন। কিন্তু, তার পরও এই সব ঘটনা আটকানো যাচ্ছিল না।

দিব্যজ্যোতিবাবু জানান, প্রায় ছ’বছর ধরে তাঁরা ডাইনি হত্যা রোধে কড়া আইনের জন্য সুপারিশ করছিলেন। অসম সরকার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করে খসড়া বিল তৈরি করে। মন্ত্রিসভা তাতে সম্মতি দেয়। তিনি বলেন, ‘‘ছ’বছরের চেষ্টায় বিল পাশ হওয়ায় আমরা খুশি। কিন্তু, ওঝাদের রমরমা বন্ধ করতে কোনও দল মুখ খুলল না। এটা খুবই মর্মান্তিক। অসম সরকারের হিসেবে, ২০১১ সালে ২৯ জন, ২০১২ সালে ১১ জন, ২০১৩ সালে ১৬ জন ও ২০১৪ সালে ডাইনি অপবাদে ৯ জনকে খুন করা হয়। ২০১৫ সালে বিধানসভায় এআইইউডিএফ বিধায়ক আবদুল রহিম খান, অপরাধীদের জরিমানার টাকা আরও বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। অগপ বিধায়ক কেশব মহন্ত বলেন, ‘‘শাস্তি দিয়ে ডাইনি-হত্যার রাশ টানা যাবে না। স্কুলে স্কুলে অন্ধবিশ্বাস রোধে সচেতনতা শিবির ও এই বিষয়টি পাঠ্যক্রমের অন্তর্ভুক্ত করা দরকার।’’


প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, " নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও  শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তোনাহি প্রদদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"। " অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি " র প্রতিষ্ঠাতা নরেন্দ্র দাভলকর এর বিশেষ উদ্যোগে " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 " চালু হয়েছে। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং

" The Drugs and Cosmetics Act 1940 ", এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।


ভারতে এতোগুলো আইন থাকা সত্বেও ডাইনি বলে দেগে দিয়ে হত্যার ঘটনা প্রায়শই খবরের কাগজে স্থান পায়। অন্যান্য রাজ্যে আইন রয়েছে অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে না আছে ডাইনি সন্দেহে অত্যাচার কিংবা হত্যার কোনো তথ্য আর না কঠোর আইন প্রণয়নের কোনো উদ্যোগ।


কয়েকজন মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক ব্যক্তিরা মহারাষ্ট্রের ধাঁচে এই রাজ্যে একটা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। আইনটির নাম " The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill ২০১৬। " আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে।


ডাইনি অপবাদে মাথা কেটে, পুড়িয়ে খুন, গ্রেফতার ১১

অসমের বিভিন্ন জনপদে এখনও রয়ে গিয়েছে ডাইনি সন্দেহে মানুষ খুন করার প্রবণতা। ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অসমে ডাইনি সন্দেহে খুন হয়েছেন ১৯৩ জন। এরমধ্যে ৭৯ জন পুরুষ এবং ১১৪ জন মহিলা।

   

এই সময় ডিজিটাল ডেস্ক: অসমের কার্বি আংলঙে ডাইনি সন্দেহে মাথা কেটে, আগুনে পুড়িয়ে খুন করা হল দু'জনকে, তার মধ্যে একজন মহিলা। রমাবতী হালুয়া এবং বিজয় গৌরের 'কালা জাদু'র জন্য গ্রামের মেয়েরা অসুস্থ হয়ে পড়ছে, এই অভিযোগ তুলে শুক্রবার দু'জনকে খুন করেন রোহিমপুর গ্রামের মানুষ। স্থানীয় সূত্রে খবর পেয়েই শুক্রবার ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সুপার দেবজিৎ দেউরি। ধৃতদের মধ্যে দু'জন মহিলা, উদ্ধার হয়েছে বেশ কিছু অস্ত্র। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে কুসংস্কারের বশে এ হেন নৃশংসতা অবাক করছে পুলিশ, প্রশাসনকেও।


দেবজিৎ জানান, গত ২৯ সেপ্টেম্বর রশ্মি গৌর নামে গ্রামের এক কিশোরী অসুস্থ হয়ে মারা যায়। গ্রামবাসীদের একাংশের দাবি, রশ্মি মৃত্যুর আগের দিন রমাবতী ও বিজয়ের নাম করে জানিয়েছিল, তাঁদের 'কালা জাদু'র জন্যই অসুস্থ হয়ে পড়েছে সে। রশ্মির মৃত্যুর তিন দিনের মাথায় গ্রামের আরও এক কিশোরী গ্রামপ্রধানের বাড়ি গিয়ে অসুস্থতার কথা জানায়। তারও দাবি, ওই দু'জনের কালা জাদুতেই অসুস্থ হয়ে পড়ছে সে।


এর পরই গ্রামবাসীরা চড়াও হয়ে রমাবতী ও বিজয়কে পিটিয়ে মারে বলে অভিযোগ। কাছের পাহাড়ে নিয়ে গিয়ে, রশ্মির কবরের খুব কাছে তাঁদের মাথা কেটে আগুন ধরিয়ে দেয় গ্রামবাসীরা। বৃহস্পতিবার খবর পেয়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক এবং এগজিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট জিন্টু বোরা। সেখান থেকে পোড়া দেহাংশ ও মাটির নমুনা সংগ্রহ করা হয়। মামলা দায়ের করে ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ, বাকি অভিযুক্তদের খোঁজ চলছে।


অসমের বিভিন্ন জনপদে এখনও ডাইনি সন্দেহে মানুষ খুন করার প্রবণতা রয়েছে। ২০০১ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে অসমে ডাইনি সন্দেহে খুন হয়েছেন ১৯৩ জন। এরমধ্যে ৭৯ জন পুরুষ এবং ১১৪ জন মহিলা। গত আগস্ট মাসেও চিরাং জেলায় তিনজনকে ডাইনি সন্দেহে গ্রামবাসীরা পিটিয়ে খুন করার চেষ্টা করে। গুরুতর জখম অবস্থায় তাঁরা প্রাণে বাঁচেন। ডাইনি অপবাদে নৃশংস হত্যাকাণ্ড রুখতে রাজ্য সরকার আইন সংশোধন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজাও ঘোষণা করেছে। গ্রামবাসীদের সচেতন করতে নেওয়া হয়েছে 'প্রহরী' সামাজিক প্রকল্প। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি। তারই ফের প্রমাণ মিলল ডোকমোকায়। উল্লেখ্য, বছর দুয়েক আগে এই ডোকমোকাতেই দুই অসমীয়া যুবককে গ্রামবাসীরা ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে খুন করে।

https://eisamay.com/nation/2-brutally-killed-by-villagers-in-assam-in-suspected-witch-hunting-case/amp_articleshow/78453560.cms


ডাইনি সন্দেহে হত্যার প্রতিবাদ ও কঠোর শাস্তির দাবিতে চিঠি


সম্প্রতি, ডাইনি সন্দেহে এক প্রবীণাকে হত্যা করা হয়েছে ওডিশায়। তাঁর ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে বলে খবর। মৃতার নাম যমুনা হাঁসদা (৬২)। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে আপাতত দুজনকে আটক করা হয়েছে। এই ন্যাক্কারজনক ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ এবং অপরাধীদের কঠোর শাস্তির দাবী জানিয়ে বিজ্ঞানমনষ্ক বন্ধু রথীন মন্ডল সহ অনেকেই ইমেল করেছিল মুখ্যমন্ত্রী নবীন পট্টনায়ক মহাশয় কে। ইমেলের বয়ান-

প্রতি,

নবীন পট্টনায়ক সমীপেষু,

মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী,

ওড়িশা সরকার।

বিষয় - ডাইনি সন্দেহে হত্যার প্রতিবাদ ও কঠোর শাস্তির দাবি।


মহাশয়,

গতকাল ' TheWire ' পত্রিকার মাধ্যমে পড়লাম, আপনার রাজ্যের ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ জেলায় "জাদুবিদ্যা" অনুশীলনের অভিযোগ দিয়ে এক মহিলার শিরশ্ছেদ করা হয়েছে। মৃত ব্যক্তি বলিভোল গ্রামের বাসিন্দা, ৬২ বছর বয়সী যমুনা হংসদা। সূত্র- https://thewire.in/rights/odisha-elderly-tribal-woman-accused-of-witchcraft-beheaded


একজন বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মী হয়ে এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

মহাশয়, এই একুশ শতকেও এমন নিন্দনীয় ঘটনা ভারতের বহু স্থানে প্রায়শই দেখা যায়।  National Crime Record Bureau র তথ্য অনুযায়ী, সাল ২০০০ থেকে ২০১৬ র মধ্যে ডাইনি ঘটনায় অত্যাচারিত এবং খুন হয়েছেন ২৫০০ জন মহিলা। যদিও বে-সরকারি মতে সংখ্যাটা অনেক বেশি।

ডাইনি নামক কুসংস্কারের বিরূদ্ধে কিছু কঠিন আইন রয়েছে আমাদের দেশে। যেমন:- " নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরােধ বিল -২০১১ " নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনাে মহিলাকে ডাইনি ঘােষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘােষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে " ডাইনি প্রতিরােধ আইন -২০১১ ", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে " তােনাহি প্রতদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫ ", বিহার সরকার এনেছে " ডাইনি প্রতিরােধ আইন- ১৯৯৯ "। এছাড়া, রয়েছে, " The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013 "। তাছাড়া " The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 ", এবং " The Drugs and Cosmetics Act 1940 ", IPC 307, IPC 302 এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে।

আধুনিক সমাজে এমন কুসস্কারাচ্ছন্ন কর্মকাণ্ড মোটেই কাম্য নয়। আমি একজন বিজ্ঞানমনষ্ক ও সমাজকর্মী মানুষ হয়ে এমন ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।

আশাকরছি আপনি এমন ঘটনার বিরূদ্ধে দ্রুত কড়া ব্যাবস্থা নেবেন এবং প্রকৃত অপরাধীদের কড়া শাস্তি দিয়ে দৃষ্ঠান্ত স্থাপন করন।

ধন্যবাদ সহ,

রথীন মণ্ডল,

পশ্চিম বর্ধমান, বাংলা। 



যুক্তিবাদীদের চোখে ধর্মনিরপেক্ষতা -
অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | আইন | views:919 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ধর্মনিরপেক্ষতা' বা Secularism শব্দটা নিয়ে রয়েছে প্রচুর বিভ্রান্তি, সঙ্গে হয়েছে বিকৃতিও। এই শব্দটির উৎপত্তি ইউরোপে। 'Secularism'  এর আভিধানিক অর্থ - "An ism does not related with religion and non-entity to any supernatural existence"। অর্থাৎ ধর্মের এবং অলৌকিকতার সঙ্গে কোনরূপ সম্পর্কিত নয় এমন একটি মতবাদ হল ধর্মনিরপেক্ষতা। নিরপেক্ষ অর্থাৎ কোনো অথবা কারোর পক্ষেই নয়। ধর্মনিরপেক্ষ মানে সর্বধর্মসমন্বয় নয়, এর অর্থ রাষ্ট্র কোনো ধর্মের পক্ষেই  থাকবেনা, বরং সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই থাকবে নিরপেক্ষ বা সম্পর্ক বর্জিত। এছাড়া ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। রাষ্ট্র কোনো ধর্মকেই পক্ষপাত করে না। এই মতবাদ অনুযায়ী, সরকার কোনরূপ ধর্মীয় হস্তক্ষেপ করবে না, কোন ধর্মীয় বিশ্বাসে বিশ্বাসী হবে না এবং কোন ধর্মকে কোন প্রকার অতিরিক্ত সুবিধা প্রদান করবে না। কাউকে ধর্ম পালনে বাধ্য করা হবে না। সকল ধর্মের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করবে। আবার উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে- "The separation of religion and state is the foundation of secularism. It ensures religious groups don't interfere in affairs of state, and the state doesn't interfere in religious affairs." 


ভারতের সংবিধান ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি থেকে চালু হয় যার মূলে ছিলেন বাবাসাহেব আম্বেদকর মহাশয়। ১৯৭৬-সালের ১১ নভেম্বর ভারতের পার্লামেন্ট অনুমোদিত এবং ১৮ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষরিত ৪২তম সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে ভারতের সংবিধানে 'Secular' শব্দটা যুক্ত করা হয় কোনোরকম সংজ্ঞা ছাড়াই। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি- "With the Forty-second Amendment of the Constitution of India enacted in 1976, the Preamble to the Constitution asserted that India is a secular nation. However, the Supreme Court of India in the 1994 case S. R. Bommai v. Union of India established the fact that India was secular since the formation of the republic." 


ভারতীয় সংবিধানের মুখবন্ধের (Preamble) প্রথম অনুচ্ছেদে ' ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular) শব্দটি ব্যবহার করে সে খানে লেখা হয়েছে - 

"We The People Of India, having solemnly resolved to constitute India into a SOVEREIGN, SOCIALIST, SECULAR, DEMOCRATIC, REPUBLIC and to secure to all its citizens; "। অর্থাৎ, সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক, প্রজাতন্ত্র হল সংবিধানের মৌলিক নীতি। আবার, প্রতিটি নাগরিকদের কর্তব্য হিসেবে উল্লেখ রয়েছে, বিজ্ঞানমনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। "It shall be duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform.{Article 51A(h)"।


ভারত রাষ্টের সংবিধানের  তৃতীয় অংশে (Part- iii) ১২-৩৫ নং ধারায় মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ আছে। এই মৌলিক অধিকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান থেকে নেওয়া হয়েছে। সংবিধানে নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার (Fundamental Rights of Indian Constitution)

দেওয়া হয়েছে। যেমন - 

(১) সাম্যের অধিকার,

(২) স্বাধীনতার অধিকার, 

(৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার,

(৪) ধর্মীয় অধিকার, 

(৫) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, 

(৬) শাষনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার।


আমজনতার বৃহৎ অংশ 'ধর্ম' বলতে উপাসনা / প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং ধর্মগ্রন্থ বলতে উপাসনাধর্ম বিষয়ক বই-পত্র কেই বোঝেন। অভিধানে 'ধর্ম' বা 'রিলিজিয়ন' (Religion) শব্দের অর্থ লেখা হয়েছে – 

(১) ধর্ম মানে - সাম্প্রদায়িক, ঈশ্বর উপাসনা, রীতি-নীতি, ঈশ্বর এবং পরলোকের অস্তিত্বে বিশ্বাস। যেমন -হিন্দু, খ্রীষ্টান, ইসলাম ইত্যাদি ৪২০০ প্রকার। 

(২) Religion [রিলি'জন]n. ধর্ম:  human recognition of a personal God entitled to obedience.. আবার। 

(৩) ধর্ম মানে - গুণ (Property) বৈশিষ্ট (Characteristic)। যেমন - আগুনের ধর্ম বা গুণ দহন, জলের ধর্ম বা গুণ তরলতা, তরোয়াল এর ধর্ম বা গুণ তীক্ষ্ণতা ইত্যাদি। ধর্মবিশ্বাস; any system of faith and worship বোঝায়।  


ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রগুলোর সংবিধানে 'ধর্মনিরপেক্ষ' (Secular) র সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। যেখানে স্পষ্ট ভাবে লেখা রয়েছে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রনীতি, রাজনীতি ও শিক্ষানীতি হবে সম্পূর্ণ ধর্ম বর্জিত। রাষ্ট্রনায়কগণ কোনভাবেই প্রকাশ্যে ধর্ম-আচরণ করতে পারবেন না।  অনেকেই অনেকেই হয়তো জানেন না, এই শর্তকে লঙ্ঘন করলে অর্থাৎ রাজনীতি বা ভোটব্যঙ্কের স্বার্থে কোনো নেতামন্ত্রীরা প্রকাশ্যে ধর্মাচরণ করে অ-ধর্মনিরপেক্ষ কাজকর্মের সাথে জড়িয়ে থাকলে সংবিধানের "দ্য রিপ্রেজেন্টেসন অফ পিপলস অ্যাক্ট ১৯৫১" (অ্যামেন্ডমেন্ট ১৯৮৯) এর ২৯ক ধারায় ঐ নেতামন্ত্রী কিংবা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক দলটির স্বীকৃতি খারিজ করার বিধান রয়েছে নির্বাচন কমিশনের হাতে। অন্যদিকে, ৩রা জানুয়ারি, ২০১৭ সালে ধর্ম, বর্ণ, জাতি, সম্প্রদায় ও ভাষার ভিত্তিতে ভোট চাওয়া বা ভোট না দিতে প্ররোচিত করাকে দুর্নীতিপূর্ণ আচরণ বলেই রায় দিয়েছে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত বা সুপ্রিম কোর্ট। প্রধান বিচারপতি টি এস ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন সাত বিচারপতির বেঞ্চে চার জন বিচারপতি এ ব্যাপারে জানিয়েছেন, কেবল প্রার্থী নয়, ভোটারদের ধর্ম-বর্ণের ধুয়ো তুলেও প্রচার করা যাবে না। এছাড়া, জনপ্রতিনিধিত্ব আইনের ১২৩(৩) ধারায় ধর্ম, জাতি, ভাষা, সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে ভোট চাওয়া অবশ্য এমনিতেই নিষিদ্ধ। শীর্ষ আদালত বলেছে— কেবল প্রার্থী নয়, প্রচারে আনা যাবে না ভোটারদের ধর্ম, জাতি, ভাষার কথাও। এমনকী প্রার্থীর এজেন্টের সামাজিক পরিচয়ের জোরেও ভোটারদের প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যাবে না। 


ভারতীয় যেহেতু প্রতিটি মানুষকেই ধর্মীয় অধিকার দিয়েছে (২৫-২৮ ধারায়) তাই কেউ যেমন ব্যক্তিগত ধর্মচারণ করতে পারেন, তেমনই কেউ ধর্মহীন ভাবে জীবনে এগিয়ে চলতে পারেন (২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪ তে বোম্বে হাইকোর্ট একটি রায় এ স্পষ্ট ভাবে জানিয়েছে, "State can compel none to declare or specify his/her religion. Citizens have Constitutional Right to belong to 'No Religion." অর্থাৎ, রাষ্ট্র কাউকে তার ধর্ম জানাতে বাধ্য করতে পারবে না। তিনি কোনও ধর্মের অন্তর্ভুক্ত নন বা কোনও ধর্ম পালন করেন না -- এই দাবী করার সাংবিধানিক অধিকার আছে প্রত্যেক নাগরিকের)। 


একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে সাধারন মানুষ থেকে রাষ্ট্রনায়কগণ প্রকাশ্যে নয়, তবে ব্যাক্তিগত ভাবে ভাবে ধর্মাচরণ করতে পারেন। সংবিধানের এই কথাটা কে গ্রাহ্য করেন না কোনো রাষ্ট্রনেতাই। তাই তো,

ভোটনির্ভর বা গোদীলোভী রাজনৈতিক দল কেউই রাষ্ট্রের ধর্মনিরপেক্ষতার আসল চেহারাটা প্রকাশ করেন না নিজেদের রাজনীতির স্বার্থেই। ওরা ধর্মেও আছে, জিরাফেও আছে। ঝোলে- ঝালে- অম্বলে সবেতেই আছে। আসলে ভোটব্যাঙ্ক এর স্বার্থে কেউই আমজনতার তথাকথিত "ধর্মবিশ্বাস" কে আঘাত করতে চান না। ধর্ম শুধুমাত্র ঠিকে আছে শাষকগোষ্ঠি এবং তাঁদের চালিকাশক্তি পুঁজিপতিদের জন্যেই। শোষিত, বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকারের দাবীর জন্য সংগ্রাম কিংবা ক্ষোভের আগুনে জল ঢ্লাতে আজ তাই "ধর্ম" হচ্ছে এক সুন্দর কার্যকর অস্ত্র। কারণ রাষ্ট্রশক্তি ভালো করেই জানেন ধর্ম নামক মারাত্বক আফিমের নেশায় ডুবে থাকা জনগণ কোনো প্রশ্নই তোলেন না, উলটে যুক্তি-বুদ্ধি সব বাক্সবন্দি করে রাষ্ট্রশক্তির হ্যাঁ তে 'হ্যাঁ' এবং না তে 'না' মেলায় শেখানো তোঁতাপাখির মতন। এইমূহুর্তে সেই গল্পটা মনে পরছে যেখানে পথচলতি একজন ব্যাক্তিকে একজন মাতাল প্রশ্ন করছে, "দাদা একটু ধর্ম হবে, বিড়ি জ্বালাবো? ব্যাক্তিটির অবাক হয়ে পালটা প্রশ্নের উত্তরে মাতাল টি জানায়, আরে দাদা ধর্ম দিয়ে তো দেশ জ্বলছে আর সামান্য একটা বিড়ি জ্বলবে না।" এটাই কিন্তু বাস্তব চিত্র। 


এক শ্রেণীর ধান্দাবাজ রাজনৈতিক ও তথাকথিত বুদ্ধিজীবীদের মগজধোলাই এর কল্যাণে বর্তমানে ধর্মনিরপেক্ষবা Secular শব্দটির অর্থ - ধর্মের ক্ষেত্রে এক খাবলা নিরপেক্ষতা, দু-খাবলা পক্ষপাতিত্ব মিলিয়ে এক বিচিত্র স্ববিরোধীতার খিঁচুড়ি এবং সংবিধান রাস্তার পরে ধুলোয় খায় লুটোপুটি। 


 একটি রাষ্ট্রকে প্রকৃতঅর্থে  ধর্মনিরপেক্ষ বা Secular গড়ে তোলা খুব সহজও নয় আবার খুব যে কঠিন তেমনও নয়। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা এবং সদিচ্ছা। ভারতীয় জনতা পার্টির দাবী, পৃথিবীতে যদি ৫৫ টি মুসলিম রাষ্ট্র থাকতে পারে তাহলে ভারত কেন ধর্মনিরপেক্ষ থাকবে? তাই, সংবিধানে সংশোধনী বিল এনে ধর্মনিরপেক্ষ শব্দটিকে বাতিল করে ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্র বানাতেই হবে। যারা এমন দাবী তোলেন তাঁরা এটা হয়তো ভুলে থাকতে চায়, একটি রাষ্ট্র, হিন্দু, ইসলাম কিংবা খ্রিষ্টান যাই হোক, সেখানে আমজনতা কি দারুন সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে রয়েছেন? বেকারত্ব কি মুছে গেছে কিংবা জাত-পাত বিভেদ কিংবা ধনী- গরিবের বিভেদ কি আদৌ দূর হয়েছে?


পাকিস্তানের কথাই ভাবুন। সেখানকার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। শেখানে একশ্রেণীর মানুষ স্বাচ্ছন্দে থাকলেও একটা বড় অংশের মানুষই গরিব। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে আজপর্যন্ত কোনো নেতা-মন্ত্রী পারেন নি পাকিস্তান কে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে পরিনত করতে এবং দেশের চিত্রটাকে আমূল বদলে দিতে। ১৯৭১ এর পর থেকে বাংলাদেশ কে ইসলামিক রাষ্ট্রে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা চালানো হচ্ছে কৌশলে। সরকারেরও প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রশ্রয় রয়েছে এই কাজে। খোঁজ নিলেই দেখা যাবে ওপার বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ অর্থনৈতিক ভাবে খুবই দুর্বল এবং বেকারত্বের হারও উর্ধমুখি। 


আজ থেকে বহুবছর আগে শ্রদ্ধেয় কবিগুরু তাঁর লেখার  মাধ্যমে বোঝাতে চেয়েছিলেন  - "দেশ মাটিতে নয়, মানুষে গড়ে ওঠে। দেশপ্রেম মানে দেশের মাটিকে ছুঁয়ে শপথ নেওয়া কিংবা একটা মানচিত্র কে ভালোবাসাও নয়। দেশপ্রেমের অর্থ দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শোষিত, বঞ্চিত, অবহেলিত, নিরন্ন, বিপন্ন মানুষের প্রতি প্রেম।" 


মোরা তোমাদেরই লোক, গরিবি হটাও ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে এইসব গরিবগুর্ব মানুষের প্রতি মিথ্যে প্রেম দেখিয়ে রাষ্ট্র কে ধর্মের মোড়কে মুড়ে ফেললেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? না, কোনদিনই হবে না, হতে পারেও না। একটি রাষ্ট্র কে প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ গড়ে তুলতে গেলে যা করতে হবে তার একটা রুপরেখা তুলে ধরলাম। 


১- রাষ্ট্রের শিক্ষানীতি, রাজনীতি ধর্মবর্জিত করতে হবে। সরকারি কিংবা সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত স্কুলে কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান, ধর্মীয় নেতার জীবনী পাঠ, ধর্মীয় শ্লোগান, পঠন-পাঠনে ধর্মীয় নেতাদের জীবনী এবং প্রতিষ্ঠানিক ধর্মচেতনা বৃদ্ধিকারী বিষয় অন্তর্ভুক্তিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। 

সংবিধানের ২৮ নং ধারায় ভারত রাষ্ট্রের "ধর্মনিরপেক্ষ"  চরিত্রের প্রতিফলন আছে। এতে বলা হয়েছে- 

ক) সম্পূর্ণভাবে সরকারী অর্থে পরিচালিত কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া চলবে না।

খ) ১ নং উপধারায় বর্ণিত কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কোন ট্রাস্ট বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা স্থাপিত হয়েও যদি সরকার দ্বারা পরিচালিত বা প্রশাসিত হয় তবে নিজস্ব মতে ধর্মশিক্ষা দিতে পারবে না।

গ) নিজের ইচ্ছা না থাকলে কোন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে বা অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে অভিভাবকদের বিনা অনুমতিতে কোন শিক্ষাপ্রার্থীকে সরকারী অর্থ সাহায্যপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় শিক্ষা বা নির্দেশনামা গ্রহনে বাধ্য করা যাবে না।

২- আমজনতার দেওয়া করের টাকায় হজ যাত্রা,ইমাম কিংবা পুরোহিত ভাতা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে।

৩- যেহেতু, সংবিধানগতভাবে শুধু পদাধিকারী নন, কোনও দলও প্রকাশ্যে ধর্মীয় আচরণ করতে পারেন না সেইজন্য এ-বিষয়ে কঠোর ভাবে নজর রাখতে হবে।  

৪- Secularism শব্দটার বিকৃত নয়, বরং প্রকত অর্থ টা ঠিক কি সেটা আমজনতাকে বোঝাতে সর্বধর্মসমন্বয়ের গালগল্প ছেড়ে বাস্তব সংজ্ঞাটাকে গ্রহণ করতে হবে। 


৫- উৎসবের অযুহাত দেখিয়ে কোনো নেতা-মন্ত্রীর প্রকাশ্যে কোনো পুজো প্যান্ডেলের উদ্বোধন, ইফতার পার্টি কিংবা অন্যকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যাওয়ায় কঠোর হতে হবে। 

৬- ধর্মের দোহাই দিয়ে নিরিহ পশুদের হত্যা নিষিদ্ধ করতে হবে। কেউ প্রকাশ্যে পশুবলি বা কুরবানি দিচ্ছে জানতে পারলে সেই ব্যাক্তিকে "দ্য ক্রুয়েলটি টু এনিম্যাল অ্যাক্ট ১৯৬৯" অনুযায়ী শাস্তি দিতে হবে কিংবা এই বিষয়ে সচেতন করতে কোনো পন্থা গ্রহণ করতে হবে। 

৭- সরকারি অর্থ অর্থাৎ আমজনতার দেওয়া Tax এর টাকায়, সমস্ত প্রকার ধর্মীয় অনুষ্টান বন্ধ করতে হবে এবং পুলিশ লাইনে কোন উপাসনালয় তৈরী হওয়া আটকাতে হবে। দুরদর্শনের মতন সরকারি প্রচার মাধ্যমে ধর্মীয় প্রচার নিষিদ্ধ ঘোষণা করতে হবে। 

৮-  সরকারি অথবা বে-সরকারি আবেদনপত্রে কোনও ব্যাক্তির Religion এবং Cast জানতে চাওয়া চলবে না। যারা নাস্তিক অথবা ধর্মহীন তারা যেমন সরকারি বা বে-সরকারি ফর্মের Religion কলামে HUMANISM, ATHEISM ইত্যাদি লেখেন তেমন লিখতে পারার অধিকারে কেউ হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা। এই প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, এপ্রিল ২০২১ এ ভারতের সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে -"১৮ বছরের বেশি বয়সী যে কোনো ভারতীয় নাগরিক তার ইচ্ছামতো ধর্ম গ্রহণ করতে পারবে বলে সংবিধানে অধিকার দেয়া রয়েছে"। 

৯- কোনো রাজনৈতিক দল সাম্প্রদায়িক কাজের সাথে জড়িত থাকলে অথবা  সাম্প্রদায়িক, বিদ্বেষমূলক, উস্কানিমূলক বক্তব্যে রাখলে ১৯৫১ সালের রিপ্রেজেন্টেশন অফ দ্য পিপল (এমেন্ডমেন্ট ১৯৮৯) অ্যাক্ট এর ২৯ (এ) ধারা মতে সেই রাজনৈতিক নেতার কিংবা পুরো দলের স্বীকৃতি খারিজ করতে হবে।

১০- বিজ্ঞানের পঠন-পাঠন এর যায়গায়, বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে, স্কুল-কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ে সমস্তপ্রকার ধর্মীয় আলোচনা, ধর্মগুরুদের জীবনীপাঠ এবং অবৈজ্ঞানিক বিষয়ের প্রচার কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে। সংবিধান স্বীকৃত বিজ্ঞানমনষ্কতার প্রচার এবং প্রসারে রাষ্ট্র যদি ব্যার্থ হয়,তাহলে কোনো ব্যাক্তি কিংবা সংগঠনের এই কাজে কোনরকম হস্তক্ষেপ করতে পারবে না রাষ্ট্র সেদিকে নজর দিতে হবে। 

প্রিয় পাঠক, একবার গভীরভাবে ভাবুন তো, ওপরের ১০ টি পয়েন্ট কি খুবই কঠিন নাকি খুবই সহজ? অপ্রিয় সত্যি এটাই যে, রাষ্ট্রশক্তি চাইলে  আমজনতাকে মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক গড়ে তুলতেই পারে। কিন্তু কেন করেনা জানেন, কারণ রাষ্ট্র বেশ ভালো মতই জানে যারা অন্ধবিশ্বাস, ভাববাদ, ঈশ্বরবাদ ইত্যাদিকে আকঁড়ে ধরে থাকেন তাঁরা কোনদিনই শোষণমুক্তির কথা চিন্তাতেই আনে না। সেবা দিয়ে যেমন শোষণমুক্তি ঘটানো সম্ভব নয়, তেমনই কুসংস্কারে আচ্ছন্ন মানুষ, নেতৃত্বহীন জনগণ কোন প্রশ্নই তোলে না। আর এভাবেই শাষণ -শোষণ- তোষণের রাজনীতি করে, আমজনতাকে ধর্মের নেশায় ডুবিয়ে রেখে বিদেশের সুইসব্যাঙ্ক ফুলেফেঁপে উঠতে থাকে। আমজনতার বৃহত্তর অংশ যদি নিজেদের ন্যায্য অধিকারের দাবীতে সরব হয় তাহলে শোষণ প্রক্রিয়াটাই ব্যাহত হয়। 

ধর্মনিরপেক্ষতা মানে মন্দির-মসজিদ-গীর্জা - গুরুদ্বার -গুম্ফায় গিয়ে প্রকাশ্যে ধর্মচারণ এবং প্রচারমাধ্যমে সেসব ফলাও করে প্রচার করা নয়। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে প্রকাশ্য রাজপথে বিফ খেয়ে কতটা ধর্ম -নিরপেক্ষ প্রমাণ করাও নয়, এটা তখনই ভালো যখন দুই ধর্মের মানুষকে নিয়ে বিফ এবং পর্ক দুটোই একসাথে খাওয়া অথবা কে বিফ খেলো, কে পর্ক খেলো সেসব না দেখে, কে সারাদিন অভুক্ত রইলো সেদিকে বেশি নজর দেওয়া। সর্বধর্মসমন্বয়ের গল্পো শুনিয়ে ধর্মের নামে বিদ্বেষ,হিংসা টাও ভণ্ডামি, তাই ধর্মনিরপেক্ষ মানে দুদুও খাবো আবার তামুকও খাবো, কিংবা ধর্মে ও জিরাফে একত্রে সহাবস্থানও নয়। ধূলো জমে থাকা ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রয়োগ করতে আন্তরিক হলে ভণ্ডামো ছেড়ে এই শব্দটাকে সংবিধানের পাতা থেকে তুলে এনে বাস্তবের মাটিতে প্রয়োগ করতেই হবে, এর কোনও বিকল্প নেই। Secularism বা ধর্মনিরপেক্ষর প্রকৃত সংজ্ঞাটা এসে যদি বিকৃত হওয়া সংজ্ঞাটা তার চরিত্র হারায় এবং কেউ আন্তরিকভাবে এর প্রয়োগ করতে উদ্যোগী হন তাহলেই এই লেখা স্বার্থক।

হিজাব, একটি বিতর্ক এবং.. -
অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | সামাজিক ইস্যু | views:882 | likes:0 | share: 0 | comments:0

ফেব্রুয়ারি ২০২০-এর প্রথম সপ্তাহ থেকে হিজাব নিয়ে বিতর্কে সরগরম কর্ণাটক। ঘটনার সূত্রপাত অবশ্য সপ্তাহ খানেক আগে। কর্ণাটক রাজ্যের উদুপি জেলায় একটি সরকারি কলেজে ছয়জন ছাত্রীকে হিজাব পরে ক্লাস করতে বাধা দেওয়ায় শুরু হয় বিতর্ক। সেই ঘটনায় আদালতের দ্বারস্থ হন একজন ছাত্রী। পরে বিতর্কের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে আরও কয়েকটি কলেজে। অন্যদিকে গত ৩ ফেব্রুয়ারী ২০২২ (বৃহস্পতিবার) ওই জেলার সৈকত-শহর কুন্দাপুরের একটি কলেজে হিজাব পরে আসা কয়েক জন জন ছাত্রীকে ক্লাস করতে বাধা দেওয়া হয়। ছয় ঘণ্টা ক্লাসের  বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল তাঁরা। শুক্রবারও একই ভাবে তাঁদের ক্লাসে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। এছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছে চারটে ঘটনার ভিডিও। একটিতে দেখা গেছে, শ’খানেক ছাত্র গেরুয়া শাল পরে একজন বোরখা পরিহিত মুসলিম তরুণীকে "জয় শ্রীরাম" স্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে এবং সেই তরুণীটি পাল্টা "আল্লাহ্‌ আকবর" স্লোগান দিচ্ছে। দ্বিতীয় ভিডিওয় দেখা যাচ্ছে কর্নাটকের একটি স্কুলে গেরুয়া পতাকা উত্তলন করছে রামের নামে স্লোগান দেওয়া একজন তরুণ। তৃতীয় ভিডিওতে, একটি বন্ধ ক্লাসরুমের বাইরে বেশকয়েকজন উত্তেজিত যুবকেদের "জয় শ্রীরাম" স্লোগান ও দরজা খুলে দিলে তাদের হুড়মুড়িয়ে ভেতরে প্রবেশ। চতুর্থ ভিডিওতে দেখা গেছে, রাস্তা দিয়ে যাওয়া কয়েকজন বোরখা পরিহিত তরুণীদের উদ্দ্যেশ্যে একদল যুবকেরা জল ছুঁড়ে দিচ্ছে। 


এইমূহুর্তে অন্য কিছু আলোচনা কোথায় যেন হাওয়া। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে সোশ্যাল মিডিয়া, মাছবিক্রেতা মন্ডলদা থেকে বাড়ির পরিচারিকা মুন্নির এখন একটাই প্রধান ইস্যু -"হিজাব"। ওদিকে, সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকা এবং আতঙ্কে রাখা মিডিয়াতেও করোনাতঙ্ক ভ্যানিশ হয়ে হিজাব বিতর্কটাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। শুরুতে যে ঘটনাটা উল্লেখ করেছি সেটা খুবই সাধারণ একটা ব্যপার, হটাৎই স্মরণে এলো বলেই লিখলাম। কিন্তু কোথাও যেন এই হিজাব বিতর্কের সাথে সামঞ্জস্য রয়েছে। আমি কি পোশাক পরবো, কি বই পড়বো, কোথায় ঘুরবো, কি খাবো কিংবা কি দেখবো অথবা শুনবো সেটা সম্পূর্ণ আমার অথবা একজন ব্যক্তিনির্ভর ব্যপার। এতে কেউই হস্তক্ষেপ করতে পারেনা অথবা জোর করে কিছু চাপিয়েও দিতে পারেনা। 


ইসলামধর্মাবলম্বী পরিবারের কোনো মহিলা যদি স্ব-ইচ্ছায় হিজাব কিংবা বোরখা পরিধান করতে চান তাহলে ব্যপারটা আলাদা কিন্তু কোনো মহিলাকে জোর করে উক্ত জিনিস দুটো পরিধান করানো কিন্তু অবশ্যই নিন্দনীয়। তাছাড়া একটা বাস্তব সত্যি হচ্ছে, বোরখা কিংবা হিজাব মধ্যযুগীয় কু-প্রথা এবং অবশ্যই কট্টর পুরুষতান্ত্রিক। আমার পরিচিত একজন দিদি সোশ্যাল মিডিয়াতে ঠিক এমনই কিছু লিখেছিলেন সম্প্রতি। দেখলাম, সেখানে একজন বাংলাদেশের মুমিন ব্যক্তি কমেন্টে লিখেছে - " ও হিন্দুম্যাডাম, এসব ডায়লগ নিজের বাড়িতে বসে ঝাড়ুন গে। আপনি বিকিনি পরে কিংবা উলঙ্গিনী হয়ে ঘুরতে ভালোবাসতে পারেন, তবে আমাদের ইসলাম একে মান্যতা দেয়না। শুধু চোখ দুটি ছাড়া নারীকে পর্দানশীন রাখা ইসলামের অঙ্গ। তাই না জেনে উল্টোপাল্টা লিখবেন না। আমাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত দেওয়ার আপনি কে হে? "।


প্রিয় বন্ধুরা, লক্ষ্য করুন এই ব্যক্তির বক্তব্য যা অনেককিছুই স্পষ্ট করে দিচ্ছে। যারা নারীকে সম্মান জানতে পারেনা, যাদের কাছে একজন নারী শুধুমাত্র "মানুষ" না হয়ে, ভোগের সামগ্রী হয়ে ওঠে, যারা নারীকে শিক্ষার আলো থেকে শতহস্ত দূরে রেখে নিজেদের বানানো আইনে শৃঙখলাবৃত করে রাখতে পছন্দ করে তারা চাইবেই নারীকে সারাজীবন পর্দানশীন রাখতে। এইসব নারীলোভীদের এই প্রশ্নটা করলেই দেখবেন তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে যে, "তাহলে কি এটাই মেনে নেবো যারা নারীকে পর্দানশিন রাখতে একপ্রকার ফতোয়া জারি করেছে তারা প্রত্যকেই ছিল নারীভোগী। তাই অন্য পুরুষের কু-নজর থেকে বাঁচতে এমন বিধান লিখেছিলেন?" মজাটা হচ্ছে, সেই ব্যক্তির যুক্তি মানলে এটাই দাঁড়ায় পৃথিবীর সকল পুরষেরাই যেহেতু নারীলোভী তাই নারী নিজেকে সর্বদা পর্দানশিন রাখবে নিজেকে। সত্যি, হাস্যকর (কু)যুক্তি। এমন অদ্ভুত নিয়মকানুনের ফতোয়া যে ধর্ম দেয়, তাকে কি সহিষ্ণু, মানবিক বলা চলে? প্রত্যেক দেশেই রয়েছে নানানরকম ধর্মীয় নিয়মের বাঁধন তাই অন্যান্য দেশের কথা বাদ দিয়ে শুধুমাত্র ভারতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পারছি যে, দেশে প্রতি দিন ৯১ টি ধর্ষণ ঘটনা ঘটে ( সূত্র- আনন্দবাজার পত্রিকা, ১০ জানুয়ারি ২০২০, পৃ.৬)। কিছু অতিবোদ্ধারা ধর্ষণের ঘটনায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নারীকে দোষারোপ করে, বিশেষ করে তার সাজপোশাক কে। কিন্তু এইসব অতিবোদ্ধাদের কেউ এটা অবশ্যই জানিয়ে আসবেন যে, ধর্ষণের ক্ষেত্রে শুধু এবং শুধুমাত্র বিকৃত মানসিকতা, যৌন বিকার ইত্যাদি প্রধান দায়ী, সাজপোশাক নয়। এই মানসিক বিকারগ্রস্তদের কারনেই আসিফা, নির্ভয়া, পুতুল, হাথরস, উন্নাও, বিন্দুদের মতন ঘটনাগুলো ঘটে চলেছে আকছার। সরকারের অপদার্থতায় এবং রাজনৈতিক পরিচয় ও অর্থের জোরে ধর্ষকদের মতন জঘন্যতম অপরাধীরা আইনকে পকেটে পুরে প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়ায়। জনগণের দেওয়া করের টাকায় এইসব অপরাধীদের জেলে বসিয়ে চারবেলা খাওয়ানোর কি প্রয়োজন জানা নেই। এদের জন্য একটাই শাস্তি - To be hang till death. (এখানে অনেকেই হয়তো বলতে পারেন ফাঁসি কেন? তাদের বলবো সভ্য দেশে ফাঁসি হয়না। কিন্তু যেখানে প্রতিদিন ৯১ টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে সেই দেশটাকে সভ্য দেশ কিভাবে বলবো?) 


যাইহোক মূল আলোচনা অর্থাৎ হিজাব নিয়ে যে বিতর্ক সেখানে ফেরা যাক। তার আগে একটি বিশেষ খবরের দিকে পাঠক বন্ধুদের দৃষ্টি আকর্ষন করতে চাই। ঘটনাটি মার্চ ২০১৮ সালের। মহারাষ্ট্রর থানে জেলার ‘সাঁই হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ'এর একজন শিক্ষার্থীকে হিজাব পরবার অনুমতি দিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশনা দেয়ার জন্য হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেছিলেন। 

তার পিটিশনে বলা হয়, তাকে হিজাব পরে তার কলেজে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি দেয়া হোক অথবা অন্য কোনো কলেজে তাকে স্থানান্তর করার অনুমতি দেওয়া হোক যেখানে কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতা ছাড়াই তিনি তার ধর্মীয় বিশ্বাস অনুশীলন করতে পারেন।

এছাড়াও কারো ধর্ম বিশ্বাসের ওপর কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেন এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি করতে না পারে, সেজন্যও জন্য পিটিশনে আদালতের নির্দেশনা চাওয়া হয়েছিল। 


সেই শিক্ষার্থীর আইনজীবী মিহির দেসাই জানিয়েছিলেন, হিজাব পরে লেকচারে উপস্থিত হওয়ার অনুমতি না দেয়ার কারণে তার মক্কেল ঠিকমত কলেজে উপস্থিত হতে পারেন নি। কলেজে প্রয়োজনীয় সংখ্যক দিন উপস্থিতি না থাকার কারণে তাকে গত বছরের পরীক্ষায় অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। মেডিকেল কলেজের ওই শিক্ষার্থী আদালতকে আরও জানায় যে, তিনি যখন কলেজে ভর্তি হন, তখন তিনি বোরখা ও পরতেন না। ওই সময় এই নিষেধাজ্ঞা কেবল বোরখাতেই ছিল।


বিচারপতি আর এম সাভান্ট ও সারাঙ্গ কোতওয়ালের একটি বেঞ্চে এই রিট আবেদনের শুনানি হয়।

আবেদনকারী তার আবেদনে বলেন, তিনি কেবল হিজাব এবং একটি লম্বা গাউন পরতে চান এবং অন্য ছাত্রীদের মতোই এর উপরে অ্যার্পন পরতে ইচ্ছুক। সব পক্ষের বক্তব্য শুনানির পরে আদালত শিক্ষার্থীদেরকে হিজাব এবং গাউন পরার অনুমতি দিতে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়কে নির্দেশ দেন। কলেজ থেকে স্থানান্তরের জন্য প্রার্থনার প্রয়োজন নেই সেটাও জানিয়ে আদালত পিটিশনটির নিষ্পত্তি করেন। 


তাহলে এখন এটা স্পষ্ট, এই হিজাব বিতর্ক আজকের নতুন কিছু নয়। বহুবছর ধরেই বিষয়টি নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থেকে গেছে। মুসলিম সম্প্রদায়ের একশ্রেণীর ব্যক্তিদের দাবী- "এটা আমাদের ইসলামে স্বীকৃত ব্যপার। আমাদের বাড়ির মেয়ে বউরা কি পোশাক পরে বাইরে বেরুবে সেটা নিয়ে যেচে কেউ যেন জ্ঞান না দেয় অথবা অন্যকেউ যেন এতে নিজেদের নাক না গলায়। আমাদের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত যেন না লাগে এটা সকলের দেখা বিশেষ প্রয়োজন "। 


সত্যিই, ধার্মীকরা বড়ই মিষ্টি। "আমার ধর্ম ইসলাম পৃথিবীর সবেচেয়ে সুন্দর, মানবিক, সহিষ্ণু, শান্তি-সম্প্রীতির ধর্ম" ইত্যাদি বলে প্রচার করলেও যখনই তাদের স্বার্থে আঘাত লাগে তখনই নিজদের ভদ্র মুখোশের আড়ালে থাকা কুৎসিত মুখটা বের করে এনে উগ্রধর্মান্ধতার ভয়াবহতা কেমন হতে পারে সেটা প্রকাশ করে ফেলে এরা (বহুর মধ্যে উদাহরণ, বাংলাদেশে একের পর এক মুক্তমনা ব্লগার দের নৃশংশভাবে হত্যাকান্ড)। তখন, শান্তি-সম্প্রীতি, সহিষ্ণু মানবিক ইত্যাদি কথাগুলো কেমন যেন জেলো হয়ে যায়। এই ব্যপারটা পৃথিবীর প্রায় সবকটি প্রতিষ্ঠানিক ধর্মের (Religion) অনুসারী ধার্মিকদের ক্ষেত্রেই সমান প্রযোজ্য।


আজ এটা দিনের আলোর মতন স্পষ্ট, একটি পুরোনো বিতর্কিত বিষয়কে ইচ্ছেকরেই প্রচারে আনা হচ্ছে এবং একটি রাজনৈতিক দল ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থে বিষয়টাকে খুঁচিয়ে বের করে এনে বিতর্কের আগুন পোহাচ্ছে। আরেকটি কথা, যেসকল তরুণেরা গলায় গেরুয়া গামছা পরে জয় শ্রীরাম স্লোগান দিচ্ছে তাদের উস্কানিও এরাই দিচ্ছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে। এইসব তরুণ যুবকরা "ধর্ম" নামক আফিমে এতোটাই আচ্ছন্ন যে, এরা জানেও না কোন মারণ ফাঁদের দিকে এরা নিজেদের পা বাড়াচ্ছে। নিজেদের রাজনীতির স্বার্থেই যারা এদেরকে ব্যবহার করছে তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে গেলে এইসব যুবকেরাও শেষ। এদের কি মনে হয় সরকার ওদের জন্য উচ্চশিক্ষা এবং তারপরে একটা ভালো স্থায়ী চাকরির ব্যবস্থা করবে? তাহলে অনুরোধ, টিভিতে পোগো চ্যানেল এদের জন্য আদর্শ। (তবে "জয় শ্রীরাম" স্লোগানের সেইসব যুবকদের যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হিজাবের বিরুদ্ধে সোচ্চার  সেইসব হিন্দুবীর যুবমোর্চাকে গৈরিক শুভেচ্ছা জানাই। জনগণের পরিহিত কোনো পোশাক কিংবা যে কোনো চিহ্ন যেটা কোনো ধর্মীয় ইঙ্গিত বহন করে, সেটা অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। ওমুক যায়গায় তমুক লেখা রয়েছে তাই চলবে কিংবা দীর্ঘবছর ধরে এই নিয়ম চলে আসছে বলেই চলতে দেওয়া হবে এটা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারনা। সমস্ত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের কাছে জিজ্ঞাস্য, চুরিবিদ্যাটা যুগযুগ ধরে চলে আসছে কিংবা ধর্ষণের মতন চরমতম অপরাধ যুগে যুগে ঘটে চলেছে বলে কি আপনি আজও এসব মেনে নেবেন? তবে আশা রাখবো, কোনো মহিলার হিজাব ব্যান করার আন্দোলনে নামার আগে নিজের কাঁধের গেরুয়া গামছা থেকে শুরু করে নিজের মা,বোন, দিদি, স্ত্রীর শাঁখা, সিঁদুর, ঘোমটা আর ব্রাহ্মণদের পৈতে, টিকি, তিলক অবশ্যই বাতিল করে তারপর যেন মুসলিম মহিলাদের হিজাব বাতিলের জন্য নামবে এই তরুণ শক্তিতে পরিপূর্ণ হিন্দুবীর যুবমোর্চা বাহিনী।)


বিগত ৪৫ বছরের মধ্যে সর্বচ্চ বেকারত্ব কিন্তু একজন মন্ত্রীমশাইয়ের রাজত্বে। "চাকরি দেওয়ার দায় সরকারের নয়।" সংসদে দাঁড়িয়ে সম্প্রতি এমনই বুঝিয়ে দিয়েছেন সেই মন্ত্রীমশাই। এছাড়া উনি স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, "দেশে বেকারত্বও নেই, মূল্যবৃদ্ধিও নেই।" ২০১৪ সালে যিনি বলেছিলেন, বছরে ২ কোটি চাকরি দেওয়া হবে, সেই মন্ত্রীমশাই এটাও জানিয়ে দিয়েছেন - "কর্মসংস্থানের জন্য সরকারের উপর ভরসা করে থাকার দিন শেষ হয়েছে। সবকিছু সরকার করে দেবে এই ভাবনা আর চলবে না। আগে মনে করা হতো, সরকারই ভাগ্যবিধাতা, সেই জীবিকার সব দায়িত্ব নেবে। কিন্তু এই ভাবনা ভুল। যুবসমাজ নিজে নিজেকেই গড়বে।" 


অন্যদিকে, দিনকয়েক আগে কেন্দ্রীয় বাজেট (Union Budget 2022) পেশ করতে গিয়ে ভারতের মাননীয়া অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন- "আগামী পাঁচ বছরে ৬০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থান হবে।" অর্থাৎ প্রতি মিনিটে কি ২.২৮ জনের চাকরি? আরেকটি কথা, এই কেন্দ্রীয় বাজেটে বড়বড় শিল্পপতিদের ট্যাক্স ১৮% থেকে কমিয়ে ১৫% করা হলেও সাধারণ মানুষের ট্যাক্স একটাকাও কমানো হয়নি। 


১০ ফেব্রুয়ারী ২০২২ তারিখে কর্ণাটক হাইকোর্ট অন্তবর্তী রায়ে জানিয়েছিল- " শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোন ধর্মীয় পোশাক নয়"। এই রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে সর্বোচ্চ আদালতে গিয়েছে সেইসকল তরুণীরা যারা দাবী জানাচ্ছে "হিজাব আমাদের সাংবিধানিক অধিকার "। 


এখন প্রশ্ন হচ্ছে, হিজাব পরার কী সাংবিধানিক অধিকার রয়েছে? ভারতীয় সংবিধানে কিন্তু সরাসরি ভাবে হিজাব পরার কোনো উল্লেখ নেই,  আর্টিকেল ২৫ (১)- এ সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে “Freedom of conscience and the right to freely profess, practise, and propagate religion.” সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে নিদান দিয়েছেন যে অত্যাবশ্যক ধর্মীয় আচরণ পালনে বাধা দেয়া যাবে না। ভারতীয় সংবিধানের ধারা-২৫ এর প্যারা নং ২ বেশ অন্যরকম। অবশ্য এগুলো যুক্তিবিদ্যার বিষয়। আবেগের নয়। কারন, আবেগ যুক্তির প্রধান শত্রু। অন্যদিকে সংবিধানে ১৫৩এ, ২৯৫,২৯৫এ ইত্যাদি ধারাগুলোও আছে। আসলে ভারতের সংবিধানে এমন অনেক কিছুই রয়েছে যা বিতর্কিত আবার এমনও অনেক কিছু রয়েছে যা যথেষ্ট চিন্তার খোরাক যোগাতে বাধ্য। 


ভারতীয় সংবিধানের তৃতীয় খন্ডে, দেশের নাগরিকদের ছয়টি (৬) মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। যেমন -  (১) সাম্যের অধিকার, (২) স্বাধীনতার অধিকার, (৩) শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার, (৪) সংস্কৃতি ও শিক্ষা বিষয়ক অধিকার, (৫) শাষনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের অধিকার এবং 

(৬) ধর্মীয় অধিকার। এই বিষয়ে সামান্য আলোচনার অবকাশ রয়েছে। সংবিধান আমজনতাকে দিয়েছে ধর্মপালন বা ধর্মাচারণ করার স্বাধীনতা কিন্তু সেটা কখনওই প্রকাশ্যে নয় বরং একান্তে, ব্যাক্তিগত ভাবে। 


পৃথিবীতে ৫৬ টি ইসলামিক রাষ্ট্রে হিজাব বা বোরখা পরিধান বাধ্যতামূলক। এরমধ্যে, আফগানিস্তান, ইরান, মৌরিতানিয়া, ব্রুনেই, মালদ্বীপ, সৌদি আরব অন্যতম। শরিয়া আইনে চলা রাষ্ট্রে একজন অমুসলিম মহিলাকেও পাবলিক প্লেসে মাথায় কাপড় দিতেই হয়। নয়তো শরিয়া আইন লংঘনের অভিযোগে শাস্তি দেয়া হয়। বিশেষ করে ইরানে বিষয়টি গর্হিত অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। 


অপরদিকে পৃথিবীর বেশকিছু ইসলামিক রাষ্ট্রে মুসলিম এবং অমুসলিম দেশে বোরখা বা হিজাব নিষিদ্ধ। যেমন, তাজিকিস্তান, সিরিয়া, তিউনিসিয়া (এই দেশের ধর্মনিরপেক্ষ বা Secular সরকার হিজাবকে Fundamentalism আখ্যা দিয়ে নিষিদ্ধ করেছে। তাদের যুক্তি, Hijab is the tool of Political Islam and Oppression Against Women), কসোভো,আজারবাইজান, মিশর (এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে নিকাব পড়া নিষিদ্ধ। ক্লাস চলাকালীন পুরো মুখ ঢেকে রাখা যাবে না। ২০১৫ সাল থেকে এই আইন বহাল আছে), তুর্কি (মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক পাবলিক প্লেসে যেকোনো ধরনের ধর্মীয় পোশাক পড়া নিষিদ্ধ করেছিলেন। তা প্রায় ৮০ বছর বহাল ছিলো কিন্তু ২০১৩ সালে এরদোয়ান সেই আইনে পরিবর্তন এনেছেন), কাজাখস্তান, কিরঘিস্তান, মালয়েশিয়া, আলজেরিয়াসহ আরো বেশ কিছু মুসলিম দেশে হিজাব বা বোরকার প্রতি বেশ কিছু বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এছাড়া, অমুসলিম দেশগুলোর মধ্যে ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, বুলগেরিয়া, সুইজারল্যান্ড, গ্যাবন,চাদ, কঙ্গো,নেদারল্যান্ডস, চীন, শ্রীলংকা ইত্যাদি দেশ হিজাব বা বোরখা নিষিদ্ধ করেছে,


আসলে, কিছু দেশ পাবলিক প্লেসে হিজাব পড়লে শাস্তি দেয়। আবার কিছু দেশ পাবলিক প্লেসে হিজাব না পড়লে শাস্তি দেয়। ফলে এটি এখনও অত্যন্ত অদ্ভুত এবং বিতর্কিত। 


এই প্রশ্নটা এখন বেশি উঠে আসছে যে, সংবিধান বর্ণিত  ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ভারতে কী হিজাব নিষিদ্ধ হবে? আসলে উত্তরটি জটিল। তবে দেখাযাচ্ছে ভারতে নির্বাচনী হাওয়া এলে এইরকম একটু আধটুক উস্কানি দেখতে হতে পারে। ঠিক যেমন ২০১৯ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচনের ঠিক আগেই পুলওয়ামার নৃশংশ হত্যাকান্ড। এই কান্ডে আমরা দেখলাম অদ্ভুত এক পরিস্থিতি। একদল উগ্রদেশপ্রেমীরা একপ্রকার মেরে ধরে আমাদের দেশপ্রেম শেখাতে নেমেছিল। যে অথবা যারাই এই হত্যাকান্ড নিয়ে বেশকয়েকটি প্রশ্ন তুলেছিলেন তারাই আক্রান্ত হয়েছিলেন এই স্বঘোষিত দেশপ্রেমী দলের হাতে। ফিরি হিজাব প্রসঙ্গে, ভারতের কেন্দ্রশাসিত সরকার রাজ্য সরকারকে কোনো আইন মানতে বাধ্য করাতে পারে না। তাই একেক রাজ্য একেক পদ্ধতিতে হয় হিজাব বাতিল করবে নয়তো হিজাব পড়ার অনুমতি দিবে হাইকোর্ট থেকে সুপ্রিমকোর্ট।


যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানমনষ্ক সংগঠনের দাবী- "শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হোক প্রতিষ্ঠানিক ধর্ম এবং সমস্তরকম ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানবিহীন, সেখানে বিভিন্ন ধর্মগুরুদের জীবনীপাঠও বন্ধ হোক। ছাত্র-ছাত্রীরা স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে শিক্ষার্জন করুক, বৃদ্ধি পাক তাদের জ্ঞানের উন্মেষ, তারা হয়ে উঠুক মুক্তমনা, বিজ্ঞানমনষ্ক এবং মানবতাবাদী"। তাই শিক্ষাপ্রাঙ্গনে হিজাবই হোক কিংবা গেরুয়া গামছা দুটোই পরিধান বন্ধ হোক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মীয় অগ্রাসনের এই রাষ্ট্রীয় চক্রান্তের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তুলুন। শিক্ষাপ্রাঙ্গনে জয় শ্রীরাম কিংবা আল্লাহ্‌ আকবর দুটো স্লোগানেরই বিরোধীতা করুন। 

হিজাব /বোরখা আমার চয়েস বলে অনেকেই গলা ফাটাচ্ছেন। কিন্তু বাস্তবে ওগুলোর কোনটাই কারোর 'চয়েস' নয়। ওগুলো ধর্ম এবং পুরুষতন্ত্রের চাপিয়ে দেওয়া নিয়মকানুন / রীতিনীতি। আমি, সমস্ত প্রতিষ্ঠানিকধর্ম (Religion) মুক্ত একটা সুন্দর শিক্ষাঙ্গন চাই। সম্পূর্ণ ধর্মমুক্ত। আর ধর্ম! সেটা না হয় থাকুক ব্যক্তিগত পরিসরে।


পরিশেষে বলতে চাই, একটা শিশু, সে যেকোনো ধর্মীয় বিশ্বাসী পরিবারেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন সেই শিশুটি জানেই না তার ধর্মবিশ্বাস কি। শিশুটি জানেই না কেন বহুসংখ্যক হিন্দু-মুসলিম দের মধ্যে কেন একটা ঠান্ডা গরম লড়াই চলছে কিংবা ভারত পাকিস্তান কেন ভাগ হলো ইত্যাদি। শিশুটি শুধুই জানে প্রাণখুলে আনন্দ করতে, খেলতে। শিশুর মন একটা মাটির তালের ন্যায়। আমি, আপনি সেই তাল কে যেভাবে গড়তে চাইবো সেভাবেই গড়ে উঠবে। তাই অনুরোধ, ধর্মান্ধ মস্তিষ্কে যুক্তির সন্ত্রাস গড়তে চাইলে, আপনার শিশুটিকে প্রাণখুলে আনন্দ করতে দিন। ওকে স্বাভাবিক ভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করুন। কোনোরকম ধর্মীয় নিয়মকানুন ইত্যাদি ওর মননে গেঁথে দেবেন না। শিশুটি বড় হলে ওকেই এটা সিদ্ধান্ত নিতে দিন সে, সরকারি কিংবা বে-সরকারি ফর্মের Religion কলামে Hinduism, Islam, Christian, Buddhist, Jainism, Sikhism ইত্যাদি যে ৪২০০ ধরনের Religion রয়েছে তার মধ্যে আদৌ কোনটা বেছে নিতে ইচ্ছুক, নাকি অনেকের মতন জন্মসূত্রে পাওয়া ধর্মীয় পরিচয় ত্যাগ করে Religion কলামে HUMANISM / ATHEISM / NON RELIGIOUS ইত্যাদি কিছু লিখতে চায়। সমস্ত অভিভাবকদের কাছে অনুরোধ, শৈশবে শিশুদের মননে ছ্যুত অছ্যুৎ, জাতপাত, ধর্মীয় নিয়মকানুন, বিদ্বেষ ইত্যাদি ঢুকিয়ে উগ্রধর্মান্ধ তৈরী হওয়ার দিকে ঠেলে দেবেন না। 


আরেকটা জিনিস মনে রাখবেন, ভারতের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকদের জন্য আশু কর্তব্য হিসেবে বলা হয়েছে, "It shall duty of every citizen of India to develop the scientific temper humanism and the spirit of inquiry and reform {Article 51A(h)Part iv A}" অর্থাৎ, বিজ্ঞানমনস্কতা, মনুষ্যত্ব এবং অনুসন্ধিৎসা ও সংস্কার সাধনের মানসিকতার বিকাশ ঘটানো। 


অতিরিক্ত সংযোজন : আজ ১৫ ফেব্রুয়ারী ২০২২। গতকাল ছিল প্রেমের দিন। ভালোবাসার দিনেও হিজাব নিয়ে বিতর্ক অব্যাহত। হিজাব সংক্রান্ত 'এক্সক্লুসিভ খবর' নিয়ে খবরেরকাগজ গুলো লক্ষকোটি প্রিন্ট খরচ করতে যেমন ব্যস্ত, তেমনই অনলাইন নিউজ পোর্টালগুলোও এই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই। বহুর মধ্যে মাত্র ৬ টি খবর (বলতে পারেন টপ সিক্স) প্রিয় পাঠক বন্ধুদের জন্য তুলে ধরলাম। 


খবর ১) হিজাব ছোঁয়ার চেষ্টা করলে হাত কেটে ফেলব, এসপি নেত্রীর মন্তব্যে বিতর্ক তুঙ্গে। ১২/০২/২০২২। আনন্দবাজার পত্রিকা অনলাইন পোর্টাল।


উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা ভোটের মধ্যে হিজাব নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করলেন সমাজবাদী পার্টির নেত্রী রুবিনা খানম। অখিলেশের দলের নেত্রীর দাবি, ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের অন্যতম অঙ্গ মেয়েদের ঘোমটা এবং হিজাব। কিন্তু তা নিয়ে যে ভাবে রাজনৈতিকীকরণ করা হচ্ছে, তা ঘৃণ্য। এর পরই এসপি নেত্রীর হুঙ্কার, ‘‘যে হাত হিজাব ছোঁয়ার চেষ্টা করবে, সে হাত কেটে ফেলা হবে।’’

খবর ২) ‘শরিয়ত নয়, সংবিধান অনুযায়ী চলবে ভারত”, হিজাব বিতর্ক নিয়ে মুখ খুললেন যোগী আদিত্যনাথ।

১২/০২/২০২। বাংলা Hunt অনলাইন পোর্টাল।


কর্ণাটকে হিজাব বিতর্কের আলোচনা পুরোদমে। এদিকে, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, একটি সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে হিজাব বিতর্কে বলেছেন যে, দেশ শরিয়ত নয়, সংবিধান দিয়ে চলবে। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বলেছেন, দেশের ব্যবস্থা চলবে সংবিধান দিয়ে, শরিয়ত দিয়ে নয়। প্রতিটি সংস্থার নিজস্ব ড্রেস কোড প্রণয়নের অধিকার রয়েছে। সংবিধান অনুযায়ী ব্যবস্থা চলবে।


খবর ৩) হিজাব বিতর্কের আগুন এবার পশ্চিমবঙ্গে, মুর্শিদাবাদে তালাবন্দি শিক্ষকরা। ১২/০২/২০২২। বাংলা Hunt অনলাইন পোর্টাল।


হিজাব বিতর্কের গনগনে আগুনে পুড়ছে গোটা দেশ। এবার সেই উত্তাপের আঁচ এসে লাগল বাংলাতেও। স্কুল ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখালেন অভিভাবকরা। আটকে রাখা হল শিক্ষকদেরও। কর্ণাটকের হিজাব বিতর্কের উত্তাপে কার্যতই অগ্নিগর্ভ মুর্শিদাবাদের সুতি।অভিযোগ, ছাত্রীদের স্কুলে কালো ওড়না পরে আসতে নিষেধ করেন সুতির বহুতালি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। এই ঘটনা জানাজানি হতেই স্কুলে পৌঁছন পড়ুয়াদের অভিভাবকরা। কথা বলতে চাওয়া হয় প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে। কিন্তু ততক্ষণে দাবানলের মতন বাড়তে শুরু করেছে উত্তেজনা। এই খবর এলাকায় ছড়িয়ে পরে কয়েক মুহুর্তেই। স্কুল চত্ত্বরে এসে জড়ো হয় স্থানীয় বাসিন্দারা। প্রধান শিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষকদের তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয় একটি ঘরে। চলে অবস্থান এবং বিক্ষোভও। ঘটনার খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পৌঁছায় পুলিশ। শেষ অবধি বহুক্ষণের চেষ্টায় উদ্ধার করা হয় আটক শিক্ষকদের।


খবর ৪) ‘হিজাব পরা মহিলাই একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন’, চ্যালেঞ্জ ওয়েইসির।

১৩/০২/২০২২। সংবাদ প্রতিদিন অনলাইন পোর্টাল।  


হিজাব বিতর্কে (Hijab Row) নয়া মাত্রা যোগ করলেন AIMIM প্রধান আসাউদ্দিন ওয়েইসি। তাঁর কথায়, ভবিষ্যতে হিজাব পরিহিতা মহিলাই হবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। তাঁর এহেন মন্তব্য ঘিরেই নতুন করে বিতর্ক দানা বেঁধেছে।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়াদের হিজাব পরা উচিত নাকি অনুচিত, সেই বিতর্কের জল গড়িয়েছে সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত। এর মাঝেই উত্তরপ্রদেশের ভোটপ্রচারে হিজাব বিতর্ক টেনে আনলেন ওয়েইসি (AIMIM chief Asaduddin Owaisi)। এই ইস্যুতে বিজেপিকে তুলোধোনার পাশাপাশি মহিলাদের ক্ষমতায়ন নিয়েও মুখ খুললেন তিনি।


খবর ৫) হিজাব না পরার জন্যই ভারতে ধর্ষণ সবচেয়ে বেশি, কংগ্রেস বিধায়কের মন্তব্যে বিতর্কের ঝড়।

১৪/০২/২০২২। সংবাদ প্রতিদিন অনলাইন পোর্টাল। 


কর্ণাটকের হিজাব বিতর্কে (Hijab Row) পক্ষে-বিপক্ষে উত্তপ্ত বাক্যবাণ অব্যাহত। গতকাল AIMIM প্রধান আসাউদ্দিন ওয়েইসি (Asaduddin Owaisi) বলেন, হিজাব পরা মহিলাই একদিন দেশের প্রধানমন্ত্রী হবেন। আজ কর্নাটকের কংগ্রেস (Congress) বিধায়ক জমির আহমেদ (Zameer Ahmed) বিতর্ক আরও বাড়ালেন। বললেন, মহিলারা হিজাব পরেন না বলেই ভারতে ধর্ষণের হার সবচেয়ে বেশি। কংগ্রেসের বিধায়কের মন্তব্যে নিন্দার ঝড় উঠেছে নেট দুনিয়ায়।

রবিবার সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জমির আহমেদ বলেন,” ইসলাম ধর্মে হিজাব হল এক ধরনের পর্দা। একটা বয়সের পর মেয়েদের সৌন্দর্য লুকিয়ে রাখতে হিজাব ব্যবহার করা হয়ে থাকে। আজ ভারতে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে থাকে। এর কারণ কী? এই জন্যই যেহেতু অনেক মহিলাই হিজাব পরেন না।” জমির আরও বলেন, হিজাব কখনই বাধ্যতামূলক নয়, তবে যাঁরা নিজেদের সুরক্ষিত রাখতে চান, নিজের সৌন্দর্যকে সকলের সামনে প্রকাশ করতে চান না, তাঁরাই হিজাব পরেন। জমির দাবি করেন, “হিজাব পরার ব্যাপারটা নতুন না, বহুকাল ধরে এই রীতি প্রচলিত।”

খবর ৬) মেয়েটার নাম আরুশা পারভেজ (Aroosa Parvaiz) সমগ্র কাশ্মীরে ক্লাস ১২ এ প্রথম স্থানাধিকারী। সে ৪৯৯ নং পেয়েছে ৫০০ এর মধ্যে।কিন্তু তাঁর এই বিশাল সাফল্য তাঁকে অপমান, কটুক্তি, হুমকি থেকে বাঁচাতে পারেনি। কারন, কট্টরপন্থীরা একপ্রকার মেয়েটির হত্যার ফতোয়া জারি করেছে। কারন, মেয়েটার মাথায় হিজাব নেই। এটাই তার মস্তবড় অপরাধ। 

অবশ্য এই প্রতিভাবান মেয়েটি ভয়ে আতঙ্কে সিঁটিয়ে থাকেনি। কট্টরপন্থীদের যোগ্য জবাব সে দিয়েছে। আরুশার জানিয়েছে -"I don't need to wear hijab to prove a good muslim.These comments do not matter to me, but my parents are undergoing a trauma.My religion, my hijab and my Allah are my personal issues. What I should wear or not should not bother people if they believe in the greatness of my religion." অর্থাৎ, আরুশা জানিয়েছে, সে হিজাব পরবে কি পরবে না সেটা একান্তই তার ব্যাক্তিগত ব্যাপার। তাকে কেউ বাধ্য করতে পারে না।  

গোলটেবিলে সাফ জবাব, প্রসঙ্গে: স্বামী বিবেকানন্দ। -
অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | ভান্ডাফোঁড় | views:486 | likes:0 | share: 0 | comments:0

যদি প্রশ্ন করা হয় স্বামী বিবেকানন্দ কে ছিলেন, তাহলে এককথায় এর উত্তর হচ্ছে, উনি ছিলেন একজন স্ববিরোধী  সন্ন্যাসী। রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগরের মতন এমন কোনও উল্লেখযোগ্য কাজ করেননি যার জন্যে স্বামীজির নামে আবেগাপ্লুত হতে হবে। কিন্ত অন্ধভক্তদের এসব বোঝানো কঠিন। স্বামীজি কে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়াতে কিছু সমালোচনামূলক লেখার চেষ্টা করলেই কিছু অন্ধভক্তরা হা রে রে  করে ছুটে আসবেই। তারপর শুরু হবে আক্রমণ। গালাগাল, হুমকি, খিস্তি কিছুই বাদ যাবেনা। 


কোনো মানুষ ই সমস্ত দোষ ক্রুটি মুক্ত নয়। কারন দোষ মুক্ত মানুষের অস্তিত্ব কখনোই সম্ভব নয়। বিবেকানন্দ ও এর বাইরে নয়। এমন অনেকেই আছেন যারা বিবেকানন্দ কে চেনেন কিছু ভালো ভালো বাণী সংকলিত ঐ ১০/২০ টাকা দামের বই পড়ে নয়তো অন্যের মুখ থেকে শোনা কথায়। 


আসলে  - "সত্য ঠিক ততটাই প্রকাশিত হয় যতটা আমরা জানতে চাই অথবা আমাদেরকে জানানো হয় "। লাগাতার প্রচারের ফলে বিবেকানন্দ কে মহাপুরুষ, বিজ্ঞানীদেরও বিজ্ঞানী, তরুণ প্রজন্মের আদর্শ, সৎ, প্রগতিশীল,  যুক্তিবাদী ইত্যাদি নামে চালানো হয়েই চলেছে। এর পেছনে একটা বড় উদ্দ্যেশ্য তো অবশ্যই আছে। স্বামী বিবেকানন্দ কে চিনতে, জানতে, বুঝতে  -


দশ খন্ডের বাণী ও রচনা, 

পত্রাবলি,

স্বামীজি কে যেরুপ দেখিয়াছি,

স্বামী শিষ্য সংবাদ, 

জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, 

বিবেকানন্দ ও বাঙালির বিবেক, 

সেকুলার বিবেকানন্দ, 

বিবেকানন্দ অন্য চোখে, 

ইত্যাদি বই গুলো বেশ ভালো ভাবে এবং পাতায় পাতায় নিজের যুক্তিবোধ দিয়ে পড়া খুবই প্রয়োজন। অনেকের বাড়িতেই বিবেকানন্দ রচনাবলী থাকতে দেখা যায়, কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের প্রায় কেউই সেসব বই পুরো টা পড়েননি। অবশ্য না পড়ে না জেনে জ্ঞান দেওয়াও একটা বিরাট মাপের শিল্প। 

বিজ্ঞান বিরোধী, স্ববিরোধী বিবেকানন্দর পুর্নাঙ্গ জীবনী মন দিয়ে পড়লেই জানা যায় তিনি কেমন মানুষ। আজ একরকম বলছেন তো পরের দিন আরেক। 

যে কারনে রামমোহন কিংবা বিদ্যাসাগর মহাশয় কে শ্রদ্ধা করি, ঠিক তার বিপরীত মেরু তে অবস্থানকারী বিবেকানন্দকে সন্মান জানানো সম্ভব নয় কোনো মুক্তমনের যুক্তিবাদী মানুষের। তিনি, অনেক স্ববিরোধী কথা বলেছেন। জীবনে এমন কিছু করেছেন যা মানবতার বিরোধী। আবার যদি বলা হয় বিদ্যাসাগর, রামমোহন এনারা যা যা কাজ করেছেন আমরা জানি কিন্তু বিবেকানন্দ এমন কি করেছেন সমাজের জন্য? তখন আবার ব্যক্তি আক্রমণ ছাড়া কোনো সুস্পষ্ট উত্তর পাবেন না। আপনি মানুন অথবা না মানুন এটা সত্য যে, উনি অর্থাৎ স্বামীজি, জাত-পাত, অস্পৃশ্যতা, পশুবলি, সহমরণ প্রথা বাল্যবিবাহ  ইত্যাদি অনেক কিছুর পূর্ণরূপে সমর্থন জানিয়েছিলেন। বাল্যবিবাহ, বিধবাদের বিবাহ থেকে নারী স্বাধীনতার বিপক্ষে থেকে প্রমাণ করেছেন উনিও সেই পুরুষশাসিত সমাজের প্রাচীন পন্থী চিন্তাধারা থেকে মোটেই বেরিয়ে আসতে পারেন নি। 


অপ্রিয় সত্য এটাই যে, প্রগতিশীলতার মুখোশের আড়ালে ভন্ড সন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দই বলছেন "জ্ঞানোন্মেষ হলেও কুমোর কুমোরই থাকবে, জেলে জেলে, চাষা চাষা"(স্বামী শিষ্য সংবাদ)। ভাবতে পারছেন কি পরিমাণ জাতিবিদ্বেষ ছিলো আবার বলেছেন "বিধর্মী জাতিদের ভেতরে আদান প্রদান হওয়ার কথা আমি বলি না।" (বাণী ও রচনা, নবম খন্ড)

একজন ব্যক্তি নারীদের প্রতি কেমন দৃষ্টিভঙ্গি রাখতেন তার ওপর ব্যক্তিত্ব বুঝতে পারি ইনি কি বলেছেন, "ভক্তের বাড়িতে স্ত্রী ভক্তের হাতের রান্না খেওনা এতে মন নিম্নমুখী হয়" আবার বলেছেন,"কায়মনোবাক্যে পতিসেবা করাই স্ত্রী লোকের প্রধান কর্ম"। (শ্রীমতি ইন্দুমতী মিত্রর প্রতি পত্র)

এরকম একগাদা কথা পাতায় পাতায় ছড়িয়ে, কিন্তু না পড়লে জানবেন কিভাবে? 

যাদের মনে হবে ভুল বলেছি তাদেরকে অনুরোধ করবো পুর্নাঙ্গ বিবেকানন্দ কে পড়েই দেখুন এবং মিলিয়ে নিন আমার কথা। সত্য কিন্তু কখনো চাপা থাকেনা, একদিন সেটা ঠিকই প্রকাশ পাবেই।  সেদিন খুব দূরে নয় যখন মানুষ নিজেই চিনে নেবেন বিদ্যাসাগর না বিবেকানন্দ কাকে আদর্শ হিসেবে মেনে নেবে আগামী প্রজন্ম। 


যারা বিভিন্ন সভা সমাবেশে সোচ্চারে দাবী করেন যে স্বামীজি একজন খাঁটি মানুষ বিজ্ঞানীদেরও বিজ্ঞানী তাদের উদ্দেশ্যে একটি বক্তব্য বলেই শেষ করি, বেশ মজাদার বক্তব্য। বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখন্ড বাংলা সংস্করণ, প্রকাশক -নবপত্র, পৃষ্ঠা - ২৬৪ থেকে - 


" একটি ইস্পাতের পাত গড়ে তাকে কম্পিত করতে পারে এ রকম একটা শক্তি এতে প্রয়োগ কর। তারপর কি ঘটবে? যদি একটা অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, প্রথমে তুমি শুনতে পাবে একটি শব্দ - একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত করো,দেখবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হয়ে উঠেছে। শক্তি আরও বাড়িয়ে দাও,ইস্পাতটি একেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ইস্পাতটি মনে রুপান্তরিত হয়ে গেছে"।। 

একবার ভাবুন তো, স্বামীজি কতবড় বিজ্ঞানী দের ও বিজ্ঞানী!!  ইস্পাতের মাধ্যমে " মন " কেও যে তৈরি করা সম্ভব সেটা বিবেকানন্দই প্রথম আবিষ্কার করেছেন। 

বাল্যবিবাহ সমর্থনকারী বিবেকানন্দ, নাকি এর বিরোধী বিদ্যাসাগর?বেদান্তবাদী বিবেকানন্দ, নাকি বেদান্তবিরোধী বিদ্যাসাগর? বিধবা বিবাহের বিরোধী বিবেকানন্দ, নাকি সমর্থক বিদ্যাসাগর? ভাববাদের মুখোশের আড়ালে অন্ধবিশ্বাস এবং কু-সংস্কারকে প্রাধান্য দেওয়া বিবেকানন্দ, নাকি মুক্তমনা  বিদ্যাসাগর? কাকে বেছে নেবে আগামীপ্রজন্ম সেটা অবশ্যই জোর গলায় বলতে হবে এবং স্পষ্টভাবে। 

তাই নিজে পড়ুন, জানুন, সত্য কে উপলব্ধি করতে শিখুন। আগামীপ্রজন্মের মাথায় ভাববাদ অন্ধগুরুবাদ, অন্ধভক্তি, অন্ধশ্রদ্ধা ইত্যাদি না ঢুকিয়ে তাঁদেরকে মুক্তমনে ভাবতে শেখান। মুক্তমনা, যুক্তিবাদী, মানবতাবাদী গড়ে তুলুন আপনার আগামীপ্রজন্ম কে।

কিছু খবর:

১। বুজরুকির পর্দা ফাঁস বিজ্ঞান মঞ্চের


এই সময়, বনগাঁ: স্বয়ং কালীঠাকুর নাকি ভর করেন তাঁর উপর। প্রতি শনি-মঙ্গলে 'দরবার' বসত 'সাধক' রবীন দাসের। জ্বর-পেটখারাপ, চাকরি, বিয়ে, জমি বিবাদ সবেরই সমাধান বাতলে দেন রবীন। খবর পেয়ে বনগাঁয় রবীনের গ্রামে হানা দেন বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী মঞ্চের সদস্যরা। বিপদ বুঝে বুজরুকির কথা স্বীকার করে নেন রবীন।


সীমান্ত শহর বনগাঁর প্রত্যন্ত গ্রাম চাদার বিনয় কলোনিতে বাস রবীন দাসের। তাঁর বাড়িতেই রয়েছে কালীমন্দির। প্রতি মঙ্গল ও শনিবার ঠাকুর নাকি ভর করেন রবীনের উপর। এই দু'দিন মন্দিরের চাতালে বসেন রবীন। আর আশপাশের গ্রাম থেকে মানুষজন এই শনি -মঙ্গলে ভিড় জমান রবীনের কালীমন্দির চত্বরে। এই ভরে পড়াটা বেশ কয়েক বছর ধরেই চলে আসছে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেল, শুধু রবীন নয়, তাঁর সঙ্গে আরও তিন মহিলাকেও কোনও ঐশ্বরিক ক্ষমতা ভর করে। রবীন ও তাঁর তিন মহিলা সঙ্গী এই ভরে থাকা অবস্থায় লোকজনের দুঃখ-কষ্ট শোনেন। সমাধানের পথ বাতলে দেন। কেউ বাতের ব্যথায় কাবু তো কেউ দেনায় ডুবে রয়েছেন। কারও বিয়ে টিকছে না তো কারও সন্তান হচ্ছে না। সবই মনযোগ দিয়ে শোনেন রবীনরা। তারপর ভক্তদের সমস্যা বুঝে কারও হাতে ফুল, কারও হাতে বেলপাতা অথবা মাটি, শিকড়, মাদুলি, তাবিজ দেন। এ সবই সমস্যার সমাধান।


অনেকেই নাকি রবীনের টোটকায় উপকার পেয়েছেন। তাই ভক্তের সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছিল। ভক্তের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রবীনের পরিচিতিও আশপাশের গ্রাম পেরিয়ে দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়ছিল। সেভাবেই রবীনের কথা জানতে পারেন বিজ্ঞান এবং যুক্তিবাদী মঞ্চের সদস্যরা।


এ দিন মন্দির চত্বরে ভক্ত সেজে হাজির হন বিজ্ঞান মঞ্চের কয়েকজন সদস্য। কিন্তু কোনও ভাবে তা কানে ওঠে রবীনের। বিপদ আঁচ করে খানিক বাদে রবীন বলে ওঠেন আজ কেউ মাছ-মাংস খেয়ে এসেছেন। তাই মা আসছেন না। আপনারা আজ ফিরে যান। তখন বিজ্ঞান মঞ্চের একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলেন, এর আগেও মাংস খেয়ে এসেছি। তখন তো ঠাকুর আপনার উপর ভর করেছিলেন। আজ কেন হচ্ছে না? আপনি মাকে নিয়ে আসুন। আমরা অপেক্ষায় আছি।' এরপরই নিজেদের আসল পরিচয় দেন বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে গলা মেলান ভক্তদের আনেকেই। সুযোগ বুঝে মন্দিরের ভেতরে ঢুকে দোর এঁটে দেন রবীন। তাল বুঝে চম্পট দেয় রবীনের সঙ্গী তিন মহিলাও। মন্দির চত্বরে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়ে যায়।


একটু পর দরজা খুলে বেরিয়ে আসেন রবীন। বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা চেপে ধরলে বুজরুকির কথা স্বীকার করে নেন। করজোড়ে গ্রামবাসীদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন। ভবিষ্যতে কোনও দিন এ সব করবেন না বলে কথাও দেন। এরপর বিজ্ঞান মঞ্চের সদস্যরা গ্রামবাসীদের অন্ধ বিশ্বাসের কবল থেকে বেরিয়ে আসার অনুরোধ করেন। বিজ্ঞান মঞ্চের কথায় সবচেয়ে বেশি সাড়া আসে মহিলাদের কাছ থেকেই।

https://eisamay.indiatimes.com/west-bengal-news/kolkata-news/buzruki-seen/articleshow/71070677.cms


২। ‘নাসা’ যাওয়ার ডাক পেল পুরুলিয়ার কিশোরী

" ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি " র সহ সভাপতি এবং পুরুলিয়া শাখা সম্পাদক মধুসূদন মাহাত কে জানাই আন্তরিক ধন্যবাদ। তার প্রচেষ্টায় ফাঁস হয়েছিল এক বিশাল বুজরুকি। বিস্তারিত জানতে পড়ুন..


আনন্দবাজার পত্রিকা : 

নিজস্ব সংবাদদাতা, পুরুলিয়া, ১৯ অগস্ট, ২০১৯


বড় হয়ে সে মহাকাশে যেতে চায়। তার আগেই, পুরুলিয়া শহরের কিশোরী অভিনন্দা ঘোষের হাতে যেন চাঁদ এসে হাজির। দিল্লির একটি বেসরকারি সংস্থা আয়োজিত বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে সফল হয়ে সুযোগ মিলেছে ‘নাসা’-য় পাড়ি দেওয়ার।  নবম শ্রেণির ছাত্রীটি বলছে, ‘‘খবরটা পাওয়ার পরে আনন্দে কিছু ক্ষণ কথাই বলতে পারিনি। নাসায় যাওয়ার স্বপ্ন এত দ্রুত সফল হবে ভাবতেই পারছিলাম না।”


তেলকলপাড়ার বাসিন্দা অভিনন্দা পুরুলিয়া শহরের একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। বাবা সজল ঘোষ ও মা সুস্মিতা রায়চৌধুরী শহরের দু’টি স্কুলে ইংরেজি পড়ান। চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারে ‘ন্যাক’ ছিল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাসের কম্বলের। তবে সে গিয়েছিল ছাদে। জাঁদরেল মাস্টারমশাইয়ের হাত থেকে বাঁচতে বিচ্ছু ছেলে ঘাপটি মেরেছিল চিলেকোঠার ঘরে। আর নাস্তানাবুদ হয়েছিল টেনিদারা। সজলবাবুরা জানাচ্ছেন, অভিনন্দার কিন্তু ছোট থেকে পড়াশোনাই ধ্যানজ্ঞান। চতুর্থ শ্রেণি থেকে প্রতি বছর অলিম্পিয়াডে বসছে। আলাদা ভাবে কোনও প্রশিক্ষণ নেয়নি। অভিনন্দার কথায়, ‘‘পরীক্ষা নিয়ে এখন আর ভয়ডর করে না। পরীক্ষাটা উপভোগই করেছি।” জানাচ্ছে, অল্প সময়ে অনেকগুলি উত্তরের মধ্যে থেকে ঠিকটা বেছে নিতে হয়েছিল পরীক্ষায়। আর প্রস্তুতিতে যাবতীয় সাহায্য করেছেন স্কুলের শিক্ষকেরাই।


কৃতী ছাত্রী হিসেবে স্কুলে তার নামডাক রয়েছে। গত নভেম্বরে দিল্লির বেসরকারি সংস্থার বিজ্ঞান অলিম্পিয়াডে স্কুল স্তরের পরীক্ষায় বসেছিল অভিনন্দা। সফল হয়ে সেখান থেকে রাজ্যস্তরে। অগস্টের গোড়ায় দিল্লিতে ইসলামিক কালচার সেন্টারে সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষাটি হয়। 


অভিনন্দার স্কুলের শিক্ষক তথা ওই বেসরকারি সংস্থার পরীক্ষার কো-অর্ডিনেটর সুদীপচন্দ্র দাস জানান, সর্বভারতীয় স্তরের পরীক্ষায় প্রায় ১৮ লক্ষ প্রতিযোগী ছিল। সফলদের শিক্ষামূলক ভ্রমণে আমেরিকার ‘ন্যাশনাল অ্যারোনটিক্স অ্যান্ড স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের’ (নাসা) ‘কেনেডি স্পেস সেন্টারে’ নিয়ে যাবে সংস্থা। দলে সুযোগ পেয়েছে অভিনন্দা। স্বাধীনতা দিবসে সংস্থার তরফে স্কুলে ফোন করে সেই খবর দেওয়া হয়। তবে, কবে রওনা হতে হবে সেই কথা এখনও জানানো হয়নি।


স্কুলের পড়াশোনার বাইরে নিয়ম করে পড়ে বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন বই ও প্রবন্ধ। সম্প্রতি মুক্তি পেয়েছে ‘মিশন মঙ্গল’ নামে হিন্দি ছবি। মঙ্গল-অভিযানে একঝাঁক মহিলা বিজ্ঞানীর ভূমিকা তুলে ধরেছেন পরিচালক। ইচ্ছা থাকলেও পড়ার চাপে সেই ছবি দেখা হয়নি অভিনন্দার। তবে তাকে অনুপ্রানিত করেছে ‘চন্দ্রযান ২’ অভিযানে মহিলা বিজ্ঞানীদের ভূমিকা। মেধাবী ছাত্রীটি বলে, ‘‘খবরের কাগজে দেখেছি চন্দ্রযান অভিযানে কী ভাবে নিজেদের দায়িত্ব সুষ্ঠু ভাবে পালন করেছেন মহিলা বিজ্ঞানীরা।” 


তারও স্বপ্ন, লাল মাটির দেশ থেকে এক দিন পাড়ি জমাবে লাল রঙের গ্রহে।

খবরের লিংক - https://www.anandabazar.com/district/purulia-birbhum-bankura/purulia-student-got-a-call-from-nasa-after-her-success-in-science-olympiad-1.1033409



৩। যে কোনও ভারতীয়র অধিকার রয়েছে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার’, রায় মাদ্রাজ হাইকোর্টের


সমাজ সংস্কারক পেরিয়ার ই ভি রামস্বামীর অনুগত এবং দ্রাবিদার কাজহাগাম-এর সদস্যদের সম্পূর্ণ মৌলিক অধিকার রয়েছে ঈশ্বর এবং ধর্মের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার। ঠিক যেমন অন্যদের অধিকার আছে ঈশ্বর বিশ্বাসে। এই রায় ঘোষণা করল মাদ্রাজ হাই কোর্ট।


মাদ্রাজ হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রায় দানের সময়ে বলে, ‘মামলাকারীর যদি অধিকার থাকে ভারতীয় সংবিধানের ১৯ ধারা অনুযায়ী ঈশ্বারের অস্তিত্ব এবং ধর্ম সম্পর্কে নিজের মত প্রকাশের, তাহলে সুপ্রিম কোর্টেক লালাই সিং যাদব মামলার উদাহরণ তুলে আমরাও বলছি পেরিয়ার ই ভি রামস্বামীর অনুগত এবং দ্রাবিদার কাজহাগাম-এর সদস্যদেরও ভারতীয় সংবিধান সম্পূর্ণ অধিকার দিয়েছে ঈশ্বরকে অস্বীকার করার। ’ডিভিশন বেঞ্চে এদিন উপস্থিত ছিলেন বিচারপতি এস মণিকুমার এবং সুব্রামোনিয়াম প্রসাদ।


১৯৬৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সমাজ সংস্কারক পেরিয়ার ই ভি রামস্বামী জীবিত থাকাকালীন ত্রিচিতে উন্মোচিত হয় তাঁর একটি মূর্তি। উদ্বোধন করেছিলেন তত্‍কালীন মুখ্যমন্ত্রী সি এন আন্নাদুরাই। উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কে কামরাজও। তাঁর সেই মূর্তির নিচে লেখা হয়েছিল, ‘ঈশ্বর বলে কেউ নেই... ঈশ্বরের কোনও অস্তিত্বই নেই। যে ঈশ্বরের জন্ম দিয়েছে সে ভীষণই বোকা। যে ঈশ্বরের প্রচার করেছে সে স্কাউনড্রেল এবং যে ঈশ্বরের আরাধনা করে সে বর্বর, আদিম।’

মামলাকারী এম দেইভানয়াগমের দাবি ছিল, এই ধরনের আক্রমণাত্বক এবং আপত্তিকর মন্তব্য পেরিয়ার কোনওদিনও করেননি এবং তাঁর মৃত্যুর পর এই সব কথা লেখা হয়েছিল মূর্তির নিচে। দ্রাবিদার কাজহাগাম-এর সভাপতি এর বিরোধিতা করে বলেন, ‘থানথাই পেরিয়ার আগে থেকেই বুঝেছিলেন, তাঁর মূর্তির নিচে এই কথাগুলি লেখা না হলে কিছু বছর পর তাঁকেই ঈশ্বর জ্ঞানে মানুষ পুজো করা শুরু করবে। সেই জন্যেই এই কথাগুলি তিনি বলে গিয়েছিলেন।’

https://eisamay.indiatimes.com/nation/madras-high-court-declares-that-indian-constitution-has-given-right-to-its-citizens-to-deny-gods-existence/articleshow/71006042.cms

বেশ্যাবৃত্তি, PITA আইন এবং.. -
অভিষেক দে
Nov. 19, 2024 | নারী | views:289 | likes:0 | share: 0 | comments:0

গত ১৮ ডিসেম্বর ২০২০ তে আনন্দবাজার পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল এ একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল। শিরোনাম : " লকডাউন যাঁদের যৌনকর্মী বানাল, সন্ধ্যা-মালতি-শ্যামলীদের কথা "। লিংক- https://www.anandabazar.com/west-bengal/many-women-working-as-sex-worker-after-loosing-their-job-in-lockdown-dgtldx-1.1244911


এই রিপোর্ট টি বানিয়েছেন জনৈক সৈকত ঘোষ। এই প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য রাখতে চাই। আশাকরছি সবাই ঠান্ডা মাথায় পড়বেন। এই রিপোর্ট টি নিয়ে কয়েকজন ব্যক্তির বক্তব্য পড়েছি বা শুনেছি। যাদের মোদ্দা কথা " বেশ্যাবৃত্তি কি অপরাধ? আরে ওরা তো গতরটা খাটিয়ে রোজগার করছে। চুরিচামারি থোড়াই করছে নাকি? পেটে ক্ষিদে থাকলে নৈতিক - অনৈতিক তত্ত্বকথা এসব মাথায় থাকেনা। তাছাড়া কেউ যদি এটাকে পেশা বানাতে চায় স্বইচ্ছায় তাহলে আপত্তির কি আছে? সিগারেটের প্যাকেটে ধূমপান ক্যান্সারের কারন মার্কা ছবি দিয়েও তো দিব্যি বিক্রি হচ্ছে তাহলে বেশ্যাবৃত্তির বেলায় এতো প্রশ্ন কেন উঠবে? "


বাহঃ, চমৎকার। এই প্রসঙ্গ মনে পরছে " thehindu " অনলাইন পোর্টাল এ ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০ তে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম ছিল - "Prostitution not a criminal offence : Bombay HC orders release of 3 sex workers "। অর্থাৎ বোম্বে হাইকোর্ট তার একটি রায়ে জানিয়েছে,

বেশ্যাবৃত্তি বা দেহ ব্যাবসা আইনত অপরাধ নয়। খবরটির লিংক-

https://www.thehindu.com/news/cities/mumbai/prostitution-not-a-criminal-offence-bombay-hc-orders-release-of-3-sex-workers/article32701646.ece


 উইকিপিডিয়া জানাচ্ছে, 

" Prostitution is the business or practice of engaging in sexual activity in exchange for payment. Prostitution is sometimes described as sexual services, commercial sex or, colloquially, hooking. It is sometimes referred to euphemistically as "the world's oldest profession" in the English-speaking world. A person who works in this field is called a prostitute and is a type of sex worker ".


১৯৫০ সালের মে মাসে নিউইয়র্ক এ আয়োজিত এক আন্তর্জাতিক কনভেনশনের স্বাক্ষরিত প্রস্তাবের ফল হিসেবে ভারতে " The Immoral Traffic (prevention) Act 1956 "  এর সূচনা হয়। এই " PITA " আইনের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় পতিতাবৃত্তি নিয়ে যা বলা আছে, তাতে একজন সাধারন মানুষের ও বুঝতে অসুবিধে হবে না যে, পতিতাব্যাবসা বা যৌনতা ব্যাবসা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বা Criminal Offence। 


আমাদের এই ভোগবাদী সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি, অনেক এনজিও আছে যারা মুখোশের আড়ালে দুর্দান্ত ভণ্ডামি করে খায়। এরা যেনতেন প্রকারে বেশ্যাবৃত্তি কে আইনত করতে বদ্ধপরিকর। এই মুখোশধারীরা এটা ভুলে যায় যে, বেশ্যাবৃত্তি ঠিকে আছে শুধুমাত্র ভোগবাদী গ্রাহকদের ওপর নির্ভর করে এবং এতে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রশ্রয় রয়েছে। 


কথাপ্রসঙ্গে একটা আলোচনায় সাংবাদিক এবং 'ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি'র সংযুক্ত সম্পাদক সন্তোষ শর্মা জানাচ্ছেন, " উত্তর প্রদেশ একটার পর একটা ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল। National Crime Record Bureau এর রিপোর্ট অনুসারে,২০১৯ সালে ভারতে প্রতিদিন ৮৭ টা ধর্ষণ ঘটেছে যার বেশিরভাগই উত্তরপ্রদেশে। এই পরিস্থিতিতে বেশ্যাগিরিকে আইনের তমকা দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চলছে। আমার কয়েকজনের মুখেও বেশ্যাবৃত্তি বা প্রস্টিটিউশনকে লাইসেন্স দেওয়ার কথা শুনেছি। তাঁদেরকে আমি কিছু কড়া কথা বলেছিলাম যেমন,  এই লকডাউনে এমন অনেকে আছেন যাঁরা কাজ হারিয়ে বাড়িয়ে বসে আছেন। বিশেষ করে মহিলারা। কোথাও কাজ খুঁজে পাচ্ছেন না?চিন্তা কেন করছেন হে পুরুষ, একবার ভেবে দেখুন আপনি বাড়িতে পায়ের ওপর পা তুলে বসে মৌজমস্তি করছেন আর অন্যদিকে আপনার স্ত্রী আপনার জন্য টাকা রোজগার করে চলেছেন। কিন্তু যদি আমাদের দেশে বেশ্যাগিরি আইনত হত তাহলে টুক করে আপনার স্ত্রীর নামে দেহবিক্রির লাইসেন্স নিয়ে ঘরেই বেশ্যালায় খুলে বসলেন। সকাল, দুপুর, সন্ধ্যা ও রাত যখন খুশি আপানার বেশ্যালয়ে গ্রাহকদের আনাগোনা। যত বেশি স্ত্রী  গতর খাটাবে তত বেশি টাকা। এই সুযোগে পাড়ার যে সব ফালতু মদমাতাল আপনার স্ত্রীকে কে দেখে লালা ঝড়াতো তারা এই সুযোগে চেখে দেখার সুবর্ণ সুযোগও পেয়ে যাবে। থানা পুলিশ, পাড়ার মাস্তানের কোনও বালাই নেই। কারণ আপনার স্ত্রী লাইসেন্স ধারি বেশ্যা যে। এখানেও শেষ নয়। হয়তো বাড়িতে অবিবাহিতা বোন রয়েছে,  টাকার অভাবে বিয়ে দিতে পারছেন না। বোনের নামেও বেশ্যাগিরির লাইসেন্স নিয়ে নিন। স্ত্রী আর বোন দুজনের ডবল রোজগারে ঘরে টাকার বন্যা বইবে। কি! আমার এই কথা শুনে প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে ? জানেন, আমারও রাগ হয়। যারা চাইছেন বেশ্যাগিরিকে আইনত করা হোক, তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, আপনি কি নিজের স্ত্রী বা বোনকে বেশ্যা বানাতে যদি চান, তাহলে এখনই স্ত্রী ও বোনকে নিয়ে পোস্টার, ব্যানার নিয়ে রাস্তায় নেমে আন্দোলন গড়ে তুলুন। কথা দিচ্ছি এই সাংবাদিক আপনাকে খবরের শীর্ষে নিয়ে  যাওয়ার জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে। 

আমি, সন্তোষ শর্মা বেশ্যাগিরিকে আইনত করার সবথেকে বড়ো বিরোধী। আমি চাই না দেশটা বেশ্যাখানায় পরিণত হোক। তাই মুক্তমনা যুক্তিবাদী বন্ধুদের কাছে একটি বিনীত  অনুরোধ, যে বা যারাই বেশ্যাগিরিকে আইনত করার দাবি তুলছে, তাদের প্রশ্ন করুন সবার আগে, তারা কি নিজের বাড়ির মা, স্ত্রী  বোনকেও বেশ্যা বানাতে রাজি আছেন কি? "


আসুন, একনজরে দেখে নেওয়া যাক কি রয়েছে PITA আইনে। এই আইনের ২ নং ধারায় পতিতালয় বা Brothel এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যে কোনও স্থান, বাড়ি, গাড়ি - সম্পূর্ণরূপে বা অংশকে বোঝাবে যেখানে বাণিজ্যিক উদ্দ্যেশ্যে, লাভের আশায় যৌনতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে, তাকেই পতিতালয় বা Brothel বলে চিহ্নিত করা হবে।

' Prostitute ' বলে সেইসব মানুষকে চিহ্নিত করা হবে, যারা বাণিজ্যিকভাবে নিজের যৌনতাকে লাভের আশায় ব্যবহার করে। পতিতাবৃত্তি বা Prostitution হল যৌনতাকে বাণিজ্যিক লাভের উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহার।

শিশু বলতে তাদের বলা হয়েছে, যাদের বয়স ১৬ বছরের কম। এই বয়সসীমার মধ্যে পতিতাবৃত্তিতে নিয়োজিতদের ' শিশুপতিতা ' হিসবে গণ্য করা হবে।

অপ্রাপ্তবয়স্ক তারাই, যাদের বয়স ১৬ বছরের ওপর কিন্তু ১৮ বছর অতিক্রম করেনি  এই বয়সসীমার মধ্যে পতিতাদের ' অপ্রাপ্তবয়স্ক পতিতা ' বলে গণ্য করা হবে। ১৮ বছর যারা পার করেছে, তারাই আইনের চোখে অপ্রাপ্তবয়স্ক।


PITA আইনের ৩ নং ধারায় পতিতালয় চালানোর বিরুদ্ধে রয়েছে শাস্তির ব্যবস্থা। কোনও ব্যক্তি যদি মালিক হিসেবে, ভাড়াটিয়া হিসেবে অথবা লিজ হোল্ডার হিসেবে কোনো পতিতালয় চালায়, তবে তার প্রথম অপরাধের জন্য এক থেকে তিন বছরের জেল এবং দু হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা হতে পারে। দ্বিতীয় বা পরবর্তী অপরাধের জন্য দুই থেকে পাঁচ বছরের জেল ও দু হাজার টাকা জরিমানা হতে পারে।


PITA আইনের ৪ নং ধারায় বলা হয়েছে - কোনও পতিতার আয়ে জীবনযাপনকারীর শাস্তি কমপক্ষে দু বছরের জেল ও সঙ্গে এক হাজার টাকা জরিমানা। এছাড়া, কোনো শিশুকে পতিতাবৃত্তিতে নামিয়ে সেই আয়ে জীবনযাপনকারীর শাস্তি কমপক্ষে সাত থেকে দশ বছরের জেল ও জরিমানা।


PITA আইনের ৫ নং ধারায় বলা হয়েছে, কোনও ব্যক্তি পতিতাবৃত্তিতে উৎসাহিত করলে বা কাওকে পতিতা হিসবে নিয়োগ করলে সেই ব্যক্তির যাবজ্জীবন জেল ও জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। 


এই আইনের ১৩ নং ধারায় পতিতাবৃত্তি নিবারণের উদ্দ্যেশ্যে বিশেষ পুলিশ অফিসার ' স্পেশাল পুলিশ অফিসার ' নিয়োগের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ১৫ নং ধারায় বলা হয়েছে বিশেষ পুলিশ অফিসার, পতিতাবৃত্তি চালানোর সন্দেহে যে কোনো স্থানে বিনা ওয়ারেন্টে প্রবেশ ও অনুসন্ধান করতে পারে।


১৬ নং ধারায় বলা হয়েছে, ম্যাজিস্ট্রেট যদি কোনওভাবে খবর পান যে, কাওকে পতিতাবৃত্তিতে নামানোর উদ্দ্যেশ্যে আটক করা হয়েছে, তবে আটক ব্যক্তিকে উদ্ধারের জন্য পুলিশকে আদেশ দিতে পারেন। ১৭(ক) ধারায় ম্যাজিস্ট্রেট উদ্ধার করা মানুষটিকে তার মা, বাবা অথবা অভিভাবকের হাতে তুলে দেবেন। তবে তার আগে অবশ্যই খোঁজ নিয়ে দেখবেন ওই মা, বাবা কিংবা অভিভাবক ওই উদ্ধার করা মানুষটির ভরণপোষণে সক্ষম কি না। ১৮ ধারামতে ম্যাজিস্ট্রেট খবর পাওয়ামাত্র পতিতাবৃত্তি চালানোর উদ্দ্যেশ্যে ব্যবহৃত যে কোনো স্থান বন্ধ করে দেওয়ার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন ।


আইনের এতগুলো ধারাগুলি ভালোভাবে পড়লে যেকেউ বুঝবেন যে পতিতাবৃত্তি বে-আইনি এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এইফাঁকে আমরা জেনে নিই পতিতাবৃত্তির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হতো বা হয়। যেমন, দেহপসারিনী, বেশ্যা, রক্ষিতা, উপপত্নী, জারিণী, পুংশ্চলী, অতীত্বরী, গণিকা, বিজর্জরা, আসুগো ইত্যাদি। আবার কামসূত্র গ্রন্থর লেখক বাৎস্যায়ন পতিতাদের ৯ টি ভাগে ভাগ করেছেন। যেমন, কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিণী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশ বিনিষ্টা, রুপজীবা, গণিকা ( সূত্র- চতুর্থ ভাগ, ষষ্ঠ অধ্যায় -২৪)। আবার ঋগ্বেদের প্রথম মন্ডলের ১২৬ তম সূক্তের পঞ্চম ঋকে রয়েছে - " সুবন্ধবে যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ শ্রব ঐযন্ত পূজা "। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ 'মরিস ভিন্টারনিৎস' এর মতে এখানে বিশ্যা শব্দটি থেকেই নাকি বেশ্যা কথাটির উৎপত্তি।  এছাড়া, George Ryley Scott তার " A history of prostitution from antiquity to the present day " বইতে পতিতাবৃত্তির সংজ্ঞা দিয়েছেন- পতিতা অর্থাৎ বেশ্যারা হলো সেই সম্প্রদায় ভুক্ত নারী যারা পুরুষকে যৌন সুখ ভোগ করাতে নিজেদের দেহ দিয়ে জীবিকা অর্জন করে। 


পরিশেষে বলাই যায় যে, বেশ্যাবৃত্তি টিকে রয়েছে শরীর লোভী গ্রাহকদের চাহিদার ওপরে। সেইসব গ্রাহক যাদের কাছে নারী শুধুমাত্র ভোগের সামগ্রী, পায়ের জুতো এবং সন্তানের জন্মদেওয়ার যন্ত্র ছাড়া অন্য কিছুই নয়। বেশ্যাবৃত্তি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিৎ সর্বতোভাবে, কোনোরকম রাখঢাক না করেই। সুস্থ সমাজে বেশ্যাবৃত্তি অভিশাপের ন্যায়। একে সমূলে উৎপাটন করতে ব্যপক প্রচার ও প্রসার করতেই হবে।


বিশেষ সংযোজন : বিগত কয়েক বছরে অ্যামিটি,প্রত্যয়, উত্তরাপথ, স্বীকৃতি ইত্যাদি নামের কয়েকটি গোষ্ঠী ' মানস বাংলা ' নামক এক সংস্থার ছত্রছায়ায় গড়ে উঠছে। এইসব গোষ্ঠীগুলোর কাজ HIV র বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলা, সমকামীদের সামাজিক স্বীকৃতির পক্ষে প্রশ্ন তোলা এবং সবচেয়ে যেটা বড় লক্ষ্য তা হলো গণিকাবৃত্তিকে আইনী করার লক্ষ্যে আন্দোলন করা ইত্যাদি। এদের ফান্ড আসে বিদেশ থেকে মোদ্দা কথায় ফান্ডেড এনজিওর আড়ালে এরা বেশ্যাবৃত্তিকে আইনত করতে বদ্ধপরিকর। ' মানস বাংলা ' র চিফ্ অ্যাকাউন্ট্যান্ট অনীশ রায়চৌধুরী তার জুলাই ২০০৯ এর হিসেব অনুযায়ী জানিয়েছিলেন এই সংস্থার ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা। ভাবা যায়!

বিবেকানন্দ ও একটি বিভ্রান্তির জবাবে -
অভিষেক দে
Nov. 18, 2024 | জীবনী | views:562 | likes:0 | share: 0 | comments:0

বছরের পর বছর ধরে একটি মিথ্যেকে এমন ভাবে প্রচার করা হয়ে আসছে যেটাকে সত্য বলে ধরেই নিয়েছে আমজনতার একাংশ। মনোবিজ্ঞানে (Psychology) " Illusory Truth Effect " বলে একটা কথা আছে। এর মানে হচ্ছে একটি মিথ্যেকে ইচ্ছেকৃত ভাবে বারংবার বিকৃত করে জনগণের কাছে উপস্থাপন করলে জনগণ সেটাকেই সত্য বলে ধরে নেয়। এছাড়া অন্ধবিশ্বাসী, হুজুগ এবং গুজবপ্রিয় জনতা কোনওদিনই সত্যকে জানতে ভালো করে পড়াশোনা এবং পড়ে যাওয়া বিষয় নিয়ে আর দশজনের সাথে আলোচনা করে ঠিক ভুলটা বেছে নেন না।

      গত ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২০ তে আনন্দবাজার পত্রিকার 'প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ এবং বিবেকানন্দ' শীর্ষক প্রবন্ধে উভয়ের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে লেখক বিধান মুখোপাধ্যায় জাপানী কবি ওকাকুরার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে লিখেছেন, "ওকাকুরা রবীন্দ্রনাথের কাছে কিছু পরামর্শ চাইলে কবি রবীন্দ্রনাথ বলেন - ভারতকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন। " If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative'."১

      তথ্যসূত্র হিসেবে বিধানবাবু স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত 'চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ' গ্রন্থের উল্লেখ করেছিলেন। এইখানেই রহস্য। 

    

       “যদি ভারতবর্ষকে জানতে চাও তাহলে বিবেকানন্দকে...” দীর্ঘবছর যাবৎ এটি রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য বলে কোটেশনটির প্রচার চলেছে। যতদূর জানা যাচ্ছে, কবিগুরুর নামে এই বক্তব্যটি প্রথমবার প্রকাশ পায় উদ্বোধন পত্রিকার ৪৩তম বর্ষের ভাদ্র ১৩৪৮ সংখ্যায়, রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর ঠিক পরে। তাতে লেখা হয়েছিল, "রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ চরিতের জন্য রোমা রোলাঁ যখন উপাদান সংগ্রহ করিতেছিলেন, সেই সময় শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ রামকৃষ্ণ সংঘের এক সন্ন্যাসীকে তাঁর ওই উক্তির কথা জানিয়েছিলেন।" উদ্বোধন পত্রিকারই আশ্বিন ১৩৯৩ সংখ্যায় স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ তাঁর একটি প্রবন্ধের পাদটীকায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনাকালে লিখেছিলেন, "স্বামী অভয়ানন্দ বলেছেন, রোলাঁ নিজেই এই তথ্য একসময় স্বামী অশোকানন্দকে জানিয়েছিলেন।" স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ অবশ্য কোনও চিঠির উল্লেখ করেননি। 

         উদ্বোধন পত্রিকার আশ্বিন ১৩৯৫ সংখ্যায় 'রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে শ্রীরামকৃষ্ণ' শীর্ষক একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। পত্রিকার ৫৮১ পৃষ্ঠার পাদটীকায় লেখক জানিয়েছেন, "শোনা যায় ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে রোলাঁর যখন প্রথম দেখা হয়, কবি তখন ঐ ফরাসী মনীষীকে বলেছিলেন : 'If you want to know India, study Vivekananda. In him there is nothing negative', everything positive.' দুঃখের বিষয় রোলাঁর ডায়রিতে উক্ত সাক্ষাৎকারের যে বিবরণ আছে সেখানে রবীন্দ্রনাথের ঐ উক্তির কোনও উল্লেখ নেই। রোমা রোলাঁ অথবা রবীন্দ্রনাথ কারও কোনও প্রকাশিত রচনায় ঐ উক্তিটি পাওয়া যায় না। এর পর লেখক ভাদ্র ১৩৪৮ এবং আশ্বিন ১৩৯৩ সংখ্যার প্রবন্ধ দুটির উল্লেখ করেছেন এবং অত্যন্ত আপশোসের সঙ্গে জানিয়েছেন, "দেখা যাচ্ছে উভয় ক্ষেত্রেই আমাদের নির্ভর করতে হয় শ্রুতি আর স্মৃতির উপর।"

        ইতিমধ্যে প্রখ্যাত রবীন্দ্র গবেষক অমিতাভ চৌধুরী ১৯৬০ সালে প্রকাশিত তাঁর 'একত্রে রবীন্দ্রনাথ' গ্রন্থের অন্তর্গত 'কবি ও সন্ন্যাসী' প্রবন্ধের ৩২০ পৃষ্ঠায় আমাদের জানালেন, "জাপানী মনীষী ওকাকুরা এসেছিলেন ভারতবর্ষকে বুঝতে, ভারতবর্ষকে জানতে। তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করে তাঁর কাছে এই বিষয়ে পরামর্শ চাইলে রবীন্দ্রনাথ বলেন, 'ভারতবর্ষকে যদি জানতে চান, বিবেকানন্দকে জানুন' ; If you want to know India, study Vivekananda. There is in him everything positive, nothing negative." মজার বিষয়, এই উদ্ধৃতির কোনও তথ্যসূত্র কিন্ত অমিতাভ বাবু দেননি, এমনকি রোলাঁ যে কী করে পালটে ওকাকুরা হয়ে গেলেন, সে হদিসও তিনি আমাদের জানাননি। এটাই বড় রহস্যের। 

        আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত যে নিবন্ধটির উল্লেখ করেছিলাম, তাতে আমরা দেখেছি লেখক ওখানেও ওকাকুরার নাম দিয়েছেন। এবার মজার কথা হল, তথ্যসূত্র হিসেবে লেখক যে বইটির উল্লেখ করেছেন, অর্থাৎ স্বামী লোকেশ্বরানন্দ সম্পাদিত 'চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ' বইয়ের বাংলা অনুবাদের ৯৭৪ পৃষ্ঠায় লেখা আছে "যদি তুমি ভারতকে জানতে চাও, বিবেকানন্দকে জানো। তাঁর মধ্যে সবকিছুই ইতিবাচক, নেতিবাচক কিছুই নেই।" এবং তথ্যসূত্র হিসেবে ৯৭৪-৯৭৫ পৃষ্ঠার ফুটনোটে উল্লিখিত আছে, "এই কথাগুলি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রোঁমা রোঁলাকে বলেছিলেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সন্ন্যাসী স্বামী অশোকানন্দকে লেখা একটি চিঠিতে রোঁমা রোঁলা এই তথ্যটি জানান। স্বামী অশোকানন্দের সূত্রে আমরা এই তথ্যটি জেনেছি।" জানিনা, আনন্দবাজার পত্রিকার উল্লিখিত প্রবন্ধের লেখক ওকাকুরার নাম কীভাবে পেলেন! মজার কথা হল, বিবেকানন্দ সম্পর্কে মিশনের সন্ন্যাসীরা এবং অসংখ্য বিবেকানন্দ বিশেষজ্ঞ রবীন্দ্রনাথের এই মন্তব্যটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু স্বামী অশোকানন্দকে লেখা রোঁমা রোঁলার ওই বিশেষ চিঠিটি আজ পর্যন্ত কেউ ছেপেছেন বলে খবর পাওয়া যায়নি। 


আরও একটি মজার কথা হল, ভারতের অভিজ্ঞতা নিয়ে রোঁমা রোঁলা একটি বই লিখেছিলেন। বইটির নাম 'ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি : ১৯১৫-১৯৪৩'। অনুবাদক অবন্তীকুমার সান্যাল। প্রকাশকাল ১৯৬০। এরও ১৪ বছর আগে ১৯৪৬ সালে অমৃতবাজার পত্রিকায় সাংবাদিক থাকাকালীন সরোজ দত্ত অনুবাদ করেন রোমা রলাঁর পত্রপ্রবন্ধ 'I will not rest' এর। নাম দেন 'শিল্পীর নবজন্ম'। উভয় বইতেই কিন্তু রবীন্দ্রনাথের ওই বহুচর্চিত বিশেষ মন্তব্যটি নেই। আমরা জানি, বিবেকানন্দের বেশ ভক্ত ছিলেন রোমা রোঁলা। ভারতবর্ষ দিনপঞ্জি বইটিতে রবীন্দ্রনাথ ও বিবেকানন্দের প্রসঙ্গ বারবার ঘুরেফিরে এসেছে। তাই অদ্ভুত লাগে রবীন্দ্রনাথের এত গুরুত্বপূর্ণ একটি মন্তব্য তিনি লিখতে ভুলে গেলেন কেন? হাইলি সাসপিসাস। 

দেখা যাচ্ছে, একই উক্তি রবীন্দ্রনাথের নামে চালানো হয়েছে অথচ পাত্র আলাদা। এমনটাও হতে পারে যে, রবীন্দ্রনাথ রোলাঁ ও ওকাকুরা দুজন বিদেশীকেই এই উপদেশ দিয়েছিলেন। ওকাকুরার ক্ষেত্রে পুরোটাই শ্রুতি হলেও রোলাঁর ক্ষেত্রে একটি তথাকথিত চিঠি বর্তমান। এখান থেকেই ভক্তির চশমাটা খুলে যদি আপনি যুক্তিসম্মত ইতিহাসচর্চা করতে বসেন তাহলে কি কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসা কি স্বাভাবিক নয়?

 যেমন-

১- উদ্বোধন পত্রিকা ও চিন্তানায়ক বিবেকানন্দ বইতে রোলাঁর নাম অথচ কবি ও সন্ন্যাসী বইতে ওকাকুরার নাম কেন? অর্থাৎ দুই ঘরাণার লেখকরা সম্পূর্ণ বিপরীত তথ্য দিয়েছেন কেন?

২- রোলাঁ সত্যিই যদি অশোকানন্দকে কোনও চিঠি লিখে রাখেন তাহলে সেই গুরুত্বপূর্ণ চিঠিটি মিশন আজ অবধি প্রকাশ করেনি কেন?

৩- রবীন্দ্রনাথের জীবিতাবস্থায় মিশন কোনওদিন রবীন্দ্রনাথের এই বক্তব্যটি তাদের পত্রিকায় ছাপেনি কেন?

৪- রবীন্দ্রনাথ আসলে কাকে কথাটা বলেছিলেন অথবা আদৌ কী বলেছিলেন?

৫- এখানেই সন্দেহ জাগে যে, পুরোটাই কি অপপ্রচার মাত্র? বিবেকানন্দকে জাস্টিফাই করতে কি একজন রবীন্দ্রনাথের মতো বড়ো নামের প্রয়োজন পড়েছিল?

       পরিশেষে জানাই, যে কোনও চরিত্র বিশ্লেষণের আগে একটা কথা মাথায় রাখতে হবে - আমরা কেউই শ্রেণীবদ্ধতা ও কালবদ্ধতার উর্ধ্বে নই। সমস্ত দোষমুক্ত মানুষের অস্তিত্ব সম্ভব নয়। প্রতিটি চরিত্রকে সামগ্রিক ভাবে বিচার করে দেখা প্রয়োজন তাঁদের দোষের পাল্লা ভারী, না গুণের। প্রিয় মুক্তমনা বন্ধুরা, রবীন্দ্রনাথের কোনও উক্তি ব্যবহার করার আগে সামান্য ভাববেন কিন্ত। যদিও এসব কারণে ওঁর মতন ব্যাক্তিত্বকে অসম্মান মোটেই জানানো উচিৎ নয়। কারণ আজ পর্যন্ত এমন প্রতিভাবান মানুষের কোনও সমকক্ষ কাউকেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

       

        কবিগুরুই বলেছিলেন - "তাঁহারাই ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান প্রকৃতির ধর্মসেতু নির্মাণ করিতেছিলেন। ভারতবর্ষ এখনই যে নিশ্চেষ্ট হইয়া আছে তাহা নহে— রামমোহন রায়, স্বামী দয়ানন্দ, কেশবচন্দ্র, রামকৃষ্ণ পরমহংস, বিবেকানন্দ, শিবনারায়ণ স্বামী ইঁহারাও অনৈক্যের মধ্যে এককে, ক্ষুদ্রতার মধ্যে ভূমাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য জীবনের সাধনাকে ভারতবর্ষের হস্তে সমর্পণ করিয়াছেন।" (এর সূত্র জানাবো না। আগ্রহী ব্যক্তিরা খুঁজে নেবেন)। 

       আবার দেখা যাচ্ছে, স্বামী বিবেকানন্দ ভগিনী নিবেদিতাকে বলেছিলেন - “মনে রেখো, ঐ পরিবারটি (ঠাকুর পরিবার) বাংলাকে যৌনতার বিষে প্লাবিত করেছে।“ সূত্র- ভগিনী নিবেদিতার পত্রাবলী, ১ম খন্ড, ১৯৬০:৮২ (ইং সংকলন)।

       স্বামী বিবেকানন্দকে সত্যিই জানতে এবং বুঝতে চাইলে দশ খন্ডের বাণী ও রচনা, পত্রাবলি, স্বামীজিকে যেরুপ দেখিয়াছি, স্বামী শিষ্য সংবাদ, জ্ঞানযোগ, রাজযোগ, বিবেকানন্দ ও বাঙালির বিবেক, 



সেকুলার বিবেকানন্দ, বিবেকানন্দ অন্য চোখে ইত্যাদি বইগুলো এবং কবিগুরুর ক্ষেত্রে বিশ্বভারতী হতে প্রকাশিত রবীন্দ্ররচনাবলী, স্বরবিতান, গীতবিতান, গীতাঞ্জলী ইত্যাদি বইগুলো বেশ ভালো ভাবে এবং পাতায় পাতায় নিজের যুক্তিবোধ দিয়ে পড়া খুবই প্রয়োজন যদি না আপনি অন্ধভক্তদের দলে পড়েন। 




কৃতজ্ঞতা স্বীকার : শিবাশীস বসু, সুনীত দে, শমীন্দ্র ঘোষ, সপ্তর্ষি রায়। 

সূত্র১- https://www.anandabazar.com/west-bengal/purulia-birbhum-bankura/friendship-between-rabindranath-tagore-and-swami-vivekananda-1.1105588

আত্মা, আধ্যাত্মবাদ এবং কয়েকটি প্রাসঙ্গিক বই নিয়ে মুক্তমনে আলোচনা -
অভিষেক দে
Nov. 18, 2024 | অলৌকিক | views:997 | likes:0 | share: 0 | comments:0

মৃত্যুতেই কি সব কিছুর শেষ? আত্মা বা Soul বলে আদৌ কি কোনো কিছুর অস্তিত্ব আছে এই বিশ্বে, নাকি সেটা নেহাৎই কল্পনা? পুনর্জন্ম অথবা জাতিস্মর কি আত্মার অস্তিত্ব কেই ইঙ্গিত করে? বিজ্ঞান কি আত্মার অস্তিত্ব কে স্বীকার করেছে? 

বহু মানুষের ধারনা মৃত্যুর পরে আরেকটি জীবন থাকে , একেই আত্মা বলা হয়। এর মধ্যে শিক্ষার সূযোগ পাওয়া না পাওয়া ব্যাক্তিরা সংখ্যাগরিষ্ঠ। পৃথিবীজুড়ে যে ৪২০০ প্রকারের ধর্ম বর্তমান,  সেখানে আত্মা নিয়ে রয়েছে নানান মতামত, রয়েছে অনেক বিভ্রান্তিও। সেখান থেকেই উঠে আসে অসংখ্য প্রশ্ন। 

শ্রীমদ্ভাগবদ গীতায় আত্মা সংক্রান্ত অনেকগুলো শ্লোক আছে। দুটি শ্লোক, উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি। ২ য় অধ্যায়ের ২২ তম শ্লোকে আছে - 

“বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়। নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি।। তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণা। ন্যন্যানি সংযাতি নবানি দেহি।। 

ঐ অধ্যায়ের ২৩ তম শ্লোকে আছে - 

নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রানি  নৈনং দহতি পাবকঃ। ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।। 

এই দুটি শ্লোকের অর্থ করলে দাঁড়ায় , “মানুষেরা যেমন ছিন্ন বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, আত্মা তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ করে নতুন শরীরে প্রবেশ করে। এই আত্মাকে কোনো অস্ত্র দ্বারা ছেদন করা যায় না, আগুন একে দগ্ধ করতে পারে না, জল দ্বারা একে সিক্ত করা যায় না, বাতাস একে শুষ্ক করতে পারেনা। ইনি কোথা থেকে আসেনি এবং কোথাও যাবে না। তিনি অজেয়, নিত্য, শাশ্বত, সর্বজ্ঞ, স্থির, অচল ও সনাতন। শরীর হত হলেও আত্মা হত হয়না "। 

আত্মার এই সংজ্ঞা কে মেনে নিলে একটা সমস্যা এসে প্রকট হয়। গীতার মতে আত্মা কে কাটা, ভেজানো, জ্বালানো ইত্যাদি নাকি যায়না। অথচ দেখুন  ব্রহ্মপুরাণ, গরুরপুরাণ, ইত্যাদিতে স্পষ্ট ভাবে উল্লেখ রয়েছে স্বর্গ- নরকের বর্ণনা। যদি আপনি হিন্দু হন এবং এই জীবনে ভালো কাজ করে যান তাহলে হিন্দু বিধান মতে আপনার আত্মা মৃত্যুর পরে যাবে স্বর্গে। সেখানে, রোগ- ব্যাধি নেই।শুধু আনন্দ হি কেবলম। কিন্তু আপনি যদি এই জীবনে সর্বদা পাপ কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন  যেমন খুন,ধর্ষণ, চুরি, ঘুষ দেওয়া- নেওয়া ইত্যাদি , তাহলে মৃত্যুর পরে আপনার আত্মার জন্য রয়েছে বিভৎস শাস্তি বা অত্যাচারের উল্লেখ গরুরপুরাণে। যেমন গরম তেলে ভাঁজা, কাঁটার ওপর দিয়ে টেনে -হিচড়ে নিয়ে যাওয়া, মুগুর দিয়ে আড়ংধোলাই,তপ্ত লৌহ শলাকা দ্বারা আঘাত, ইত্যাদি অনেক কিছুই যা আপনি কল্পনাতেও আনতে পারবেন না (একশ্রেণীর লোভী, দুর্নীতিগ্রস্ত,বেইমান, ধান্দাবাজ নেতা মন্ত্রীদের কি পরিণাম হবে ভেবেই শিউরে উঠছি)।


একদিকে গীতায় বলছে আত্মাকে কাটা যায় না, জ্বালানো যায়না এবং অন্যদিকে পুরাণে আত্মাকে জ্বলানো, কাটার নির্দেশ রয়েছে। এতো চরম স্ববিরোধীতা। জানিনা কতজন মানুষ এসব নিয়ে মুক্তমনে ভাবতে পছন্দ করেন। 


ইসলাম ধর্মেও রয়েছে বেহেশত এবং দোজখ এর বর্ণনা। খ্রিষ্টান ধর্মেও আছে হেভেন এবং হেল এর স্পষ্ট বর্ণনা। হিন্দুধর্মে আত্মাকে যেভাবে অত্যাচার করার উল্লেখ আছে, প্রায় একই কায়দায় ইসলাম এবং খ্রিষ্টান ধর্মেও রয়েছে শাস্তির উল্লেখ। এই বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আজই খোলামনে পড়ুন - গীতা, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত, উপনিষদ, মনুসংহিতা, বেদ,বাইবেল, কোরান,হাদিস ইত্যাদি সমস্ত গ্রন্থ গুলো কে যাকে আমজনতা ' ধর্মগ্রন্থ ' বলেই আখ্যা দেন। দেখবেন যা লিখছি সেসবই লেখা আছে। সঙ্গে রয়েছে প্রচুর স্ববিরোধী,বিজ্ঞানবিরোধী, ভুলেভরা, হাস্যকর কথাবার্তাও। 

আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে কথা উঠলেই একদল ব্যাক্তি প্রথমেই যে বই টির উল্লেখ করেন সেটি হল স্বামী অভেদানন্দজী মহারাজ রচিত  “মরনের পারে "। যার ইংরাজি অনুবাদ “Life Beyond Death ", প্রকাশক - শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ। বইটি বেস্টসেলার তালিকায় দীর্ঘবছর ধরে স্থান করে রয়েছে। প্রশ্ন উঠতেই পারে, অভেদানন্দজি কি তবে সব ভুল লিখেছেন, তিনি কি মিথ্যেবাদী? আপনি পারবেন এই বইটিকে ভুল প্রামাণ করতে? ইত্যাদি।

উক্ত বইটির প্রথমেই লেখা আছে “মরণের পারে (বৈজ্ঞানিক আলোচনা)। কি রকমের বৈজ্ঞানিক আলোচনা, নাকি বিজ্ঞানবিরোধী আলোচনা আসুন দেখেনেওয়া যাক। 

' মরণের পারে ' বইটি বেশ ভালো ভাবে পড়লে বোঝা যায়,স্বামী অভেদানন্দ মনে করতেন যে- 

১- চিন্তা,চেতনা, চৈতন্য কিংবা মনই হচ্ছে আত্মা। 

২- চিন্তা,চেতনা,চৈতন্য কিংবা মন আত্মারই কর্মফল।

অভেদানন্দজীর এই তত্ত্ব কে মেনে নিলে খুব মুশকিলে পড়তে হয়। কারণ আজ ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের বিজ্ঞানের পাঠ্যবই থেকে  শিখছে (যদিও পরে সেসব বেমালুম ভুলে থেকে অন্ধবিশ্বাস কেই আঁকড়ে ধরছে) যে, একজন মানুষ চিন্তা করে নিজেদের মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষ থেকেই। অর্থাৎ চিন্তা,চেতনা, চৈতন্য কিংবা মন যাই বলা যাক সেসবের উৎপত্তি মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষ থেকেই। একজন মানুষের মৃত্যু হলে হয় তাঁর দেহ হয় চিতায় জ্বালিয়ে দেওয়া হবে নয়তো মাটিতে পুঁতে দিলে পঁচে গলে সেই মাটিতেই মিশে যাবে, নয়তো বেওয়ারিশ লাশ হিসেবে পড়ে থাকলে চিল- শকুনে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলবে। এর দ্বারা এটা স্পষ্ট হয় যে, একজন মানুষের মৃত্যুর সাথে-সাথেই মস্তিষ্ক স্নায়ুকোষের ও মৃত্যু। মন কে আত্মা মানলে এটাও মানতে হচ্ছে আত্মা মরণশীল। আর আত্মা মরণশীল এটা প্রমাণিত হলে মিথ্যে হয়ে যায় ঈশ্বর, স্বর্গ- নরক,পুর্বজন্ম,আত্মা, জাতিস্মর ইত্যাদি অনেক কিছুই। 

'মরণের পারে' নামক বেস্টসেলার বই এর কিছু বৈজ্ঞানিক আলোচনা (পড়ুন বিজ্ঞানবিরোধী) র কিঞ্চিত নমুনা এখানে তুলে ধরছি, ত্রয়োদশ পুনমূর্দণ,বৈশাখ ১৩৯২ বঙ্গাব্দ থেকে।

ত্মার স্বরুপ কেমন? এই বিষয়ে স্বামীজির  (লেখার সুবিধের জন্য স্বামীজি বলতে এখানে বিবেকানন্দ কে নয়, বরং অভেদানন্দজি কে বোঝানো হলো) মত “মেঘের মত, কুয়াশার মত (ঐ বইএর ২৮ পৃষ্ঠা)। তিনি এটাও জানিয়েছেন - 

 বিজ্ঞানীরা এই কুয়াশার মত আত্মার অস্তিত্বকে স্বীকার করে নিয়েছেন, ঐ  ‘বস্তুটির নাম দিয়েছেন 'এক্টোপ্লাজম' বা সূক্ষ্ম- বহিঃসত্তা, এটি বাষ্পময় বস্তু এর কোন একটি নির্দিষ্ট আকার নেই। একে দেখতে একখণ্ড ছোট মেঘের মতো, কিন্তু যে-কোন একটি মূর্তি বা আকার নিতে পারে’।  (ঐ বইএর ২৮ - ২৯ পৃষ্ঠা) 


স্বামীজির এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, বিজ্ঞান কুয়াশার মত আত্মার অস্তিত্বকে মোটেই স্বীকার করেনি। বিজ্ঞান এক্টোপ্লাজম বলতে মেঘের মত,কুয়াশার মত কোনও বস্তুকেই নির্দেশ করেনা। এক্টোপ্লাজম 

(Ectoplasm) বলতে বিজ্ঞানীরা মানব দেহের শরীরের কোষ (Cell) এর অভ্যন্তরস্থিত সাইটোপ্লাজম (Cytoplasm) নামের একপ্রকার জেলির মতন বস্তুর বাইরের দিকের অংশকেই স্পষ্ট নির্দেশ দেয় (এই বিষয়ে আরও বিস্তারিত জানতে পড়ে দেখুন ষষ্ঠ, সপ্তম শ্রেনীর বিজ্ঞানের বই)। 


আত্মাকে দেখতে মেঘের মত,কুয়াশার মত ইত্যাদি বলেই ক্ষান্ত হননি স্বামীজি, এর সপক্ষে প্রামাণ হিসেবে একটা দারুণ উদাহরণ তুলে ধরেছেন। যারা নিজের আত্মাকে স্বচক্ষে দেখতে চান তাঁরা সামান্য খরচ করে দাঁড়িয়ে পড়ুন একটা এক্সরে মেশিনের সামনে, এবং তুলে নিন নিজ শরীরের কোনো একটা অঙ্গের ছবি। এক্সরে ফটো হাতে পাওয়ার পরে দেখতে পাবেন নিজের আত্মাকে। জানেন কিভাবে? এইখানে স্বামী অভেদানন্দজি জানাচ্ছেন - "আমার দেহের কোনো অংশ যদি এক্স-রে বা রঞ্জনরশ্মির সাহায্যে পরীক্ষা করে দেখি, দেখব- হাতের বা দেহের অংশটি কুয়াশাময় পদার্থকণায় পরিপূর্ণ,  চারিদিকে যেন তারা ঝুলছে। সুতরাং যে দেহকে আমরা জড় পদার্থ বলি আসলে সেটা জড় নয়,তা মেঘের বা কুয়াশার মতো এক পদার্থ বিশেষ"। (ঐ বই এরই ৩২ পৃষ্ঠা)।

ভাবা যায় কি মারাত্মক রকমের বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব, যা পড়া  মাত্রই অজ্ঞান হওয়ার যোগাড়। একটা অপ্রিয় সত্যি বলতে বাধ্য হচ্ছি, স্বামীজির যদি শরীর বিদ্যার স্কুলের সামান্যতম জ্ঞানটুকুও থাকতো তাহলে নিশ্চই তিনি এটা জানতেন যে, শরীরের হাড়, মাংস, পেশি ইত্যাদির ঘনত্বের ভিন্নতার জন্যই এক্সরে ছবিতে সাদা-কালো রঙের গভীরতারও বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। আর এই রঙের গভীরতার বিভিন্নতাকেই আত্মার কুয়াশারুপের প্রামাণ হিসেবে খাড়া করতে এবং আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসীদের মগজে ঢোকাতে চেয়েছেন স্বামী অভেদানন্দজি মহারাজ। 

স্বামীজি আবার আত্মার ওজন মাপার এক প্রকার যন্ত্রের কথাও উল্লেখ করেছেন 'মরণের পারে' বইএর ২৮  পৃষ্ঠায়। তিনি জানাচ্ছেন - 

"বিশেষ এক ধরনের সূক্ষ্ম যন্ত্র আবিষ্কার হয়েছে, যে বস্তুটির সাহায্যে মৃত্যুর পর দেহ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বাষ্পতুল্য আত্মা বা মনকে ওজন করা সম্ভব। দেখা গেছে আত্মার ' ওজন প্রায় অর্ধেক আউন্স বা এক আউন্সের তিনভাগ"। 

বাহ, চমৎকার তথ্য। শুনেই শিহরণ জাগছে শরীরের সর্বাঙ্গে। মজাটা হচ্ছে স্বামীজি এমন জব্বর তথ্য জানিয়েই খালাস। তিনি কিন্তু মোটেই জানাননি এমন দারুণ যন্ত্রটির নাম কি, কে, কতসালে, কোথায়, এই যন্ত্রটি আবিষ্কার করেছেন। এই বিষয়ে অভেদানন্দজির অন্ধভক্তরা কিংবা উক্ত বইটির প্রকাশক ' শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ ' যদি পথ দেখান তবে বিশেষ বাধিত হব। আত্মা কিংবা মরণের পারে গ্রন্থের পক্ষ  নিয়ে যাঁরা প্রশ্ন তুলবেন তাদেরকে অনুরোধ, দয়াকরে ভাববাদী শিবিরের ওপরে চাপ সৃষ্টি করুন যাতে তারা সর্বসমক্ষে এমন যন্ত্রটির ব্যপারে বিস্তারিত জানায়। চাপ পড়লেই দেখা যাবে যে তাদের বক্তব্য কতটা মিথ্যাচারে ভরা, কতটা বিজ্ঞানবিরোধী।

 আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে যারাই সন্দিহান তাঁদের উদ্দ্যেশ্যে ভাববাদী শিবির থেকে একটা পরীক্ষার কথা প্রায়শই উল্লেখ করা হয়। কয়েকজন বিজ্ঞানীরা নাকি একবার একজন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যাক্তিকে কাঁচের একটা বাক্সে রেখে পুরো সিল করে দিয়েছিল অক্সিজেন প্রবেশের সমস্ত পথ কে বন্ধ রেখেই। একসময় ঐ বাক্সবন্দি ব্যাক্তিটির মৃত্যু ঘটলে আচমকা নাকি কাঁচের বাক্সটি ফেটে যায়। এই কাঁচ আপনা থেকে ফেটে যাওয়াই নাকি আত্মার অস্তিত্বকে প্রামাণ করার জন্য যথেষ্ট।

এই (কু) যুক্তিটি বহু মানুষ আজও বিশ্বাস করেন। অথচ এটা পড়ার পরে অসংখ্য প্রশ্ন উঠে আসাই স্বাভাবিক যে, এই ঘটনাটা ঠিক কবে, কত সালে,কোন দেশের বিজ্ঞানীরা ঘটিয়েছে এমন অনেক কিছুই। না, স্বামীজিও কিন্ত এই ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরবতা পালন করেছেন। ভাববাদী শিবিরও কেন জানিনা নিশ্চুপ। প্রশ্নের উত্তর গুলো তোলা রইলো গুরু ভাই- বোনেদের উদ্দ্যেশ্যে  যাঁদের অনেকেই উচ্চশিক্ষিত হয়েও এমন বিজ্ঞানবিরোধী কথাবার্তায় গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন। ভাবখানা এমন যে, ' গুরু বাক্য অভ্রান্ত,তাই প্রশ্ন তোলার অর্থই হচ্ছে গুরুর প্রতি অবিশ্বাস। ছিঃ ছিঃ এতো মহাপাপ কাজ ' । যারা এই কাঁচ ফেটে আত্মা বের হওয়া তত্ত্বে প্রবল ভাবে বিশ্বাসী তাঁদের প্রতি অনুরোধ, একটা পোকা কিংবা পিঁপড়ে নিন,এবার সেটাকে জ্যান্ত অবস্থাতেই ভরে ফেলুন একটা ট্রান্সপারেন্ট কোনো কৌটো অথবা শিঁশি  তে। একসময় অক্সিজেনের অভাবে পোকা কিংবা পিঁপড়ে টি মারা যাবেই। আর আত্মার অস্তিত্ব যদি বাস্তবিকই থেকে থাকে তাহলে পিপড়ে কিংবা পোকাটির ও থাকা স্বাভাবিক। আচমকা কৌটো ফেটে গেলে বুঝবেন আত্মার অস্তিত্ব সত্যিই আছে এবং  অভেদানন্দজির আত্মা সংক্রান্ত সব লেখাই অভ্রান্ত। 

আত্মা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে স্বামী বিবেকানন্দর নাম অবধারিত উঠে আসবেই। কারণ উনিও আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। বিবেকানন্দর পূর্নাঙ্গ জীবনী দশ খন্ডের ' বানী ও রচনা ' পড়লেই সেটা বোঝা যায়, জানা যায়। যাইহোক আত্মা নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দর ধারণা অবাক করার মতোই। স্বামী বিবেকানন্দও কিন্তু অভেদানন্দজির মতো মনে করতেন - ' চিন্তা,চেতনা, চৈতন্য বা মনই হল আত্মা এবং চিন্তা, চেতনা, চৈতন্য বা মন আত্মারই কাজ- কর্মের ফল '।  মন নিয়ে বিবেকানন্দর একটা বক্তব্য তুলে ধরছি, যা কৌতুহলোদ্দিপক এবং কৌতুক-উদ্দিপক।

বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, প্রকাশক নবপত্র,পৃষ্ঠা ২৬৪ এবং “বেদান্ত কি এবং কেন?”দশম পুনর্মুদ্রণ - মাঘ ১৪০৮, পৃষ্ঠা- ৩৭ এ লেখা আছে- “মন জড়ে রুপান্তরিত হয় এবং জড়ও মনে রুপান্তরিত হয়,এটা শুধু কম্পনের তারতম্য। একটি ইস্পাতের পাত গড়ে তাকে কম্পিত করতে পারে এ রকম একটা শক্তি এতে প্রয়োগ কর। তারপর কি ঘটবে? যদি একটা অন্ধকার ঘরে এই পরীক্ষাটি করা হয়, প্রথমে তুমি শুনতে পাবে একটি শব্দ- একটি গুনগুন শব্দ। শক্তিপ্রবাহ বর্ধিত করো, দেখবে ইস্পাতের পাতটি আলোকময় হয়ে উঠছে। শক্তি আরও বাড়িয়ে দাও, ইস্পাতটি এক্কেবারে অদৃশ্য হয়ে যাবে। ইস্পাতটি মনে রুপান্তরিত হয়ে গেছে"।  

না, এরপরে মন্তব্য নিঃস্প্রয়োজন। কারন বলার ভাষা টাই যে হারিয়ে ফেলেছি ইস্পাতের দ্বারা মন তৈরির থিওরি শুনে। একটা বাস্তব সত্য হচ্ছে, কোনো কিছু জানতে, শিখতে হলে সবজান্তার ভণ্ডামি ছেড়ে আন্তরিক হতে হয়। হতে হয় মুক্তমনা এবং জিজ্ঞাসু মনের। কে কি বলে গেছেন অথবা লিখে গেছেন সেটকেই অভ্রান্ত বলে ধরে না নিয়ে নিজেই মুক্তমনে সত্যকে খুঁজে দেখা খুবই প্রয়োজন। কারণ সত্য খোঁজে মুক্তমন, হিসেব তো ভন্ডরাই কষে থাকে।

বিজ্ঞানবিরোধী কথাবার্তায় ভর্তি বেস্টসেলার বই “মরণের পারে “থেকে অসংখ্য উদাহরণ টেনে এনে বোঝানে যায় যে আত্মা নিয়ে স্বামী অভেদানন্দজি মহারাজ যা যা লিখেগেছেন নিজের বইতে সেগুলো সম্পূর্ণ উনার নিজের মনেরই কথা। যার কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। পুরোটাই গপ্পো এবং আজগুবি তথ্যের জঞ্জাল। আরেকটি চমকপ্রদ উদাহরণ দিচ্ছি "মরণের পারে”বই থেকে। কিন্তু তার আগে জানিয়ে রাখা আবশ্যক যে, আত্মার কুয়াশামার্কা রুপের সরাসরি কিন্তু বিরোধীতা করেছেন স্বামী বিবেকানন্দ। এই প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছি - বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড,নবপত্র প্রকাশন,পৃষ্ঠা  ২৫৪  থেকে। বিবেকানন্দ জানাচ্ছেন “আত্মার কোনও রুপই নেই। কোন অণু- পরমাণুর দ্বারা গঠিত নয় বলে আত্মা অবিনশ্বর... আত্মা কোনোরুপ উপাদানের সমবায়ে গঠিত নয় ।

নিন এবার কাকে ছেড়ে কার তত্ত্বে বিশ্বাস করবেন আত্মার অস্তিত্বে বিশ্বাসীরা। একজনের কথা মানলে অপরজন কে অবিশ্বাস করতেই হবে। কাকে বিশ্বাস এবং কাকে অবিশ্বাস করবেন এটা আত্মায় বিশ্বাসী জনগণের হাতেই ছেড়ে দিলাম।  

অভেদানন্দজি নিজের বই এ কয়েকটি সাদা-কালো ছবি বা ফটো তুলে ধরেছেন যা কিনা প্রামাণ করে সেগুলো আত্মার ছবি।  ‘মরণের পারে’, পৃষ্ঠা সংখ্যা ২৮ এ লেখা আছে "আত্মা যখন মরণের পর দেহ ছেড়ে যায় তখন তার ফটোগ্রাফ বা আলোকচিত্র নেওয়া যায়"। আচ্ছা কি ভাবে নেওয়া যায়? একটা সাধারন ক্যামেরাতে নিশ্চই নেওয়া যাবে। আমার কাছে কোডাক কোম্পানির রিল ভরা ক্যামেরা যেমন আছে তেমনই আমার এক আত্মীয়ের কাছে ' ডিএসএলআর ' নামক ক্যামেরাও আছে। এখন তো স্মার্টফোন বা এন্ড্রয়েড ফোনের যুগ। এই ফোনেই দিব্বি আত্মার ছবি নেওয়া যায়। গুগল ইমেজে সার্চ করলে এমন আত্মার অসংখ্য ছবি পাওয়া যাবে। সুপার ইমপোজ করা কিংবা কাঁচের রিফ্লেক্সন দ্বারাও এমন অনেক ছবি পাওয়া সম্ভব যেগুলো দেখে সয়ং অভেদানন্দজিও বিষ্ময়ে হতবাক হতেনই। কেউ চাইলে নিজেরাই চেষ্টা করে দেখতে পারেন। ' মরণের পারে ' বই তে ছাপা সেসব ছবিগুলোর চেয়ে আরও চমকপ্রদ সব ছবি তোলা যাবে যেগুলো দেখে একজন আত্মায় বিশ্বাসী (পড়ুন অন্ধবিশ্বাসী)  মানুষ হতবাক হবেই হবে। আমি স্বচক্ষে দেখে নিয়ে একটা আত্মার ছবি তুলতে চাই, কেউ যদি আন্তরিক ভাবে আমাকে এই বিষয়ে সাহায্য করেন তাহলে বিশেষ বাধিত হবো। 

কিছু মানুষ আছেন যারা লজিকের চেয়ে ম্যাজিকে বেশি বিশ্বাস করেন। অথচ তাঁরা এটাই ভুলে যান যে, মন্ত্র-তন্ত্র দ্বারা ম্যাজিক সম্ভব নয়। প্রতিটি ম্যাজিকের পেছনে থাকে একটা কৌশল, যা ছাড়া ম্যাজিক দেখানোই অসম্ভব। অভেদানন্দজির পরেই যার বই এর বিক্রি বেশ ভালো তিনি হলেন সাধনার শেষ স্তরে পৌছানো,আধ্যাত্মিক জগতের সাধু, অলৌকিক ও  অতীন্দ্রিয় শক্তির অধিকারী (এসব অবশ্য ভক্তদেরই কথা) স্বামী নিগূঢ়ানন্দজি। তিনি আত্মা, পরলোক, জাতিস্মর, প্ল্যানচেট ইত্যাদির ওপরে বেশ কয়েকটি বই লিখেছেন। সেসব বই মুক্তমনে পড়লে বোঝা যায় নিগূঢ়ানন্দজি হলেন অভেদানন্দজির ও গুরুর গুরু। হাস্যকর, বিজ্ঞানবিরোধী লেখা ছেপে তিনি বিজ্ঞানের নামাবলী গায়ে চড়িয়ে কিভাবে উদোর পিণ্ড বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে,  বিজ্ঞানের পিণ্ডি চটকে ছেড়েছেন। সেসব উদাহরণ উনার বইতেই ছাড়িয়ে রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে  “জাতিস্মর “বই এর দ্বিতীয় মুদ্রণ ১৯৯৯, প্রকাশক -নবপত্র থেকে কিঞ্চিৎ নমুনা তুলে ধরার লোভ সামলাতে পারলাম না। এই বইএর ১২ পৃষ্ঠায় লেখা আছে, টেপরেকর্ডারে পরলোকগত আত্মার কণ্ঠস্বর ধরার কথা। আছে। এটা শোনা মাত্রই আমার ফ্রেন্ড, ফিলোজফার এবং গাইড ' শ্রীমান পটলা 'র আন্তরিক ইচ্ছে নিগূঢ়ানন্দজি কিংবা উনার কোনো শিষ্যের  সাথে একটিবার দেখা করে কোনো বিদেহী আত্মার কণ্ঠস্বর দ্বারা জেনে নেওয়া কে সেই কালপ্রিট যে তার দোকানের টালি সড়িয়ে অনেক টাকার মাল পত্র চুরি করে সটকে পড়েছে। জানিনা নিগূঢ়ানন্দজি এটা শুনলে ঠিক কি করতেন। এই অতীন্দ্রিয় শক্তিধর লেখক মহাশয় তাঁর “আত্মার রহস্য সন্ধান “বইএর ৭৭-৭৮ পৃষ্ঠায়  যা লিখেছেন সেটার সংক্ষিপ্ত অর্থ হল- মানুষের দেহের লিঙ্গমূল ও গুহ্যদ্বারে নাকি এক চুম্বক ক্ষেত্র আছে। যোগ সাধনার বিশেষ শ্বাস -প্রশ্বাস নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সেটাকে নিজের আয়ত্ত্বে আনতে পারলেই কেল্লাফতে। মাথা নাকি ব্লাডারের মত ফুলে গিয়ে যেকেউ মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব কে তুড়িমেরে শূন্যে ভেসে থাকতে পারে। 

আমার একান্ত ইচ্ছে এমন একজন সাচ্চা, নিখুঁত সাধুমহারাজ কিংবা  যোগগুরু এগিয়ে আসুন, এবং থিওরি ছেড়ে প্র‍্যাক্টিক্যালি কোনো কৌশল ছাড়াই শূন্যে ভেসে দেখান দয়াকরে (বাবা রামদেব চাইলে এগিয়ে আসতেই পারেন। উনাকে মন খুলে স্বাগতম জানাচ্ছি)। "আত্মার রহস্য সন্ধান”বই এর ১১১ পৃষ্ঠায় নিগূঢ়ানন্দজি জানিয়েছেন উনার কাছে যোগ শিখছেন এমন অনেকেই নাকি ' সূক্ষ্ম দেহে ভিন্ন ব্যাক্তি বা স্থান দর্শনের বর্ণনাও তাঁরা দিতে পারেন। লেখকের ব্যাক্তিগত এমন অভিজ্ঞতা আছে "। এই গ্রন্থের  ১২৩ পৃষ্ঠায় স্বামী নিগূঢ়ানন্দজি জানিয়েছেন, "আত্মার পক্ষে পার্থিব সূক্ষ্ম- স্তরগুলোর অভিকর্ষ এড়িয়ে ভিন্ন গ্রহে উপস্থিত হওয়া অসম্ভব কিছু নয়"। স্বামীজি ঐ পৃষ্ঠাতে আরও জানিয়েছেন "লেখক ভিন্নগ্রহে বিভিন্ন মাত্রায় জীব দর্শন করতে সক্ষম হয়েছেন"। মহাকাশ গবেষণার জন্য প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার,ইউরো,পাউন্ড খরচ না করে, গ্যালাক্সিতে প্রাণের অস্তিত্বের খোঁজে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মনেহয় স্বামী নিগূঢ়ানন্দজির সাহায্য নিলেই ভালো হবে। সময় এবং অর্থ দুইই বেঁচে যাবে আর আমরাও বিশ্ববাসী জানতে পারবো মহাবিশ্বের কোথায় কোথায় প্রাণের অস্তিত্ব আছে।

নিগূঢ়ানন্দজির মারাত্মক সব জ্ঞানের নজির উনার বইএর ছত্রেছত্রে সাজানো। যেমন তিনি 'জাতিস্মর' গ্রন্থের ৮৫  পৃষ্ঠাতে  লিখেছেন “পি.সি.সরকার সকলের ঘড়ির কাঁটার সময় কমিয়ে দিতে পারেন কী করে? এ-বিষয়ে তাঁকেই জিজ্ঞাস্য।অধিমনোবিজ্ঞানে একে বলে সম্মোহন বা Pk (Psycho Kinesis)"। সত্যি মানতেই হচ্ছে নিগূঢ়ানন্দজির জ্ঞানের বড়োই অভাব। যার এত জ্ঞান, এত অলৌকিক, অতীন্দ্রিয় ক্ষমতা, যিনি বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্তকিছুর খবরাখবর জেনে ফেলেছেন তিনি পি.সি.সরকারের ঘড়ির কাঁটার সময় পিছিয়ে দেওয়ার আষাঢ়ে গল্প কে সত্যি বলে আঁকড়ে ধরে বসে আছেন। কারন ঘড়ির কাঁটা পিছিয়ে দেওয়া শুধুমাত্র গল্পতেই সম্ভব, বাস্তবে কেউই এমন কোনো দিন ঘটায়নি এবং ঘটাতেও পারবেন না। চ্যালেঞ্জ রইলো। আর Pk বা Psycho Kinesis হচ্ছে আরেকটা বিজ্ঞানবিরোধী থিওরি। বিজ্ঞানের মুখোশের আড়ালে থাকা প্যারাসাইকোলজিস্ট রা যতই সিক্সথ সেন্স, সাইকো কাইনেসিস, দে'জা ভূ, ই.এস.পি.র গপ্পো বাজারে ছড়ুক না কেন সেসব কোনোদিনই বিজ্ঞানের দরবারে প্রমাণিত হবেনা। 

না, এর বেশী লেখা মানেই স্বামী নিগূঢ়ানন্দজি কে তোল্লাই দেওয়া। সত্য জানতে প্রিয় পাঠক বন্ধুরাই প্রয়োজনীয় বই পত্র গুলো পড়ে নিয়ে নিজের যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে বিচার করে দেখুন। নিজেই বুঝবেন ' কুছ তো গড়বড় হ্যায় দয়া'।

আত্মা নিয়ে আলোচনা শুরু করলেই  আধ্যাত্মবাদের কথা উঠে আসবে। অভিধান জানাচ্ছে আত্মা সংক্রান্ত কিংবা আত্মা সম্বন্ধীয় মতবাদ ই হলো - আধ্যাত্মবাদ কিংবা অধ্যাত্মবাদ। এমন অনেকেই আছেন যারা অবশ্যই উচ্চশিক্ষিত এবং হয়তো বিজ্ঞানের কোনো শাখায় পড়াশোনাও করেছেন। সেইসব মানুষের ভেতর অনেকেই অন্ধবিশ্বাস এবং আজন্মলালিত বিশ্বাস কে আঁকড়ে ধরে আছেন আজও। এমন কথা অনেকেই বলে থাকেন যে 'ধর্মের সাথে কিংবা আধ্যাত্মবাদের সাথে বিজ্ঞানের কোনো দন্দ নেই'। 

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিজ্ঞান কি আদৌ ঈশ্বর,অলৌকিক, অতীন্দ্রিয় আত্মা কিংবা  আধ্যাত্মবাদ কে সত্যিই মেনে নিয়েছে? এর এককথায় উত্তর হচ্ছে না, না এবং না। কারন,বিজ্ঞানের দরবারে কোনো কিছু তখনই প্রতিষ্ঠিত হয় যখন সেটা বিজ্ঞানের  - পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ এবং সিদ্ধান্ত এই তিন সহজ - সরল ধাপে উপনিত হয় বা সাফল্য (পাশ) লাভ করে। এমনটা আগেও হয়েছে কল্পিত প্রস্তাবনা বা হাইপোথিসিস। অর্থাৎ কোনো ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে যদি মনে হয় (সন্দেহ জনক কিছু রয়েছে) গবেষণা চালানো প্রয়োজন, তাকেই বলা হয় ' হাইপোথিসিস'। এখান থেকেই বিজ্ঞানের ঘরে প্রবেশ করার পক্রিয়া শুরু হয়। 

ঈশ্বর, আধ্যাত্মবাদ, অলৌকিক ইত্যাদি এখনও পর্যন্ত হাইপোথিসিস এ পা টাই রাখতে পারেনি, বাকি তিন ধাপ তো অনেক দুরের কথা। এখনও পর্যন্ত এমন কিছু ঘটনা ঘটেনি যা ইঙ্গিত করে ঈশ্বর,অলৌকিক অথবা  আধ্যাত্মবাদ কে। এখনও সেই রকম কিছু ঘটেনি যার জন্য বিজ্ঞান পরীক্ষা এবং পর্যবেক্ষণ চালিয়ে দেখবে,তারপর আসবে একটা সিদ্ধান্তে। ঈশ্বর, অলৌকিক কিংবা আধ্যাত্মবাদের কোনো কার্যপ্রলাপ এখনও পর্যন্ত বিজ্ঞান কে প্রভাবিত করতেই পারেনি। তাই বিজ্ঞান আজও মাথা ঘামায়নি যে ঈশ্বর, অলৌকিক, অতীন্দ্রিয়,  আত্মার অস্তিত্ব আদৌ আছে, নাকি নেই। ঈশ্বর, আত্মা ইত্যাদি সবটাই শুধুমাত্র মনোজগৎ এর কল্পনা ছাড়া অন্য কিছুই নয়। 

একদল ধর্মগুরু অথবা বিজ্ঞানী কিংবা নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ব্যাক্তিরা (বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করলেই কিন্ত বিজ্ঞানমনষ্ক,যুক্তিবাদী হওয়া যায়না। যুক্তিবাদী সাজা যায় কিন্ত হওয়া যায় না কারণ, এটা একটা হয়ে ওঠার ব্যাপার। যেটা সবাই পারে না। এর জন্য প্রয়োজন আন্তরিকতা এবং জিজ্ঞাসু মন) যতই প্রচার করুক, যতই তত্ত্বকথা শোনাক না কেন “বিজ্ঞান ঈশ্বর, অলৌকিক, আত্মার অস্তিত্ব কে স্বীকার করে নিয়েছে “তবুও কোনোদিনই এটা প্রমাণিত হবে না বিজ্ঞানের দরবারে। 

প্রাচীন ভারতীয় দর্শন যে মূলত নিরীশ্বরবাদী দর্শন ছিলো সেটাই হয়তো জানেন না আমজনতার একাংশ। বুদ্ধ, চার্বাক, মিমাংসা, মাধ্যমিক, জৈন ইত্যাদি নিরীশ্বরবাদী দর্শন। আমজনতা কে মিথ্যের জালে ভুলিয়ে রাখার প্রয়াস চলছে,চলবে। আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বহুদিন আগেই সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলে কিংবা আক্রমণ করেছিল বুদ্ধ এবং চার্বাক দর্শন। এছাড়া দে'জ পাবিলিশিং থেকে প্রকাশিত, প্রবীর ঘোষ এর লেখা “অলৌকিক নয়, লৌকিক “৪র্থ খণ্ডেও আত্মা, আধ্যাত্মবাদ এবং জাতিস্মরের স্ববিরোধীতা, বুজরুকি এবং ভণ্ডামো উপযুক্ত তথ্যসহ তুলে ধরা আছে। চাইলে কেউ পড়ে দেখতেই পারেন। 

গৌতম বুদ্ধ ছিলেন আক্ষরিক অর্থেই একজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী, বস্তুবাদী এবং অবশ্যই নিরীশ্বরবাদী মানুষ। তাঁর মুল চারটি সিদ্ধান্ত জানলেই সেটা পরিষ্কার হয়ে যায়। বুদ্ধের মূল চারটি সিদ্ধান্ত হচ্ছে - (১) ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার না করা, (২) আত্মাকে ' নিত্য ' স্বীকার না করা, (৩) কোনও গ্রন্থ কে স্বতঃ প্রামাণ স্বীকার না করা, (৪) জীবন প্রবাহ কে স্বীকার করা। গৌতম বুদ্ধর মৃত্যুর পরে বৌদ্ধ ধর্ম দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। একটি হীনজান এবং অপরটি মহাজান। দুঃখ এটাই, যে বুদ্ধ ছিলেন সম্পূর্ণরুপে নিরীশ্বরবাদী সেই বুদ্ধ কে আজ ঈশ্বর বানিয়ে বিষ্ণুর অবতার রুপে পূজো করা হচ্ছে। সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকা পড়লেই সেটা লক্ষ্য করা যায়,কারণ বুদ্ধ কে ঈশ্বর বনিয়ে, নানা অলৌকিক ব্যাপারে উনাকে জড়িয়ে ক্রমাগত প্রচারের কাজটা এই পত্রিকা করেচলেছে। বুদ্ধ মনে করতেন -”চিত্ত বিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান আর আত্মা একই বস্তু"।  তিনি এটাও জানালেন “আত্মা বা চিত্ত বিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞান যেহেতু শরীরেরই ধর্ম (এখানে ধর্ম অর্থে গুণ কেই বুঝিয়েছেন বুদ্ধ। যেমন আগুনের ধর্ম বা গুণ হচ্ছে দহন না জ্বলন) তাই শরীর বিনাশের সাথে সাথেই আত্মার ও বিনাশ ঘটে। দার্শনিক জগদীশ্বর সান্যাল তাঁর ' ভারতীয় দর্শন ' গ্রন্থে লিখেছেন - বুদ্ধদেব বলেছিলেন, জন্মান্তর বলতে চিরন্তন আত্মার নতুন দেহ ধারণ করা বোঝায় না। জন্মান্তর অর্থে একটি জীবন থেকে আর একটি জীবনের উদ্ভব বোঝায়। গৌতম বুদ্ধের মতে নির্বাণ মানে দুঃখের বিনাশ কেই বোঝায়। এই নির্বাণ লাভ করেই সিদ্ধার্থ গৌতম ' বুদ্ধ ' হয়েছিলেন। যারা গৌতম বুদ্ধের পূর্ণাঙ্গ জীবনী না পড়েই কিংবা বিকৃত জীবনী পড়েই চেঁচায় তাদের বোঝানো বেজায় মুশকিল। বুদ্ধকে বিকৃত করার খেলায় সামিল মনুবাদীদের একাংশ থেকে দার্শনিক বা চিন্তাবিদ ছাপ দেওয়া ব্যাক্তিরা। ওরা জানে এক এবং জানায় আরেক। একে ভণ্ডামি ছাড়া আর কিইবা বলা যায়। মনুবাদীদের বা ব্রাহ্মণবাদীদের দ্বারা শুদ্র বা দলিত মানুষের অত্যাচার চলেছে বহুযুগ ধরে, এই ধারা আজও অব্যাহত। শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যাক সংবিধানের প্রণেতা বাবা সাহেব আম্বেদকর এর। উনি শুদ্রদেরকে সমাজে তাঁদের প্রাপ্য মর্যাদা দেওয়ার জন্য এবং কট্টরপন্থী হিন্ধুত্ববাদীদের হাত থেকে হিন্দুধর্ম কে সরিয়ে আনতে এবং মানবিক গড়ে তুলতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অনড়,স্থবির হিন্ধুধর্ম নিজের স্থানে অটল থাকার কারণে ব্যার্থ হয়ে আম্বেদকর, ১৪ অক্টোবর ১৯৫৬ সালে নাগপুরে ৫ লক্ষ নিম্নবর্গীয় বা দলিতকে সঙ্গে নিয়ে হিন্দু উপাসনাধর্ম ত্যাগ করন এবং জাত-পাত হীন বৌদ্ধ ধর্মকে গ্রহণ করেন। 

'চার্বাক দর্শন' বস্তুবাদী দর্শন। এই দর্শন- ঈশ্বর, আত্মা, পরলোক, স্বর্গ- নরক, জন্মান্তর ইত্যাদি কে যুক্তির শানিত অস্ত্রের আঘাতে কেটে টুকরো টুকরো করে ছেড়েছিল। তাই ভাববাদী দর্শনপন্থীরা সজত্নে এড়িয়ে চলতেন চার্বাক দর্শন কে। এই কারণেই হয়তো চার্বাক কে লোকায়ত দর্শন আখ্যা দিয়েছিল সেযুগের ভাববাদী শিবিরের তাত্ত্বিক নেতা থেকে ম্যাক্সমুলার বা শঙ্করাচার্য প্রমুখরা। এই বস্তুবাদী বা লোকায়ত দর্শনে ' আত্মা বা চেতনা বা চৈতন্যকে দেহধর্ম ব্যাতিত অন্য কিছুই মনে করেনা। এই বস্তুবাদী দর্শন থেকে সামান্য কিছু নির্যাস তুলে ধরছি, মুল সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করে। যেমন- - 

(১) চৈতন্য রুপে আত্মার পাকযন্ত্র কোথা? তবে তো পিণ্ডদান নেহাতই বৃথা। 

(২) ব্রাহ্মণ জীবিকা হেতু তৈরি শ্রাদ্ধাদি বিহিত। এছাড়া  কিছুই নয় জেনো গো নিশ্চিত।।

(৩) যদি, শ্রাদ্ধকর্ম হয় মৃতের তৃপ্তির কারণ। তবে, নেভা প্রদীপে দিলে তেল উচিৎ জ্বলন।।

শেষে একটা অপ্রিয় সত্য বলতে বাধ্য হচ্ছি। স্বামী অভেদানন্দ থেকে স্বামী নিগূঢ়ানন্দ'র মতন অনেকেই আত্মার অস্তিত্ব নিয়ে বই-পত্র লিখেছেন। স্বামী অভেদানন্দ কিংবা স্বামী নিগূঢ়ানন্দ আজ আমাদের ভেতর নেই। বহুদিন আগেই উনারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। একটা প্রশ্ন জেগেছে এইমূহুর্তে, এই দুজন বিখ্যাত স্বামীজির উচিৎ ছিল মৃত্যুর পরে যদি একটা জীবন  থেকেই থাকে তাহলে সেটা জানানোর জন্য নিজেরাই  বিদেহী আত্মা রুপে মর্তে এসে জানান দেওয়া। কিন্ত আজ পর্যন্ত ওনারা আত্মা রুপে মর্তে এসে কোনো রকমের প্রামাণ দেননি। দেননি ওপরে ঈশ্বর নামক কেউ সত্যিই আছে কিনা, তার স্বরুপ কি, নিরাকার নাকি সাকার ইত্যাদির "প্ল্যানচেটে আত্মাকে আনা সম্ভব”এই তত্ত্বে বিশ্বাসীরা,পরামনোবিজ্ঞানী, ভুত - প্রেতাত্মা গবেষক বা অনুসন্ধানকারীরা চেষ্টা করে একবার দেখতে পারেন, যদি অভেদানন্দজি কিংবা নিগূঢ়ানন্দজির বিদেহী আত্মাকে টেনে আনা সম্ভব হয়। তাহলে বিশ্বের তাবড় যুক্তিবাদী, ঈশ্বর এবং আত্মার অস্তিত্বে অবিশ্বাসী মানুষের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে প্রতিষ্ঠা করা যাবে আধ্যাত্মবাদ কে এবং আত্মা বলে বাস্তবিকই কিছু আছে সেটাও প্রামাণ হয়ে যাবে এই ফাঁকে।  

পরিশেষে একটা মজার ঘটনা জানাই। মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষের ক্রমাগত যুক্তির আঘাতে পেরে উঠতে না পেরে, স্বামী অভেদানন্দজি রচিত ‘মরণের পারে’ গ্রন্থের  আত্মা সংক্রান্ত অনেক আজগুবি, বিজ্ঞানবিরোধী তথ্য বা বক্তব্যে কে ছেঁটে ফেলে বর্তমানে বইটি প্রকাশ করছেন 'শ্রীরামকৃষ্ণ বেদান্ত মঠ'। হাতে গরম প্রমাণ পেতে উক্ত বইটি পড়ে মিলিয়ে দেখে নিতেই পারেন কেউ। এটা নিঃসন্দেহে বড় জয় যুক্তিবাদী মানুষের। জয় যুক্তিবাদ। 


ঋণ স্বীকার : প্রবীর ঘোষ, শিবাশীষ বসু, রামকৃষ্ণ মন্ডল, উইকিপিডিয়া, কিছু প্রয়োজনীয় পত্র-পত্রিকা।

ভর। মানসিক রোগ, নাকি ভড়ং? -
অভিষেক দে
Nov. 18, 2024 | অলৌকিক | views:486 | likes:0 | share: 0 | comments:0

১৩ জুন ২০০২, স্থান : বীরভূম জেলার নলহাটি। একজন চল্লিশোর্ধ মহিলা আচমকাই উন্মত্তের মতন আচরণ করেছিলেন। হাতের কাছে যা পাচ্ছেন তাই ছুঁড়ে দিচ্ছেন। উপস্থিত জনতার সামনে কখনও নাকিসুরে কাঁদছিলেন তো কখনওবা পুরুষ কন্ঠের ন্যায় আবোলতাবোল বকেছিলেন। বিশ্বাসীদের দাবী এই মহিলাকে ভূতে বা জ্বীনে পেয়েছে বা ধরেছে।  অপরপক্ষের দাবী ইনি  মানসিক রোগী নয়তো শুধুই অভিনয় করছেন অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। শোনা গেছে এর পরে একজন ওঝা এসে নিজের কেরামতি দেখানোর পরেও সমস্যা না মেটায় মহিলার দূর সম্পর্কের একজন আত্মীয় ওনাকে কলকাতার পাভলব মানসিক চিকিৎসাকেন্দ্রে নিয়ে যান এবং ওখানেই উনি সুস্থ হয়ে বাড়ি ফেরেন। 

এই ধরনের ঘটনা, হয়তো অনেকেই দেখেছেন নিজের জীবনে। দেখেছেন এর চেয়েও বেশি কিছু। যেমন ধরুন, কোনো ভূতে(!) ধরা কিংবা ভূতের ভরে পরা মহিলার উন্মত্ত আচরণ,জ্বলন্ত কয়লাকে হাতে তুলে নেওয়া, জলভর্তি কলসি দাঁতে তুলে লাফ দেওয়া ইত্যাদি বেশ কিছু। যেহেতু সেইসব অদ্ভুতুড়ে ঘটনা দেখে আপনার মনে হয়েছে এর ব্যাখ্যা আপনার কাছে নেই তাই নিশ্চই এটা অলৌকিক কিংবা ভূতুড়ে ব্যাপার স্যাপার। অথচ প্রতিটি ঘটনার পেছনেই থাকে একটা কার্যকারন সম্পর্ক। কারন। এই পৃথিবীতে "অলৌকিক “নামক কোনো কিছুরই অস্তিত্ব নেই। সমস্ত তথাকথিত অলৌকিক, অদ্ভুতুড়ে ঘটনার পেছনে রয়েছে একটা “লৌকিক “বা বিজ্ঞানসম্মত কারণ। এই লৌকিক কারণ টাই অনেকের জানা না থাকায় বিষয় গুলো ভৌতিক, অলৌকিক ইত্যাদি ঠেকে। তাছাড়া এটাও সত্যি, অনেকেই অলৌকিক কিছুতে প্রবল ভাবে বিশ্বাসী, সেই কারণে তাঁরা সবতেই দেবত্ব,অলৌকিক, ভৌতিক ইত্যাদির ধরে নেন। 

মনোবিজ্ঞান মতে এইসব ভূতের (!) ভরে পরা মহিলারা একপ্রকার মানসিক রোগ (Neurotic Disorder) এ আক্রান্ত। মনোবিজ্ঞান এমন ঘটনাকে প্রধানত তিনটে ভাগে ভাগ করেছে। যেমন - 

(১) Hysteria (হিস্টিরিয়া)। এরও আবার দুটিভাগ আছে। Dissociative Hysteria এবং Convertion Hysteria.

(২) Maniac Depressive (ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ)।

(৩) Schizophrenia (সিজোফ্রেনিয়া বা স্কিটসোফ্রেনিয়া)।

 হিস্টিরিয়া  কথাটির উৎপত্তি গ্রীকশব্দ 'Hysteron  থেকে, যার অর্থ জরায়ু। প্রাচীনকালে গ্রীসদেশের মানুষের ধারণা ছিলো জরায়ু খেপে গেলে হিস্টিরিয়া হয়। অথচ এই ধারনাটাই মিথ্যে। যেহেতু মহিলারাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হন, তাই মনে করা হত যে জরায়ুর গোলমালের কারণেই এই রোগের সৃষ্টি। পরে প্রমাণিত হয়েছে, পুরুষেরাও এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত নন। 

সাধারণত দুর্বল মস্তিষ্কের ব্যাক্তিরা অর্থাৎ যাদের মস্তিষ্কের গতিময়তা কম, অল্পেতেই ভেঙ্গে পড়েন, আবেগপ্রবণ, অন্ধবিশ্বাসী, কুসংস্কারাচ্ছন্ন শিক্ষার সূযোগ সেভাবে না পাওয়া ব্যাক্তিরাই ভূতের (!) ভরে আক্রান্ত হন।

জল ভরা কলসি দাঁতে করে তোলা, লজ্জা ভুলে প্রচণ্ড লাফ দেওয়া কিংবা কোনও গাছের শক্ত ডাল ভেঙ্গে ফেলা হিস্টিরিয়া রোগীর পক্ষে অত্যন্ত স্বাভাবিক ঘটনা। সাধারণভাবে এই ধরনের মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুকোষের সহনশীলতা কম তারা একনাগাড়ে একই কথা শুনলে মস্তিষ্কের কিছু কোষ বারবার উত্তেজিত হয়ে থাকে। ফলে এর পরে অনেক সময় উত্তেজিত কোষগুলি অকেজো হয়ে পড়ে অন্য কোষের সঙ্গে যোগাযোগ হারিয়ে ফেলে। মস্তিষ্কের কার্যকলাপে ব্যাঘাত ঘটে। এই রোগে আক্রান্তরা গভীর ভাবে বিশ্বাস করেন তাঁদেরকে কোনো ভূতে বা জ্বীনে ধরেছে কিংবা ভর করেছে। আপাতদৃষ্টি তে এইধরনের অদ্ভুত আচরণ যতই অস্বাভাবিক লাগুক না কেন, আক্রান্ত ব্যাক্তিরা কিছুসময়ের জন্য নিজেকে হারিয়ে শরীরের চুড়ান্ত সহ্য শক্তিকে ব্যাবহার করেন, যেটা স্বাভাবিক অবস্থায় তাদের পক্ষে অসাধ্য বা অসম্ভব। আসলে হিস্টিরিয়া, ম্যানিয়াক ডিপ্রেসিভ, স্কিটসোফ্রেনিয়া ইত্যাদি রোগীদের রোগ সম্বন্ধে আমজনতার ভালো ভাবে জানা না থাকায় রোগীদের কাজকর্ম এবং নানান আচরণ আমজনতার কাছে ভূতুড়ে কাণ্ডকারখানা হিসেবেই গ্রহণযোগ্যতা পায়।

গ্রিক চিকিৎসক হিপোক্রেটিস (খ্রীষ্টপূর্ব ৪৬০- ৩৭৭) ই প্রথম বলেন, মানসিক রোগ আর পাঁচটা রোগের মতই একটা রোগ। এর সঙ্গে ভূত বা অশুভ শক্তির কোনও সম্পর্ক নেই। মস্তিষ্কের বিকারের ফলেই নানান মানসিক রোগ সৃষ্টি হয়। প্রাচীনকালে এইধরনের ভরে পরা মানুষের সাথে চরম অমানবিক অত্যাচার করা হত। যার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। ১৪৮৬ সালে খ্রীষ্টান ধর্মের পোপের নির্দেশ মত একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয় “The Witche's Hammer "..গ্রন্থটিতে মানসিক রোগীদের 'ডাইনি ' ঘোষণা করা হয়েছিল। তাই আজও কোনো মহিলাকে ডাইনি বা ডায়েন চিহ্নিত করে অত্যাচারের ঘটনা প্রায়শই খবরের কাগজে স্থান পায়। এই প্রসঙ্গে একটা তথ্য জানানো উচিৎ হবে বলে মনে করি।

রাঁচির মান্দার ব্লকের কাঞ্জিয়া মারাইটোলি গ্রাম। এই গ্রামেই গত ৭ই অগাস্ট, ২০১৫ তে পাঁচ মহিলা কে পিটিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে একদল উন্মত্ত গ্রামবাসী (তথ্যসূত্র : ABP, 23rd August 2015)। 

সেই পাঁচ জন মহিলার অপরাধ, তারা নাকি “ডাইনি"। এখানে কেউ ডাইনি নিয়ে সন্দেহ করেনা, একদম গভীর বিশ্বাস করে। 

২০১৪ সালে এই মারাইটোলি গ্রামের পাশেই একজন মহিলকে ডাইনি ঘোষণা করে হত্যা করার পরে গ্রামের ওঝার নিদান মত সাইকেলের হ্যান্ডেলে উক্ত মহিলার কাটা মাথা নিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হয়। পুলিশ প্রশাসন কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করেই। 

পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ র অগাস্ট পর্যন্ত ডাইনি সন্দেহে কিংবা বিশ্বাসে ১২৪ জন মহিলা দের নির্মম ভাবে হত্যা হয়েছে।

ফিরি "ভর”নিয়ে। শুধুমাত্র কাল্পনিক অপদেবতা, ভূতপ্রেত, জ্বীন, আত্মা ইত্যাদিরই ভর নয়, কাল্পনিক ঈশ্বরের ভরের ঘটনাও প্রায়শই শোনা যায়। মূলত, কালী, দুর্গা, মহাদেব, শীতলা, ওলাবিবি, পাঁচুবাবা, পীর, বনবিবি, সন্তোষী, মনসা, সাঁঝলি মাঈ ইত্যদিদেরই ভরের ঘটনা শোনা যায়। এর ব্যাখ্যাও একই। কখনও মানসিক রোগ আবার কখনওবা শুধুই অভিনয়, ভর এদের কাছে ভড়ং, শুধু কিছু কামানোর চেষ্টায়। 

যুক্তিবাদী, বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীরা এমন কয়েকশো ভরের ঘটনার সরেজমিন তদন্ত করে দেখে স্পষ্ট বুঝেছেন শতকরা ৯০% ক্ষেত্রে এই ভর শুধুই ভড়ং। বাকিদের ক্ষেত্রে বিভিন্ন  মানসিক রোগ থেকেই এই ভরের সৃষ্টি। মনোরোগ চিকিৎসক দের দাবী আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়, যেমন - চোখ, কান,নাক,জিভ, ত্বক ইত্যাদি আমাদের অনেক সময় প্রতারিত করে। মনে করুন মরুভূমির কথা, প্রখর রোদে উত্তপ্ত বালি কে দেখে অনেকেই জল ভেবে ছুটে যান, যাকে আমরা মরিচিকা বলি। আবার নাম সংকীর্তন  আসরে অনেকেই ভাবাবেগে ডুবে গিয়ে চেতনা হারিয়ে অদ্ভুত আচরণ করে বসেন। কেউ আবার অলীক কিছু দেখার, শোনার দাবী করেন। এর কারণ হচ্ছে- 

(১)  Illusion (ভ্রান্ত অনুভূতি), এরও পাঁচটি ভাগ আছে যেমন, Optical Illusion/Visual Illusion (দর্শানুভূতির ভ্রম), (খ) Auditory Illusion (শ্রবণাভূতির ভ্রম), Talctile Illusion(স্পর্শানুভূতির ভ্রম), Olfactory Illusion (ঘ্রাণানুভূতির ভ্রম) এবং Taste Illusion (জিহ্বানুভূতির ভ্রম)।

(২) Hallucination(অলীক বিশ্বাস) (৩) Paranoia (বদ্ধমূল ভ্রান্তিজনিত মস্তিষ্ক বিকৃতি) (৪) Delusion (মোহ / অন্ধ ভ্রান্ত ধারণা)।

একুশ শতকে বিজ্ঞানের গতি দুর্বার। এই মহাবিশ্বের অনেক অজানা রহস্যের সমাধান বিজ্ঞান করে ফেলেছে। আগামীদিনে আরও অনেক রহস্যভেদ হবে। তবে এটাও সত্যি বিজ্ঞান এখনও পর্যন্ত মানব মস্তিষ্কের অনেক অদ্ভুত কার্যকলাপের রহস্যভেদ করে উঠতে সেভাবে পারেনি। তবে নিরন্তর গবেষণা চলছে পৃথিবীজুড়ে। আগামীদিনে সেই সব রহস্যেরও সমাধান হয়ে যাবে দ্রুত। 

এতটা লেখার মাধ্যমে আশাকরি এটা বোঝাতে সক্ষম হয়েছি, যাকে আমজনতা ভূতে বা জ্বীনে কিংবা ঈশ্বরের ভর বলে মনে করেন সেটা আসলেই একপ্রকার মনের বিকার কিংবা মানসিক রোগের ই কারণ। আবার কখনও দেখা যাচ্ছে বেশ কয়েকজন প্রতারক ভরের ভড়ংবাজী করেন টু পাইস রোজগারের ধান্দায়। 

ভর নিয়ে কিছু লিখতে গেলে দুটো প্রশ্ন উঠে আসা স্বাভাবিক। যেমন, ভরে পরা অনেকেই আশীর্বাদী ফুল, জলপড়া, তেলপড়া দেন, তাতে সুস্থও হয়ে ওঠেন অনেকে। ভর যদি মানসিক রোগ কিংবা প্রতারণাই হবে তাহলে এটা কিভাবে সম্ভব?

 এর উত্তরটা খুবই সোজা। এর জন্য সবার আগে জানতে হবে ' প্ল্যাসিবো ' কাকে বলে। প্ল্যাসিবো তে শুধু সেই সব রোগই সেরে উঠবে যা মানসিক কারণে সৃষ্টি (Psyscho Somatic Disorder)। নয়তো কোনো ভরে পড়া ব্যাক্তির ক্ষমতা নেই  ক্যান্সার টু এইডস রোগী কে সুস্থ করে তোলে। আসুন জেনে নিই' প্ল্যাসিবো ' আসলে কি বা কাকে বলে। 

আসলে, মানবদেহে যত প্রকার রোগ ব্যাধি হয়, তার একটা বড় অংশই কিন্তু মানসিক কারণে সৃষ্ট। হ্যাঁ, শুনতে অবাক লাগলে এটাই সত্যি। বুক ধড়ফড়, উচ্চ বা নিম্ন ব্লাডপ্রেশার, উচ্চ বা নিম্ন ব্লাডসুগার, হাঁপানি, মাথার যন্ত্রনা, শরীরের নানান স্থানে ব্যাথা, পুরুষত্বহীনতা, কামশীতলতা, পেটের গোলমাল, ক্লান্তি, অবসাদ, পেটে আলসার, গ্যাসট্রিকের অসুখ, কাশি, মহিলাদের ঋতুস্রাব-জনিত সমস্যা, বাত, শরীরের কোনো অংশের অবশতা ইত্যাদি অসুখ শারীরিক কারণ ছাড়াও মানসিক কারণেও হয়। অর্থাৎ, মানসিক প্রতিক্রিয়া বা মনের অত্যাল্প অসুস্থতা বা সাময়িক বিকৃতি মন ছেড়ে শরীরের আশ্রয় নেয় রোগীর অজান্তে। যদিও এভাবে মানসিক রোগ হওয়া বা বৃদ্ধি হওয়া আটকে যায়; এটাকে মনের "স্কেপগোট”বলে। কিন্তু শারীরিক অসুবিধা উপলব্ধ হয়; অথচ শারীরিক কারণ খুঁজে পাওয়া যায় না মেডিকেল পরীক্ষায়। এসব রোগকেই "দেহ-মন-জনিত বিশৃঙ্খলা”বা "Psycho-Somatic Disorder”বলে। জলপড়া, তেলপড়া, চরণামৃত, স্পর্শ চিকিৎসা, ঔষধ-গুণহীন ক্যাপসুল বা ট্যাবলেট অথবা ইঞ্জেকশন ইত্যাদির প্রয়োগ করে অনেক সময় এই Psycho-Somatic Disorder-এর রোগীদের সুস্থ করে তোলা সম্ভব। এই ধরনের চিকিৎসাপদ্ধতিকে বলে 'প্ল্যাসিবো' (Placebo)। যার অর্থ করলে দাঁড়ায় 'আমি খুশি করবো কিংবা আমি সেরে উঠবো'। ইংরাজিতে একে বলা চলে ' I Will Please '। এখানে রোগীর বিশ্বাসবোধ-এর গুরুত্ব অপরিসীম। 

কোনো Psycho Somatic Disorder-এর রোগী যদি জলপড়া, তেলপড়া, ঝাঁড়ফুক, স্পর্শ চিকিৎসা বা রেইকি, চরণামৃত, হোমিওপ্যাথি  ইত্যাদিতে গভীরভাবে আস্থা রাখে, তাহলে জলপড়া ইত্যাদি যা আগেই লিখেছি তাতে সুস্থ হতে পারবে অবশ্যই। এই সুস্থ হয়ে ওঠার পেছনে উক্ত জিনিসগুলোর কোনো ভূমিকাই নেই। একেবারেই শূন্য। এখানে রোগীর গভীর বিশ্বাসই একমাত্র Factor  বা গুণ। 

ইতিমধ্যে লেখাটা বেশ লম্বাচওড়া হয়েছে। পাঠক বন্ধুদের ধৈর্য্যচ্যুতি হতে পারে, তাই আপাতত এখানেই ইতি টানতে বাধ্য হলাম। মনোরোগ চিকিৎসক বা মনোবিজ্ঞানীদের মতে ভূতে ভর কিংবা ঈশ্বরের ভর ঠিক কি এই বিষয়ে আরো বিস্তারিত জানতে হলে অবশ্যই পড়ুন-

১- Modern Synopsis of Comprehensive Text Book of Psychiatrist, by-  Harold I.kaplon & Benjamin Sadock,3rd edition, Williams & Williams - London.

 ২- দেজ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত, প্রবীর ঘোষ এর লেখা অলৌকিক নয়, লৌকিক ২ য় খন্ড, মনের নিয়ন্ত্রণ যোগ মেডিটেশন এবং আমি কেন ঈশ্বরে বিশ্বাস করিনা।

৩- অলৌকিক চিকিৎসায় কি রোগ সারে? রাজেশ দত্ত, র‍্যাডিক্যাল। 

৪)মনের বিকার ও প্রতিকার- ড: ধীরেন্দ্র নাথ  নন্দী - আনন্দ পাবলিশার্স।

পরিশেষে এই লেখকের বিনীত অনুরোধ, কোনো অন্ধবিশ্বাসে বশ হওয়া নয়। নিজের যুক্তি-বুদ্ধির প্রয়োগ করুন, যেটা সত্য সেটাকেই গ্রহণ করুন। মনে রাখবেন মানসিক রোগী মানেই কিন্তু সেই ব্যাক্তি উন্মাদ কিংবা পাগল নয়। সঠিক সময়ে সু-চিকিৎসা পেলে তাঁরা অবশ্যই সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন।আপনার আশেপাশে এমন কোনো ভারগ্রস্ত ব্যাক্তি কে দেখলে ভক্তি ছেড়ে যুক্তিতে মন দিন। ওঝা,গুনিন ইত্যদিদের বাড়ি যাবেন না, তথাকথিত ভূত বিশেষজ্ঞদেরও ডাকবেন না। রোগ লুকিয়ে না রেখে, রোগী কে অবদমিত করে না রেখে দ্রুত একজন ভালো মনোরোগ চিকিৎসক এর  

পরামর্শ নিন। কোনো অলৌকিক ঘটনার ব্যাখ্যা চাইলে অবশ্যই জানান। সাধ্যমতো চেষ্টা করবো সমাধানের নয়তো ভাণ্ডাফোঁড় করার। The Drugs And Magic Remedies (Objectionable Advertisement ) Act 1954 অনুযায়ী কোনো ওঝা, জানগুরু, গুনিন, সৎসখা, দিখলি, অলৌকিক রোগের চিকিৎসক (!) ইত্যাদিরা মন্ত্র-তন্ত্র, তাবিজ-কবজ, জলপড়া, তেলপড়া ইত্যাদির দ্বারা রোগ মুক্ত করার দাবী জানালে কিংবা কাউকে ডাইনি ঘোষণা করে শারীরিক বা মানসিক অত্যাচার করলে তাদের বিরুদ্ধে রয়েছে কড়া শাস্তির ব্যাবস্থা। জেল এবং জরিমানা দুটোই। 

মনে রাখবেন, এইসব ভূত, প্রেতাত্মা, অশরীরী, জ্বীন ইত্যাদি থাকে গল্পগাঁথায়, পত্রিকার পাতায় এবং আমাদের মনের অন্ধকার জগতে, সেখানে জ্ঞানের আলো জ্বলালেই তেনারা ভ্যানিশ। 

প্রেম, যৌনতা এবং.. -
অভিষেক দে
Nov. 16, 2024 | প্রেম | views:291 | likes:45 | share: 0 | comments:0

একজোড়া নারী- পুরুষের ভেতর প্রেম বা ভালোবাসা মোটেই অপরাধ,বে-আইনি  কিংবা নোংরামো নয়। বরং সুস্থ, স্বাভাবিক ব্যাপার। প্রেমের কিছু পূর্ব-শর্ত আছে। যেমন বন্ধুত্ব, বিশ্বাস, শ্রদ্ধা, সহযোগিতা,মতাদর্শগত মিল এবং স্বনির্ভরতা।


দু-জন মানুষের ভেতর প্রেম, ভালোবাসা থাকলে যৌনতা কিংবা দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলা কিংবা সেই সম্পর্কে যাওয়া টা মোটেই অপরাধ কিংবা নোংরা মানসিকতার লক্ষণ নয়। কারণ,প্রেম থাকলে যৌনতাও থাকা স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু সেটা অবশ্যই হবে দু-জনের সম্মতিতে। কখনই জোর করে নয়। জোর করে দৈহিক সম্পর্কে যাওয়া ধর্ষণের সামিল। যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এর শাস্তি আজীবন জেল কিংবা সোজা ফাঁসি। যৌনতাকে বেশির ভাগ মানুষ মনে করেন নোংরা, অতি-গোপনীয় কিছু। এটা অবশ্যই শূচিবাতিকগ্রস্ততা,যা একটা মানসিক রোগ।


তন্ময় এবং মেঘনা দ-ুজনেই প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনষ্ক তরুণ-তরুণী। দু-জনেই চাকুরীজীবী। দু-জনের ভেতর প্রেম এবং সেখান থেকে একসময় বিয়ে। দু-জনের যৌনজীবন টাও স্বাভাবিক ছন্দেই চলছিল। এরই মধ্যে জন্ম নেয় মেঘনা এবং তন্ময়ের কন্যা সন্তান। বর্তমানে কন্যার বয়স পাঁচ। কয়েকবছর সব ঠিকঠাক থাকার পর আচমকা দু-জনের সম্পর্কে চিঁড় ধরে। সামান্য ছোট খাটো বিষয়েও প্রায়শই মনোমালিন্য এবং শেষে ঝগড়া। সব তো প্রথম থেকে সুন্দর ছন্দেই চলেছিল, তাহলে হটাৎ কি এমন হলো যাতে দু-জনের ভেতর আজ মতের এবং  মনের অমিল লক্ষ্য করা যাচ্ছে? আসুন মুক্তমনে উত্তর খুঁজি।


মেঘনার বক্তব্য : " তন্ময়ের কোনো চয়েস বা পছন্দ বলে কিছু নেই। কিসব যে হিজিবিজি,উল্টোপাল্টা রঙের শাড়ি,কসমেটিক্স কিনে আনে। বাধ্য হয়ে ফের দোকানে ওকে পাঠাতেই হয় পালটে আনতে। আমি কি ধরনের শাড়ি কিনি,কী জুয়েলারি, কসমেটিক্স ব্যবহার করি সেসবের খবরও রাখেনা। সে কথা বললেই আবার বাবুর রাগ হয়।যত্তসব,হুঁ। মেয়েটা যে বড় হচ্ছে সেদিকে বাবুর যেন ধ্যান নেই। আজকাল হটাৎ করেই তেনার খিদে জেগে ওঠে। এই তো সেদিনের ঘটনা, রান্না করছি আর উনি পেছন থেকে এসে কোমড় জরিয়ে গালে একটা চুমু। দিয়েছি খুন্তি দিয়ে সলিড একটা। বুড়ো বয়সে ভিমরতি "।  


মেঘনার উদ্দেশ্যে বলা যায় : আপনার বর না হয় একটা উল্টোপাল্টা শাড়ি কিংবা কসমেটিক্স, জুয়েলারি কিনে এনেছেন, এবং সেটা হয়তো আপনার অপছন্দই হলো। কিন্তু সেটার জন্য আপনি তন্ময় বাবুকে যে কয়েকটা কড়া কথা শোনালেন সেটা কি ঠিক হলো? উনি কিন্তু আপনার জন্য খুশি মনেই শাড়ি ইত্যাদি কিনেছেন। আপনি যদি হেসে বলতেন ' খুব সুন্দর হয়েছে ' তাহলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যেতো? না হয় উনাকে পরে একটু রসিকতার ছলেই বোঝাতেন যে সেটা আপনার ঠিক পছন্দ হয়নি। আপনি উনাকে সঙ্গে করে দোকানে গিয়ে না হয় কিনেই আনতেন আপনার পছন্দসই জিনিষ। এতে আপনার বর ও খুশি হতেন। দেখতেন আগামীদিনে উনি আপনার পছন্দসই জিনিষ ই ঠিক কিনে এনে দিতেন। একটা ছোট্ট কথা যেখানে ঝগড়ার পরিবর্তে খুশি আনতে পারে, সেখানে কি খুবই প্রয়োজন ঝগড়া করে নিজের এবং অপরের রক্তচাপ বাড়ানোর। মেঘনা, আপনি নিজেকেই প্রশ্ন করে দেখুন তো সত্যি কি আপনি আগের চেয়ে বদলে যাননি? আপনি তন্ময় বাবুকে দুঃখ দিতে চান বলেই কি দুঃখ দিচ্ছেন? আর সেক্স। সেটা আপনিই ভালোই বুঝবেন। এই বিষয়ে কোনো সমস্যা হলে উনাকে ঠান্ডা মাথায় বোঝান যে এভাবে মেয়ের সামনে এইসব দুষ্টুমি না করে রাতে বিছানায় করলে বরং ভালা হয়। অবশ্যই সেটা আপনার সম্মতিতেই, জোর করে নয়। মেঘনা, আপনি কি জানেন একজন সুস্থসবল মানুষ ৬০ বছর বয়সের পরেও যৌনতা কে উপভোগ করতে পারেন? নিশ্চই জানেন না। তাই যৌনতাকে (সেক্স) নোংরামো না ভেবে স্বাভাবিক ভাবে সেটাকে গ্রহণ করার চেষ্টা করুন অথবা সরাসরি না বলে দিন বর কে। কিংবা আজ আপনার বরকে  পছন্দ না হলে সেটাও সরাসরি জানিয়ে দিন। মনে রাখবেন জোর করে কোনো সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায়না।


আচ্ছা, মেঘনা আপনি নিশ্চই রান্নার নতুন রেসিপি টা ভালো হয়েছে কিনা বরকে জিজ্ঞেসা করেছেন। বর নিশ্চই আপনার রান্নার তারিফও করেছেন। অপছন্দ হলেও আপনাকে হয়তো খুশি করার জন্য রান্নার প্রশংসা করেছেন। উনি আপনাকে দুঃখ দিতে চাননা তাই মিথ্যেটুকু বলেছেন আর আপনিও পরে খেতে গিয়ে দেখেছেন রান্না ভালো হয়নি।ঝাল বেশি কিংবা নুনের পরিমাণ কম। 


তন্ময়ের বক্তব্য : " সেইদিন টা ফিরে পেতে চাই বড্ড বেশি করে যখন আমাদের বিয়ে হয়নি। মানে দু-জনে প্রেম করতাম, সেই কলেজের দিন গুলোতে। কিন্তু কেন? আসলে সেসব দিনে আমাদের ভেতর মনের অমিল ছিলোনা। ছিলোনা মতের অমিলও। কিন্তু আজ সেসব অতীত। মেঘনা আজকাল বড্ড বেশি খিটখিটে হয়ে গেছে হয়ে গেছে। ভালো,খারাপ সবেতেই ঝগড়া করে। এই তো কয়েকদিন আগেকার ঘটনা, বউ কে বললাম অফিসের কয়েকজন কলিগ আসবে, একটা মিটিং করবো বাড়িতে বসে। কিছু স্ন্যাক্স বানিয়ে দাও। উনি মুখ ঝামটা দিলেন। অগত্যা একটা কফি শপে বসেই আলোচনা সারতে হলো। আজকাল উনাকে আদর টাদর করতে গেলেও যেন কোর্ট থেকে পারমিশন নিতে হবে, অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে। আসলে সন্দেহ। বুঝলেন সন্দেহ। আমার অফিসের একজন মহিলা কলিগ একদিন আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন একটা পেন ড্রাইভে লোড করা কিছু জরুরি ডকুমেন্ট দিতে। তা আমার বউ এর কিভাবে যেন মনে হয়েছে যে ঐ মহিলার সাথে আমি নাকি ফষ্টিনষ্টি করে বেরাচ্ছি। কিন্তু এটা সম্পূর্ণ যে ওর ভুল ধারনা সেটা বোঝানোই মুশকিল। ইদানীং ওর ঝগড়ুটে স্বভাবের কারনে আমিও পালটা ঝগড়া করি। ওকে জ্বালাই, আনন্দ পাই। মনে মনে বলি, দেখ কেমন লাগে "। 


তন্ময়ের উদ্দেশ্যে জানাবো : চোখের বদলা চোখ এবং রক্তের বদলা রক্ত এই নীতি নিয়ে চললে পৃথিবী একদিন মানবশূন্য হবেই।ভাবছেন কেন এমন বলছি? তাহলে শুনুন মশাই, বউ না হয় আপনার কথামতো, কারণে অকারণে ঝগড়া করছেন মানলাম কিন্তু আপনিও তো পালটা ঝগড়ার পথেই যাচ্ছেন। সেটা কি ঠিক কাজ ? স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে আজ আপনাদের ভেতর যে সম্পর্কের অবনতি ঘটছে তার পেছনে একটাই কারন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। সেটা হলো আপনার সেই মহিলা অফিস কলিগ। বিশ্বাস বড়ই বেয়াড়া শব্দ। যা গড়তে সময় নেয় কিন্তু ভাঙ্গতে সময় বেশি নেয়না। আপনি নিজেদের সম্পর্ক কে আবার আগের মতন অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে আন্তরিক হলে কয়েকটা কাজ করুন। উইকএন্ডে সপরিবার বাইরে ঘুরতে বেরান। লাঞ্চ অথবা ডিনার টাও বাইরেই সেরে নিন। আরেকটা দারুণ  কাজও করতে পারেন। আপনার কন্যাকে প্রতিবেশী কিংবা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে রেখে দু-জন মিঞা বিবি মিলে বেরিয়ে পড়ুন কেনাকাটা করতে, সিনেমা দেখতে এবং অবশ্যই বাইরে খেতে। রোমান্টিকতা আনতে ক্যান্ডল লাইট ডিনার ও করতে পারেন। কারণবারি চাখতে চাইলে বউ এর অনুমতি নিয়েই চাখবেন সেখানে। বউ মানা করলে ভুলেও জেদ দেখাবেন না। যেদিন আপনি বাড়িতে থাকবেন, অর্থাৎ অফিসের ছুটি সেদিন অবশ্যই চেষ্টা করুন বাড়ির কাজে বউকে সাহায্য করতে ( বউ এর কোমড় জরিয়ে ধরার চিন্তা ছেড়ে দিয়ে )। সাথে যে মহিলা কে নিয়ে আপনাদের ভেতর অশান্তির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে সেটা নিয়েও খোলামেলা আলোচনা করুন। বউকে সবটা জানান। সম্ভব হলে উনাকে সরাসরি বলুন যেন নিজেই গোয়েন্দাগিরি করে দেখে যে আপনি অন্য মহিলার সাথে কোনো রকমের গোপন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন কিনা।


মনে রাখবেন সুস্থ আলোচনার মাধ্যমেই কিন্ত অনেক সমস্যার সমাধান করে ফেলা সম্ভব। চাইলে কোনো মনোবিদ কিংবা মনোরোগ চিকিৎসক এর পরামর্শও নিতে পারেন। আখেরে লাভ আপনার। আর দৈহিক সম্পর্ক। সেটা নিয়েও বউ এর সাথে খোলাখুলি আলোচনা করুন। উনার অপছন্দ হলে না হয় এড়িয়েই যান আপাতত। উনাকে ঠান্ডা মাথায় বোঝান সেক্স কোনো নোংরামো নয়, বরং দু-জন সুস্থ সবল মানুষের ভেতর সেক্স হওয়াটা স্বাভাবিক ব্যাপার। দেখবেন সব সুন্দর ভাবে মিটে যাবে। একদিন আপনারাই একে অপরকে বলবেন " হ্যাপি ম্যারেড লাইফ "।

একুশ শতকের লজ্জা: ডাইনি -
অভিষেক দে
Nov. 10, 2024 | কুসংস্কার | views:988 | likes:68 | share: 3 | comments:0

সময়টা ২০০১ সালের সম্ভবত জানুয়ারি মাস। বাঁকুড়ার একটি গ্রামে গিয়েছি বন্ধু কৌশিক এর মামাতো দাদার বিয়েতে। বিয়ের আগের দিন সন্ধেবেলা গ্রামে পৌছে মেতে গেছি বিয়ের অনুষ্ঠানে। পরের দিন খুব ভোরে উঠে বন্ধুর একজন মামার সাথে বন্ধু  কৌশিক এবং আমি বেরিয়েছি শীতের সকালে গ্রাম ঘুরতে। ঘুরতে ঘুরতে এক যায়গায় দেখি অনেক মানুষের ভীড়। ব্যাপার টা কি জানতে আমরা তিনজনে উক্ত স্থানে চলে আসি। দেখি কয়েকজন হোমড়াচোমড়া ব্যাক্তি খুব উত্তেজিত হয়ে কয়েকজন কে যেন কড়াভাষায় কিছু বলছে এবং তাঁদের অনতিদূরে একজন ষাটোর্ধ মহিলা অসহায় ভাবে মাটিতে মাথা নীচু করে কাঁদছেন। বন্ধুর মামা আমাদের দাঁড় করিয়ে রেখে বিষয় টা জেনে এসে আমাদের জানালেন, উক্ত মহিলা নাকি ডাইনি। গ্রামের একজন কে দেখলাম উনি নাকি গুণিন, তিনিই নাকি জানিয়েছেন উক্ত মহিলাটি একজন ডাইনি এবং মহিলার পরিবার কে গ্রামের মাতব্বর দের কাছে পঁচিশ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে এর জন্য নইলে গ্রামে থাকা উক্ত পরিবারটির পক্ষে নাকি  অসম্ভব। 

ডাইনির ব্যাপারে গল্পের বইতে আগে অনেক পড়েছি, কিন্ত এভাবে সরাসরি একজন ডাইনি কে দেখে বিষ্ময়ে হতবাক হয়েছিলাম বিষয়টা সেদিন ভালোভাবে না জানার দরুন। জানিনা, ডাইনি ঘোষিত সেই মহিলা এবং তাঁর পরিবারটি আদৌ অতগুলো  টাকা দিয়ে গ্রামে থাকতে পেরেছিলেন কিনা। অনেক পরে জেনেছি ডাইনি বা ডায়েন বলে বাস্তবে কিছুই হয় না,ওসব গল্পগাঁথাতেই সম্ভব। কিন্ত আমি বললেই বা লোকে মানবে কেন? বাড়ির চালে ফনফন করে লাউ গাছ বেড়ে উঠছিল,কড়াও পরেছিল রাশি রাশি। আচমকা গাছ শুকিয়ে মরে গেলো। কেউ কি তবে কু-নজর দিয়েছে গাছে? কে-সে? ডাইনি নয় তো? সদ্য প্রসুতির সন্তান ক্ষিদের জন্য কাঁদছে অথচ মায়ের স্তনে মুখ দিচ্ছে না, কেউ কি মায়ের স্তন ভেড়ে দিয়েছে? সে, ডাইনি নয় তো? ছটফটে শিশুটা কেমন যেন হঠাৎ করেই ঝিমিয়ে গেছে। এটা ডাইনির কু-নজর নয়তো? এই তো গতবছর হারাণ এর মা এর পায়ে ঘা হয়, মলম লাগিয়েও কাজ হয় নি শেষে গ্রামের একজন গুণিনের কাছে জানতে পারলো গ্রামেরই এক ডাইনি, সেই পা এর রোগ টা জিইয়ে রেখেছে। শেষে গুণিন কে দক্ষিণা দিয়ে কিসব শেকড়বাকড় পরে সুস্থ হলো। 

শুধু আদিবাসী সমাজ নয়, শিক্ষার সু্যোগ না পাওয়া কিংবা শিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত শহুরে মানুষের একাংশও ডাইন বা ডাইনি বা ডায়েন এ গভীরভাবে বিশ্বাস করেন। আদিবাসী সমাজে এই বিশ্বাস হচ্ছে সমুদ্র গভীর। কোনো গ্রামের কোনো গুনিন,জানগুরু, ওঝা,দিখলি, সৎসখা ইত্যাদিরা যদি কোনো মহিলাকে একবার ডাইনি ঘোষণা করে দেয় তাহলে সেই মহিলাকে বাঁচানো খুবই সমস্যার। গ্রামের মোড়ল বা মাতব্বর দের বিধান মতো ঘোষিত ডাইনির পরিবার কে মোটা অঙ্কের জরিমানা দিয়ে তবে গ্রামে থাকতে হয়। কখনওবা ডাইনি বলে যাকে দেগে দেওয়া হয় তাঁকে প্রকাশ্যে নির্মম ভাবে হত্যাও হয়। খবরের কাগজে প্রায়শই এমন খবর আমাদের চোখে পরে। বিভিন্ন দেশের নানান গল্পগাঁথায় ডাইনি নিয়ে প্রচুর কাহিনী রয়েছে এসব গল্পই ধিরে ধিরে আমজনতাকে ডাইনির প্রতি বিশ্বাস করতে বাধ্য করে। বাধ্য করে শেখাতে যে, ডায়েন বা ডাইনিদের কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা-টমতা আছে, এবং ডাইনিরা সমাজের ক্ষতিই করে থাকে। স্টার প্ল্যাস হিন্দি চ্যানেলে তো ডাইনির প্রতি জনগণের বিশ্বাস জাগাতে  ' নজর ' নামে একটা সিরিয়াল পর্যন্ত হয়েছে। এইধরনের সিরিয়াল বা সিনেমার প্রভাব মানবজীবনে অনেক। ডাইনি সন্দেহের বশবর্তী হয়ে না জানি কত অসহায় মহিলারা সামাজের চোখে অপরাধী হয়ে অত্যাচারিত হবে, হচ্ছেও। প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে এসব চললেও কোনো প্রতিবাদ,প্রতিরোধ নেই। এই প্রসঙ্গে একটি লজ্জাজনক ও নৃশংশ ঘটনার কথা আপনাদের শোনাই। 

রাঁচির মান্দার ব্লকের কাঞ্জিয়া মারাইটোলি গ্রাম। এই গ্রামেই গত ৭ই অগাস্ট, ২০১৫ সালে পাঁচজন মহিলা কে পিটিয়ে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করেছে একদল উন্মত্ত গ্রামবাসী। 

উক্ত পাঁচজন মহিলার অপরাধ, তারা নাকি " ডাইনি"। রাঁচির এই গ্রামে কেউ ডাইনি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেনা, বরং গভীরে বিশ্বাস করে। ফলে যা হয় সেটা সত্যিই ভয়াবহ।  ২০১৪ সালে এই মারাইটোলি গ্রামের পাশেই একজন মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে  হত্যা করার পরে গ্রামের এক ওঝার নিদান মতে সাইকেলের হ্যান্ডেলে উক্ত মহিলার কাটা মাথা নিয়ে গোটা গ্রাম ঘোরানো হয়।পুলিশ প্রশাসন কে সম্পুর্ন উপেক্ষা করেই। পুলিশ আসায় গ্রামবাসীরা জানায়, খুন করে বেশ করেছি। ( তথ্যসূত্র : আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৩ আগষ্ট ২০১৫ )। 


পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৩ থেকে ২০১৫ র অগাস্ট পর্যন্ত ডাইনি সন্দেহে কিংবা বিশ্বাসে এই গ্রামে ১২৪ জন মহিলা দের নির্মম ভাবে হত্যা হয়েছে। আরেকটি ঘটনা এই প্রসঙ্গে আরেকটি জঘন্য ঘটনার কথা শোনা যাক। 

বাঁকুড়া সিমলাপাল অঞ্চলের চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার গত প্রায় দেড়বছর হল গ্রামে ফিরতে পারছেন না। কারণ তিনি নাকি ডাইন বা ডাইনি। গ্রামের একজন 

জানগুরুর নির্দেশে, পরিবারটিকে জমিজমা বিক্রি করে জরিমানাও দিতে হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তাঁদের ভিটেমাটিতে থাকার অধিকার নেই।  বর্তমানে একটা আদিবাসী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের অনুগ্রহে পরজীবির মত বেঁচে আছেন ওনারা। অদ্ভুত এই অবস্থা। প্রশাসন সব জেনেও অন্ধ সেজে বসে আছে। 

আশ্চর্য হলেও, রাগ হলেও এটাই আমাদের ভারত।

প্রশাসনের নাকের ডগায় এসব কান্ড ঘটলেও তারা নির্বিকার। 

"ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি"-র পুরুলিয়া শাখার সম্পাদক মধুসূদন মাহাতো, দীর্ঘবছর ধরে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া সহ জঙ্গলমহল এলাকায় যুক্তিবাদী বা  সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন।  বিশেষ ভাবে ডাইনি সমস্যা সহ আদিবাসী এলাকার আরেকটি সমস্যা নাবালিকা বিবাহের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলার কাজ মধুসূদন মাহাতো সহ কয়েকজন মুক্তমনা সহযোদ্ধারা নিরলস ভাবে কাজ করছেন। সম্প্রতি, মধুসূদন মাহাতো, তথ্যের অধিকার আইনে রাজ্যে সরকারের স্টেট ক্রাইম ব্যুরোর কাছে জানতে চেয়েছিলেন যে কত মানুষকে ডাইনি সন্দেহে হত্যা করা হয়েছে?  সরকার লিখিত ভাবে জানিয়েছে এবিষয়ে কোন তথ্য তাদের কাছে নেই। ভাবা যায়! যেখানে তথ্যই নেই সেখানে প্রতিকার দুরাশা করাটা বোকামো।

স্বাভাবিক ভাবেই প্রশাসনের দারস্থ হয়েও সুবিচার পাননি চূড়ামণি মান্ডি এবং তার পরিবার। এই অবস্থাই কি চলছে, চলবেও? প্রশাসন কি এভাবেই জেগে ঘুমাবে? কিছু আলোচনার সময়ে মধুসূদন মাহাতোর দাবী, কাউকে ডাইনি বলে দেগে দেওয়ার পেছনে একটা গভীর চক্রান্ত আছে। দেখা যাচ্ছে, যেই বছর কম বৃষ্টিপাত বা অনাবৃষ্টির ফলে খরার প্রকোপ দেখা যায় সেবছরই ডাইনির ঘটনা বেশি শোনা যায়। পুরুলিয়া, বাঁকুড়ার মতন যায়গায় এমনিতেই চাষাবাদ খুব কম হয় বৃষ্টি বা জলের অভাবে। তাই কয়েকজন ধূর্ত ব্যাক্তি এই বিষয় টাকে হাতিয়ার করে। তাঁরা বুজরুক, প্রতারক ওঝা,গুণিন, জানগুরু ইত্যদিদের সাথে মিলে কোনো মহিলা কে ডাইনি ঘোষণা করে দেয় এবং সঙ্গে থাকে মোটা অঙ্কের জরিমানা। স্বাভাবিক ভাবে অনেকেরই সেই টাকা দেওয়ার সামর্থ্য নেই বলে চলে অত্যাচার এবং গ্রামে একঘরে করে রাখার বিধান। সোজা কথা, উদ্দ্যেশ্যে, কোনো মহিলাকে ডাইনি বলে দেগে দিয়ে তাঁর কাছ থেকে মোটা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার নোংরা চক্রান্ত। যেহেতু গ্রামগঞ্জে আজও ডাইনির ক্ষমতায় বিশ্বাসী ( পড়ুন অন্ধবিশ্বাসী) মানুষের অভাব নেই তাই বিশ্বাসীরাও দল কোমড় বেঁধে নেমে পড়ে যাকে ডাইনি ঘোষণা করা হয়েছে তাঁর অথবা তাঁর পরিবারের ওপরে ক্রমাগত চাপ দিতে জরিমানার টাকা দেওয়ার জন্য। 


যখন চিকিৎসা বিজ্ঞান কিংবা মনোবিজ্ঞান আজকের মতন এতো উন্নত হয়নি সেসময় অজানা জ্বর বা রোগের প্রাদুর্ভাব কে অনেকে বোঙ্গা বা দেবতার অভিশাপ নয়তো ডাইনির কারসাজি ধরে নিতো। অবস্থা এখনো পালটায় নি। আজও প্রত্যন্ত গ্রামে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই। তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের ৭৩ বছর পরেও। আজও একশ্রেণীর মানুষের পরনে কাপড় নেই, হাতে রোজগার নেই, সু-চিকিৎসা নেই, পেটে খাদ্য দেওয়ার মতন অবস্থা নেই, পারিস্কার পানীয়জল নেই, বাসস্থান নেই, মাথার ওপরে ছাদ নেই। এই নেই এর রাজ্যে আছে শুধু প্রতারণা, বুজরুকি, ধর্মের সুড়সুড়ি। গলা পর্যন্ত দুর্নীতিতে ডুবে থাকা দেশে নাগরিক অধিকার আজ খর্ব। আমজনতা তাঁদের সংবিধান স্বীকৃত ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত। যে দেশে শুধুমাত্র ঘুষ দিয়ে কাজ করাতেই বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ হয়ে যায় সেদেশের জনতা সু-চিকিৎসার সুযোগ না পেলে এবং সচেতনতার অভাবে এসব ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের খপ্পরে পরে সর্বসান্ত হয় এবং ডাইনি ঘোষিত বলে অত্যাচারিত,লাঞ্ছিত হয় প্রতিদিন, প্রতিমূহুর্তে। আসলে পুরুষশাসিত সমাজের মাথারা নারী কে কোনো দিনই ' মানুষ ' হিসেবে দেখেনি কিংবা ভাবেনি। সর্বদাই ভেবেছে ভোগের সামগ্রী অথবা সংসার সামলানোর যাবতীয় কাজ করার একটা যন্ত্র। 

প্রায় দুশো খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ ডাইনিতত্ত্ব বা ডাকিনিতত্ত্বের রমরমা শুরু হয় এবং দ্রুত ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। ১৬৮৪ খ্রিষ্টাব্দে রেসিন্যান্ড স্কট নামক একজন ব্যাক্তি প্রকাশ করেন ' The Discovery of Witchcraft ' নামের গ্রন্থ টি। উক্ত বইটির মূল আলোচনা ছিল মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে ঘোষনা করে সমাজ মিথ্যেই তাঁদের ওপরে অত্যাচার করেছে। স্কট এর বইটি প্রায় সর্বত্রই ধিক্কৃত হয়েছিল সেসময়। এরও আগে ১৪৮৬ সালে খ্রিষ্টান ধর্মে পোপের নির্দেশে ' The Witche's Hammer ' নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে মানসিক রোগীদের ডাইনি বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই গ্রন্থেই বলা হয়েছিল ডাইনিরা সমাজের শত্রু, ওরা অশুভ শক্তি, তারা মন্ত্রতন্ত্র, তুকতাক জানে,সাধারণ মানুষ থেকে পশুপাখি দের ক্ষতি করে, নানান অসুখ তৈরী করে, রক্ত শুষে নেয়। তাই পোপের নির্দেশ ছিলো, ওদের হাত থেকে বাঁচার একমাত্র পথ ওঁদেরকে জ্যান্ত জ্বালিয়ে শেষ করে দেওয়া হোক। 'The Witche's Hammer ' গ্রন্থটির সময় থেকে বহুযুগ ধরে প্রকাশ্যে মানসিক রোগিণী অর্থাৎ মহিলাদের উপর বারে বারে আঘাত এসেছে যা আজও ক্রমবর্ধমান। এখন হয়তো ডাইনি ঘোষিত কোনো মহিলাকে জীবন্ত জ্বলিয়ে দেওয়া হয়না, কিন্ত যা যা অত্যাচার হয় সেটা কোনো অংশেই কম নয়। রাঁচির মারাইটোলি গ্রামের ঘটনাটি বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য, যা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় এই সমস্যার শেকড় কতটা গভীরে।

National Crime Record Bureau র তথ্য অনুযায়ী, সাল ২০০০ থেকে ২০১৬ র মধ্যে ডাইনি ঘটনায় অত্যাচারিত ও খুন হয়েছেন ২৫০০ জন মহিলা। এতো গেলো সরকারি হিসেবে।  কিন্তু বিভিন্ন মানবধিকার বা যুক্তিবাদী বিজ্ঞানমনষ্ক সংগঠনের দাবী সংখ্যাটা কয়েকগুণ বেশি। ১৫০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৬৬০ খ্রীষ্টাব্দ  পর্যন্ত ডাইনি অপবাদে শুধু ইউরোপেই মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছিল ৮০ হাজার মহিলাকে। এই জঘন্যতম কান্ড শুধু ইউরোপ নয়, জার্মানি, আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড সহ অনেক দেশেই ছিল যথেষ্ট আকারে।

শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা যাক বিখ্যাত লেখিকা প্রয়াত মহাশ্বেতা দেবীর। উনি দীর্ঘসময় ধরে আদিবাসী দের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের দাবীতে প্রচুর কাজ করেছেন, বিশেষ ভাবে ডাইনির ঘটনা নিয়ে। আরেকজন ব্যাক্তি হলেন ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে মহাশয়। উনিও ডাইনি নামক একুশ শতকের লজ্জাজনক কান্ড নিয়ে যথেষ্ট কাজ করেছেন। কিন্তু ওনার কিছু বক্তব্য নিয়ে সমালোচনার অবকাশ রয়েছে। যেমন শ্রী বাস্কের  একটি লেখা ' আদিবাসী সমাজের সংস্কার ও কুসংস্কার ' এর এক যায়গায় উনি লিখেছেন- "এটাকে ( ডাইনি) কুসংস্কার কিংবা অন্ধ বিশ্বাস যাই বলি না কেন, ভারতবর্ষের প্রায় সব আদিবাসী সমাজেই এই ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা দেখা যায়। যদিও সকলেই জানে এর প্রয়োগ অসামাজিক তবুও তারা এর মোহমুক্ত হতে পারেনি। আদিবাসী সমাজের  কাছে এটা নিদারুণ অভিশাপ"।  

অর্থাৎ, শ্রীবাস্কের ধারণায়, ডাইনির মত একটা ক্ষতিকারক বিদ্যার চর্চা চলছে। তাঁর মানে উনিও মনে করেন ডাইনি বা ডাইন বা ডায়েন বাস্তবে হয় এবং তাঁদের সত্যিই কোনো অতিপ্রাকৃত বা অলৌকিক ক্ষমতা থাকে। গভীর দুঃখের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছি ডাইনির প্রতি এমন অন্ধবিশ্বাস থাকলে, যতই মিটিং মিছিল আন্দোলন কিংবা লেখালিখি হোক না কেন সমস্যাটা মোটেই দূর করা সম্ভব নয়। ডাইনির প্রতি গভীর বিশ্বাসও রাখবো আবার এর বিরুদ্ধে কলম চালাবো এটা সোজাসাপটা স্ববিরোধীতা ছাড়া অন্য কিছু নয়। আরো দুঃখ পাই যখন ব্যাক্তিগত ভাবে পরিচিত কয়েকজন বিজ্ঞান বা যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীরাও মনে করেন এই পৃথিবীতে সত্যিই ডাইনির অস্তিত্ব রয়েছে এবং তাঁরা নিজের ক্ষমতার বলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি করতে পারে। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে যাচ্ছে একদা পত্রপত্রিকায় ঝড় তোলা স্বঘোষিত ডাইনি ইপ্সিতা রায়চৌধুরী' র কথা। ১৯৮৮ সালে উনি সাড়াজাগিয়ে এসেছিলেন। সেসময় পত্রপত্রিকায় ওনাকে নিয়ে গাদা গাদা নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়েছিল। কয়েকটি পত্রিকাতো ওনাকে ভালো ডাইনি আখ্যা দিয়ে প্রশংসায় ভরা লেখা পর্যন্ত লিখেছে।  কিন্তু তারপরে যুক্তিবাদী আন্দোলন কর্মীদের দ্বারা ওনার বুজরুকি ফাঁস হয়। আগষ্ট থেকে ডিসেম্ভর ১৯৮৮ সাল নাগাদ বিভিন্ন পত্রিকায় উনার বুজরুকি ফাঁসের নানান মুখরোচক খবর প্রকাশিতও হয়। 

কোনো ওঝা,জানগুরু,গুণিন, সৎসখা, দিখলি ইত্যাদিরা ডাইনি সন্দেহে কোনো মহিলার ওপরে অত্বাচার করলে বা ডাইনি বলে ঘোষণা করলে, তাঁদের জেলে ঢোকাবার জন্য আমাদের দেশে বেশ কয়েকটা ভালো ভালো আইন রয়েছে। কিন্তু আকণ্ঠ দুর্নীতিতে ডুবে থাকা এই দেশে টাকা এবং রাজনীতিক পরিচিতি থাকার সুবাদে অপরাধীরা অনেক বে-আইনি কাজ করে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেরায় শুধুমাত্র জনগণের আইন বিষয়ে অজ্ঞতার কারণে। সরকার চাইলেই আইন কে মলাটবন্দি অবস্থায় ফেলে না রেখে, জনগণ কে এই বিষয়ে সচেতন করতে পারে। আমজনতা এইসব আইনের ব্যাপারে সঠিক ভবে জানলে নিজেরাই এইসব প্রতারকদের জেলে ঢোকাতে পারেন অনায়াসেই। 

"নারী সুরক্ষা ও নির্যাতন প্রতিরোধ বিল-২০১১" নামক এই বিলের ৪ নং সেকশনে স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, কোনো মহিলাকে ডাইনি ঘোষণা করে গ্রামের অন্য সদস্যদের উস্কালে বা ডাইনি ঘোষিত মহিলার বিরুদ্ধে জনমত তৈরী করে নির্যাতন ও  শাস্তি দিলে অপরাধীদের সর্ব্বোচ্চ সাজা সাত বছরের জেল সঙ্গে কুড়ি হাজার টাকা জড়িমানা। এছাড়া ঝাড়খণ্ড সরকার পাশ করিয়েছে "ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ২০১১", ছত্তিশগড় সরকার এনেছে "তোনাহি প্রতদ্ম নিভারণ আইন- ২০০৫", বিহার সরকার এনেছে  “ডাইনি প্রতিরোধ আইন- ১৯৯৯"।

"অন্ধশ্রদ্ধা নির্মূলন সমিতি"  র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নরেন্দ্র দাভোলকর, যাকে মৌলবাদী কট্টরপন্থীরা নৃশংশ ভাবে হত্যা করেছিল, তিনি ২০০৩ সাল থেকেই একটা আইন কে আনার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালান। অবশেষে "The Maharashtra Prevention and Eradication of Human Sacrifice and other Inhuman, Evil and Aghori Practices and Black Magic Act 2013" লাগু হয়। তাছাড়া "The Drugs and Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954", এবং 

"The Drugs and Cosmetics Act 1940" এর মতন বেশ কিছু কঠোর আইনও এই দেশে রয়েছে। 

সাংসদ প্রবর্তিত The Drugs and Magic Remedies ( Objectionable Advertisement) Act 1954, আইনটি ৩০ এপ্রিল ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতির অনুমোদন পায় এবং ১ মে ১৯৫৪ তে ভারত সরকার কর্তৃক প্রকাশিত সরকারি গেজেটের বিশেষ সংখ্যার দ্বিতীয় অংশের, প্রথম অধ্যায়ের ২৪ নং ক্রমে প্রকাশিত হয়। জম্মু ও কাশ্মীর বাদে ভারতের সর্বত্র এই আইন প্রযোজ্য। 

The Drugs Magic Remedies (Objectionable Advertisement) Act 1954 আইনের সংশোধন হয় ১৯৬৩ তে। এই আইনের ৯(এ) ধারা সংযোজন করে বলা হয়েছে, এই আইন ভঙ্গকারীদের Cognizable Offence হিসেবে গন্য করা হবে। অর্থাৎ কেউ কেউ পুলিশের কাছে অভিযোগ দায়ের না করলেও পুলিশ কোনোও ভাবে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে বলে প্রাথমিক জানার ভিত্তিতে কোনো অভিযুক্তকে ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারে ( Notwithstanding anything contained in The Code of Criminal Procedure 1898 an Offence Punishable under this Act shall be Cognizable)..

"The Drugs And Cosmetics Act 1940"  Amendment GSR 884 ( E)..বিভিন্ন সময়ে এই আইন সংশোধন হয়েছে। যেমন ১৯৫৫, ১৯৫৭, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৪ এবং শেষ এমেন্ডমেন্ট হয় ২০০৯ সালে। ১৯ মার্চ ২০০৯ তারিখে ভারতের প্রতিটি দৈনিক পত্রিকায় নোটিশ জারি করেছে কেন্দ্রের 'স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ দপ্তর'। এই আইনে এবার থেকে শাস্তির পরিমান আজীবন কারাদণ্ড এবং সাথে ১০ লক্ষ টাকা জরিমানা।

কয়েকজন মুক্তমনা, যুক্তিবাদী মানুষ এই রাজ্যে অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গে মহারাষ্ট্রের ধাঁচে একটা জোরালো বা কঠোর আইন প্রণয়ণের দাবীতে দীর্ঘদিন ধরে সরব। ইতিমধ্যে উনারা আইনের খসড়া জমা দিয়েছেন State Law Commission এর দপ্তরে। এনারা যেই আইনটি আনতে চান তার নাম "The West Bengal Prevention of Superstition and Black Magic Practices Bill ২০১৬।" আপাতত এই আইনটি লাল ফিঁতের ফাঁসে আটকে রয়েছে সরকারের উদাসিনতার কারনে। 

আইন আছে কিন্তু তার সঠিক প্রয়োগ নেই। গোদীলোভো কোনো রাজনৈতিক দলই চায়না আন্তরিক হতে, তাই তাঁরা ভোটব্যাঙ্কের স্বার্থেই আমজনতার তথাকথিত ধর্মবিশ্বাস কে আঘাত করতে নারাজ। নইলে সরকার চাইলে কড়া হাতে এইসব অমানবিক ও জঘন্য কাজ অনায়াসেই বন্ধ করতে পারে ব্যাপক আকারে সচেতনতার প্রচার ও প্রাসারের মাধ্যমে সঙ্গে ওঝা,জানগুরু ইত্যদিদের বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করে। এর সাথেই প্রয়োজন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র গড়ে তোলা। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে আজও বহু গ্রামগঞ্জে সু-চিকিৎসার কেন্দ্র নেই, নেই পর্যাপ্ত ওষুধ এবং ডাক্তার। তাই তো অজানা রোগ, জলবাহিত রোগ ইত্যাদিকে  ডাইনির প্রকোপ আখ্যা দিয়ে স্বার্থলোভী ওঝা,গুণিন, জানগুরুদের প্রতারণা অবাধে চলছে। 

ডাইনি বলে বাস্তবে কিছুই নেই ওসব গল্পের বই এবং সিনেমা সিরিয়ালেই সম্ভব। এইধারণা কে মনে গেঁথে নিলে এবং আন্তরিক হলে অবশ্যই বন্ধ করা যাবে এই ডাইনির ঘটনা গুলোকে। এর জন্য বিজ্ঞান আন্দোলন কর্মীদের প্রত্যন্ত গ্রামে গিয়ে নাটকের মাধ্যমে,  কুসংস্কার বিরোধী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে, প্রচার মাধ্যমে, ব্যাপকভাবে ডাইনির বিরুদ্ধে সচেতনতামূলক অনুষ্ঠানের কর্মসূচি নিতেই হবে, এর কোনো বিকল্প নেই। সঙ্গে প্রশাসনের উচিৎ নজর রাখা কোনো গ্রামে কাউকে ডাইনি ঘোষণা হওয়ার খবর পেলেই দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া এবং যে বা যারাই কোনো মহিলাকে ডাইনি আখ্যা দিয়েছে তার বিরুদ্ধে কড়া হাতে ব্যবস্থা নেওয়া। 

দুর্গাপুর, পশ্চিম বর্ধমান।


আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86929